সাধুগুরু-বাউলদের গান by নজরুল জাহিদ

বাংলাদেশের সাধুগুরু বা বাউলরা গানের সুর-বাণীর ভেতর দিয়ে নিজস্ব জীবন দর্শন ও উদার মানবতাবাদ প্রচার করেছেন যুগে যুগে। গানের ভেতর দিয়েই নির্ণয় করেছেন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের আত্মিক-দৈহিক সম্পর্ক এবং প্রচলিত ধর্মাদর্শের ঊধর্ে্ব উঠে উদারভাবে গেয়েছেন মানুষের সঙ্গে মানুষের মিলনের জয়গান। ভক্তিগান, ভাবগান, বাউলগান যে নামেই ডাকি না কেন, সাধুগুরুদের জীবনে এই গান এক অনিবার্য উপাদান। খ্যাতি, প্রতিষ্ঠা, অর্থ বা সম্মানের জন্য তারা গান


করেন না। তারা গান করেন আরাধনা বা সাধনার মাধ্যম হিসেবে, জীবনাচরণের অংশ হিসেবে। এই গানের মাহাত্ম্য দেশি-বিদেশি গবেষকদের মনোযোগ আগেই আকর্ষণ করেছে। আজকাল শহরেও এই গান জনপ্রিয় হচ্ছে। জনপ্রিয়তা বাড়াতে গানগুলো নিয়ে ফিউশন ম্যাশআপ জাতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হচ্ছে। উচ্চ প্রযুক্তি ও উচ্চ তাল-লয়-মাত্রা প্রয়োগ করা হলেও গানগুলো থেকে ভক্তিরস আর মরমি ঔদার্য যেন হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন আমরা লক্ষ্য করেছি যে, লালনের গানের কথা আর সুরের পরিবর্তন হচ্ছে। দীর্ঘকাল কপিরাইট থাকার কারণে রবীন্দ্রসঙ্গীতের একটা মান বা স্ট্যান্ডার্ড দাঁড়িয়ে গেছে, আমাদের কান তৈরি হয়ে গেছে, তাই বেসুরো রবীন্দ্রসঙ্গীত 'বাজার' পায় না। কিন্তু লালনের গান ছাপার অক্ষরে সংকলিত এবং স্বরলিপিতে নিবন্ধিত না থাকায় গানের কথায় গরমিল দেখা যাচ্ছে, নিবেদনের ভাব, ভঙ্গি বা সুরেও পরিবর্তন হচ্ছে। এ ছাড়া লালনের গানে যশোর-কুষ্টিয়া অঞ্চলের বেশকিছু আঞ্চলিক শব্দ আঞ্চলিক উচ্চারণে ব্যবহৃত হয়েছে, যা অন্য কারও দ্বারা সহজে উচ্চারণ করা কঠিন, ঠিকভাবে লেখাও সম্ভব নয় এবং ওই বিশেষ শব্দ বা শব্দমালার অর্থ জানা না থাকায় এসব শব্দ ঠিকভাবে গীত বা উচ্চারিত হচ্ছে না বিধায় পুরো গানের রসভঙ্গ এবং অনর্থ হচ্ছে।
পাশাপাশি আরও দুটি কাজ শুরু করা দরকার, প্রথমটি হলো সাধুগুরুদের সম্পর্কে অনেকে ভাবেন যে, তাদের সংসার নেই, তারা অবৈজ্ঞানিক, অস্বাস্থ্যকর, নেশাসক্ত, আয়-উপার্জনহীন পরাশ্রয়ী এবং অসামাজিক ও অযাচারী। এমনকি তাদের পোশাক-আশাক ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য নিয়েও ভুল ধারণা আছে; যেমন তারা কমলা বা গেরুয়া রঙের আলখাল্লা ধরনের কাপড় পরেন এবং তাদের লম্বা চুল বা মাথায় জট আছে। আসলে এ রকম ধারণা ভুল। স্বামী-স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তাদের জীবন আমাদের আর সবার মতোই। কেউ কৃষিকাজ করেন, কেউ চাকরি বা ব্যবসায়, তাদের ঘরসংসার, সমাজ-সামাজিকতা সব আছে। সাধারণ গৃহী অবাউলদের তুলনায় তারা বরং সমাজের জন্য উপকারী এ কারণে যে, তারা যুগে যুগে কেবল আক্রান্তই হয়েছেন, কখনও আক্রমণ করেননি। যে এলাকায় তাদের বসবাস সেখানকার থানায় খোঁজ নিয়ে জানা যাবে কোনো সাধুগুরুর নামে মামলা বা অভিযোগ নেই, যে গ্রামে বা মহল্লায় তাদের বসবাস সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যাবে তারা কোনো ঝগড়া-ফ্যাসাদে লিপ্ত নন। বরং একটি নির্মল জীবনধারার মধ্যে সঙ্গীতের সুর আর পূর্ববর্তী গুরুদের রচিত গানের বাণীর নির্দেশনা মেনে তাদের জীবন অতিবাহিত করেন।
আরেকটি জরুরি কাজ হলো, অশান্ত-অসুখী দেশীয় ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সাধুগুরুদের জীবনাদর্শের গুরুত্ব অনুধাবন করা এবং তা প্রচার করে বিশ্বশান্তি অর্জনের পথ প্রতিষ্ঠা করা। সাধুগুরুরা অতি নীরবে নিজ জীবনে এবং তার নিজ সমাজে শান্তি প্রতিষ্ঠার কাজে সফল হয়েছেন_ এ খবর জানিয়ে দেওয়াও আমাদের কর্তব্য বৈকি।
হ কলেজপাড়া, আলমডাঙ্গা, চুয়াডাঙ্গা

No comments

Powered by Blogger.