স্মৃতিময় ১৫ অক্টোবর by তরুণ কান্তি শিকদার

৯২১ সালের ১ জুলাই যে তিনটি আবাসিক হল নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারোদ্ঘাটন করা হয়েছিল জগন্নাথ হল এর মধ্যে অন্যতম। বাকি দুটি হলো ঢাকা হল ও মুসলিম হল। জগন্নাথ হলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছাত্ররা এসে আবাসিক সুবিধা গ্রহণ করত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ৯০ বছরে অসংখ্য গুণী ও কৃতী ছাত্র জগন্নাথ হল থেকে বেরিয়েছেন, যারা সমাজের বিভিন্ন স্তরে বিশেষ অবদানের স্বাক্ষর রেখেছেন।


আশির দশকে নিজেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে পেরে আমি গৌরবান্বিত। ১৯৮১-৯০ পর্যন্ত দীর্ঘ সময় জগন্নাথ হল চত্বরে কেটেছে এক বর্ণিল সময়। অসংখ্য সুখস্মৃতির মধ্যে ১৯৮৫ সালের ১৫ অক্টোবর এক দুঃসহ বিভীষিকাময় রাত। স্মৃতির মণিকোঠায় এখনও কাঁটার মতো বিঁধে আছে। কালের গর্ভে অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও এ দিনটি দুঃসহ বেদনায় অমলিন। শিউলি ফুলের কোমল পাপড়ি আর আশ্বিনের দূর্বাঘাসের ওপর শিশির বিন্দুতে ভর করে প্রকৃতিতে আসছে শীতের হাওয়া। মহালয়ার আগমনীর মাঝে মা দুর্গার আগমনী বার্তাও ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু কে জানত মহাময়ীর আগমনের আগেই ৩৯টি তাজা প্রাণের স্বপ্ন মুছে যাবে। মায়ের বুক খালি করে চলে যাবে এতগুলো সম্ভাবনাময় জীবন।
অ্যাসেম্বলি হলের তখন সংস্কারকাজ চলছিল। একটু আগেই টিভি দেখব বলে ওই ভবনের দিকে যাই। কিন্তু টিভি রুম বন্ধ দেখে রুমে ফিরে আসি। রুমে এসে কিছু কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। কারণ বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি হয়েছে, বাড়ি যেতে হবে। এমন সময় একটা দমকা বাতাসে পূর্ব ভবনের সব জানালা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় প্রচণ্ড শব্দ হলো। ঠিক তার এক থেকে দুই মিনিট পর আরেকটা শব্দ কানে ভেসে এলো। কৌতূহলী হয়ে ১৭নং পূর্ব ভবনের রুম থেকে বের হয়ে গেটের দিকে এগিয়ে যাই। দেখি রুমমেট প্রভাস সাহা মাথায় ইট-বালু মেশানো রক্ত নিয়ে রুমের দিকে আসছে। বলল, তাড়াতাড়ি যাও, অ্যাসেম্বলি হলের ছাদ ভেঙে পড়েছে।
এক দৌড়ে টিভি রুমের গেটে গিয়ে দেখি চারদিকে নিস্তব্ধ অন্ধকার। হলের দরজা দিয়ে মেঘলা আকাশ দেখা যাচ্ছে। ভয়ে দৌড়ে বের হয়ে আসি। শুরু হয় চিৎকার-চেঁচামেচি। রাত তখন ৯টা ৪০। টিভিতে সবাই শুকতারা নাটক দেখছিল। হঠাৎ করে পুরনো ছাদ ভার বহন করতে না পেরে ধসে পড়ে। এরপর সবাই মিলে শতাধিক বন্ধুর মৃত-অর্ধমৃত অবসন্ন দেহ উদ্ধার করতে রাত ১টা বেজে যায়। ছুটে আসে ঢাকা শহরের সব শ্রেণীর মানুষ। বিপদ বাঙালিকে সব শত্রুতা ভুলে কাছে টেনে নেয়। হাজার হাজার মানুষের ঢল উদ্ধারকাজকে বিঘি্নত করে। পুলিশ, আর্মি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছুটে আসে। রাত ৩টার মধ্যে ৩৭টি মৃতদেহ জগন্নাথ হল শহীদ মিনারের পাদদেশে শায়িত করা হয়। সরকারিভাবে ছাত্রদের খুশি করার জন্য লাশ হেলিকপ্টারযোগে বাড়িতে পাঠানো হয়। নগদ এক লাখ টাকা করে প্রতিটি পরিবারকে দেওয়া হয়। পরে আরও দু'জন মারা যায়। এসব কথা সবার জানা।
২৫ বছর অতিবাহিত হয়েছে। আমাদের নির্মম অব্যবস্থার শিকার যে ৩৯টি পরিবার, তাদের একবারও কি খোঁজ নিতে পেরেছি? বিশ্ববিদ্যালয় কি একটি টিম পাঠিয়েছে মৃতের মা-বাবা বা স্বজনদের সান্ত্বনা দিতে? আমার জানা নেই। দিনের পর দিন চলে যায়। হারিয়ে যায় দুঃখময় স্মৃতিগুলো। নতুন তথ্য পুরনো যন্ত্রণা মুছে দেয়। তাই তো আমরা বেঁচে থাকি। কিন্তু আমাদের সামাজিক দায়বদ্ধতা কি দুঃখময় স্মৃতিগুলোকে ধারণ করে এই পরিবারগুলোর সঙ্গে একটা নিবিড় সম্পর্কের বন্ধন তৈরি করতে পারে না?

ড. তরুণ কান্তি শিকদার : উপসচিব পরিচালক, পরিবেশ অধিদফতর খুলনা
 

No comments

Powered by Blogger.