ধর নির্ভয় গান-আশ্বিনেরই আঙিনায় by আলী যাকের

শ্বিনেরই আঙিনায় এক খ্যাপা শ্রাবণ নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের নীতি ও আদর্শবিরোধী এই চক্র। তবে তাদের মনে রাখা উচিত, আশ্বিন মাসে যে খ্যাপা শ্রাবণ আসে তার উন্মাদনা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। অচিরেই আসছে হেমন্ত। চারদিক সোনার ফসলে ভরে উঠবে। বাংলার মানুষ তখন নবান্নের এই ফসল ঘরে তোলার জন্য হয়ে থাকবে উন্মুখ। কোনো রাজনীতিবিদের কোনো অপপ্রচারে কান দেওয়ার প্রবৃত্তি তাদের থাকবে না


আবার এসেছে শরৎ। মাথার ওপরে নীল আকাশ। ভেসে যাচ্ছে সাদা মেঘের ভেলা। ক'দিন আগেই হয়ে গেল দুর্গাপূজা, শারদোৎসব। তারই ঢাকঢাক, দ্রিম দ্রিম শব্দ এখনও কানে বাজছে যেন। আমি বাংলার সব ঋতুকেই কমবেশি ভালোবাসি। বর্ষাকালকে তো বটেই। যখন অঝোর ধারায় আকাশ ভেঙে নেমে আসে জল। আমার মন উদ্বেলিত হয়ে ওঠে। তবে শরৎ এলেই চারদিক উজ্জ্বল হয়ে যায়। কালো মেঘের ভ্রূকুটি থাকে। সব অন্ধকার উদ্ভাসিত হয় সোনার আলোয়। অবশ্য এই আশ্বিনে মাঝে মধ্যে উদ্দাম বৃষ্টি নামে উষ্ণ ধরণীর বুকের ওপর। অবাক হয়ে যাই। শরতেও বৃষ্টি? হঠাৎই রবীন্দ্রনাথকে মনে পড়ে। অমন বিশাল মাপের স্রষ্টা না হলে এমন গানের কলি কোথায় পেতাম? 'আশ্বিনেরই আঙিনায় কোন ক্ষ্যাপা শ্রাবণ ছুটে এলো, দুলিয়ে জটা ঘনঘটা পাগল হাওয়ার গান সে গায়!' শরতের শুরু ভাদ্র মাসে। তখন থেকেই আমরা নীল আকাশ আর সাদা মেঘের ভেলা লক্ষ্য করি। যদিও শরতের এই আলো সঙ্গে করে নিয়ে আসে প্রচণ্ড উত্তাপ। একেবারে প্রাণ আইঢাই করে। বর্ষা শেষে শরতের আগমন বলে আবহাওয়ায় জলীয় বাষ্পের আধিক্য আমাদের অস্থির করে তোলে। ঘরের বাইরে সামান্য পরিশ্রমেই গলদঘর্ম হয়ে উঠতে হয়। কথায় আছে, ভাদ্র মাসের গরমে তাল পাকে। ঠিক যেমন জ্যৈষ্ঠ মাসের গরমে পাকে কাঁঠাল। রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, আশ্বিনে ক্ষ্যাপা শ্রাবণের আগমনের কথা। আমাদের সমাজেও বৃষ্টি থেমে গিয়ে চারদিক যখন হয়ে ওঠে রৌদ্রোজ্জ্বল, তখন নানারকম খ্যাপামি আমরা দেখতে পাই। আক্ষরিক অর্থেই আমাদের মেজাজ হয়ে যায় গরম, সব ভব্যতা নিমেষে হয় উধাও। আমরা আপসহীনভাবে নানারকম কথার স্টম্ফুলিঙ্গ ছুটতে দেখি আমাদের চারধারে। সে রকমই একটি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে আমাদের দেশে এখন। আমাদের রাজনীতিতে ধ্বজাধারী যে দুই দল, তার মধ্যে বিরোধীপ্রবররা বলছেন, কানে ধরে ক্ষমতাসীনদের তারা আসন থেকে নামিয়ে দেবেন। ক্ষমতায় যারা, তারা আকারে-ইঙ্গিতে বলছেন, নামান তো দেখি? আমাদের এমনই দুর্ভাগ্য যে, একটি সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যখন দেশটি স্বাধীন হলো, তারপর থেকে রাজনৈতিকভাবে কখনোই স্বস্তি পাইনি আমরা। হত্যা, প্রাসাদ চক্রান্ত, উর্দিধারীদের দৌরাত্ম্য আমাদের প্রাণকে ওষ্ঠাগত করে তুলছে। অথচ এর সঙ্গে আমাদের সাধারণ মানুষের কোনোই সম্পর্ক নেই। আমরা প্রতিনিয়ত একে ধরছি, ওকে মারছি! আমরা ভেবেছিলাম যে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে রাজনীতির পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে হয়তো আস্তে আস্তে গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে আমরা একটি সহনশীল, গণতান্ত্রিক এবং জনমুখী রাজনৈতিক ব্যবস্থা কায়েম করতে পারব। কিন্তু কাকস্য পরিবেদন। দীর্ঘদিন ধরে স্বৈরাচারী সরকারের অধীনে থাকলে ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদদের মধ্যেও এক ধরনের অসহিষুষ্ণতা বাসা বাঁধে। এটাই স্বাভাবিক ছিল যে, এই দেশের দুই বৃহৎ দল নিজ নিজ রাজনৈতিক এজেন্ডা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে একটি সুস্থ গণসম্পৃক্ত রাজনীতির ধারার সৃষ্টি করবে। কিন্তু আমাদের জীবদ্দশায় আমরা এই সুস্থির অবস্থাটি দেখে যেতে পারব বলে বোধ হচ্ছে না। আমি অবশ্য দু'দলের প্রতি মোটামুটি সমান সহনশীলতা নিয়ে তাদের রাজনীতির পর্যালোচনা করতে যদিও রাজি আছি, তবুও এই দুই দলের মধ্যে একটির জন্মই যে হয়েছে আদর্শচ্যুতির মাধ্যমে, যে আদর্শের জন্য ৩০ লাখ বাঙালি আত্মাহুতি দিয়েছিল ১৯৭১-এ তাকে সমর্থন জানাতে দ্বিধাবোধ করি। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে প্রথমেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের স্লোগান, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যে সরকার মুজিবনগরে অধিষ্ঠিত ছিল তার প্রতি সমর্থন, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় যে বিকল্পহীন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচনা করা হয়েছিল তার প্রতি আনুগত্য, জাতির পিতার স্বীকৃতি এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতাকারী জামায়াত-শিবিরকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করার সিদ্ধান্তের প্রতি আনুগত্য_ এসব মৌল বিষয়ে দ্বিধাহীনভাবে সমর্থন জানাতে হবে। এরপরে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে কী করা যায় সে সম্বন্ধে তাদের সুচিন্তিত অভিমত দিলে পরে তাহলেই কেবল আমরা ভেবে দেখব যে ওই দল অথবা গোষ্ঠীকে সমর্থন দেওয়া যায় কি-না।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, যে দল বা গোষ্ঠীর কথা এখানে উল্লেখ করলাম, তাদের প্রতিষ্ঠাতা কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন এবং প্রবাসী সরকারের অনুশাসন অনুযায়ী একটি ডিভিশন কমান্ডার হিসেবে মুজিবনগর সরকারের কাছ থেকে অন্যান্য কমান্ডারের মতোই প্রতি মাসে মাসোয়ারা গ্রহণ করতেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত ছিলেন এবং এ সম্বন্ধে আমরা অধুনা বিলুপ্ত বিচিত্রায় তার লেখা স্তুতিবাক্যও পাঠ করেছি। তিনি তার অধীনে যুদ্ধরত সৈনিকদের কখনোই বলেননি বাংলাদেশবিরোধী রাজাকার, আলবদর, আলশামসের প্রতি ক্ষমা প্রদর্শন করতে। তিনি বৈদ্যনাথতলায় পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণার প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। আমরা সকলেই জানি যে, ওই ঘোষণাপত্রকে যদি আমরা অস্বীকার করি তাহলে আমাদের দেশের জন্ম নিয়েই বিতর্ক থেকে যায়। এ রকম একটি বিষয়ে কেউ সমর্থন দিতে পারে না। হ্যাঁ পারে, যারা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ বেরিয়ে এসেছে বলে মর্মপীড়ায় ভুগছেন অথবা যারা নব্য পাকিস্তানি। অথচ আমরা দেখছি যে, বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে এই পর্যন্ত অধিকাংশ সময় এই বাংলাদেশবিরোধী শক্তিটি ক্ষমতায় থাকার ফলে গোয়েবলসীয় পদ্ধতিতে মিথ্যা বলতে বলতে সেটিকেই সত্য বলে প্রায় প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। তাদের নেতা সম্প্রতি জনসভায় বলছেন, যুদ্ধাপরাধ থেকে তাদের সাঙ্গাত জামায়াত এবং শিবিরকে অব্যাহতি দিতে। তাহলে তো আর বাংলাদেশে একজনও যুদ্ধাপরাধী নেই বলেই ধরে নিতে হবে! আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নই। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে, একজন শব্দসৈনিক হিসেবে, আমৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কথা বলে যাব এবং এই চেতনার যারা বিরোধী তাদের সজ্ঞানে কখনোই সমর্থন করব না। ওই গোষ্ঠীর নেতা সম্প্রতি নানা জনসভায় এ কথাও বলেছেন যে, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর নেতার মুসলমানিত্ব নিয়ে সন্দেহ আছে। এই রাজনীতি ওই জোটের আদর্শ পাকিস্তানি শাসকদের কাছ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে ধার করে নেওয়া। পাকিস্তানিরাও ঠিক একইভাবে কোনো রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক কিংবা অর্থনৈতিক দাবি উঠলেই বলতেন, 'ইসলাম খাতরে মে হ্যায়।' এই জোট এও বলেছে যে, তারা ক্ষমতায় এলে তরুণদের কাছে বাংলাদেশের শাসনভার ছেড়ে দেবেন। আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করে, এই তরুণ কারা? এরা কি তারা, যারা তাদের শাসনামলে একটি বিশেষ ভবন থেকে তাদের অপশাসন, দুর্নীতি, গণহত্যার সুপরিকল্পিত নকশা বাস্তবায়নের চেষ্টায় ছিলেন? আমি বিশ্বাস করি না যে, একমাত্র কোনো একটি বয়সের জনগোষ্ঠী দেশকে অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে। বিশ্বের সর্বত্র আমরা তরুণ-প্রবীণের সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে একটি সমাজ এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে দেখি। আমি আরও বিশ্বাস করি যে, যেসব তরুণ এখনও কোনো দলীয় রাজনীতিতে উদ্যোগী না হয়ে তাদের মেধা, মনন এবং সদিচ্ছার দ্বারা দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করে যাচ্ছে অথবা কাজ করার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, সেসব তরুণকেই আমাদের প্রয়োজন। তবে তরুণ-প্রবীণ সমন্বয়টি ভুললে চলবে না। তারা আরও বলেছেন যে, তারা ক্ষমতায় গেলে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ করবেন। এর অর্থ কি এই যে, তারা ওই তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে '৭১-এর মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করে আবার রাজাকার, আলবদর, আলশামস তথা জামায়াত-শিবিরশাসিত মিনি পাকিস্তানে পরিণত করবে এই দেশকে?
আমরা জানি যে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বিদ্যুতের অভাব, সড়ক পরিবহনে অব্যবস্থা, জ্বালানির সংকট, মুদ্রাস্টম্ফীতি ইত্যাদি আমাদের মধ্যবিত্তের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। এ বিষয়ে সরকারকে অবশ্যই আমরা সমালোচনা করতে পারি এবং করবও। তবে তা বাস্তবের আলোকে। আমরা দেখার চেষ্টা করি যে, এসব ঘটনা যে ঘটছে, এই যে মূল্যবৃদ্ধি বা মুদ্রাস্টম্ফীতি বা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সামগ্রীর অভাব, এর আসল কারণটি কী? অস্বীকার করার উপায় কি আছে যে, আজকের সারাবিশ্বের অর্থনীতিতে এক মন্দা পরিস্থিতি বিরাজ করছে? যার প্রভাব আমাদের অর্থনীতিকেও চরমভাবে আক্রান্ত করছে? বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচুর্যময় দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আজ বেকারত্ব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯.১০ শতাংশে? তাদের মুদ্রাস্টম্ফীতি গত আগস্টে ছিল ৩.৫ শতাংশ? বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং ধনী শেয়ারবাজার নিউইয়র্কের ওয়ালস্ট্রিটে নেমেছে ধস? সবচেয়ে বড় কথা এই, যারা আজ সব অব্যবস্থার জন্য সরকার বদলের আন্দোলনে নেমেছেন, তারা বাংলাদেশের জন্মের পর থেকে বেশিরভাগ সময় ক্ষমতায় ছিলেন। প্রতিবারই ক্ষমতায় এসেছেন ওই অব্যবস্থার অভিযোগ তুলে। কিন্তু কোনোবারই ক্ষমতায় এসে কোনো একটি বিষয়ে কখনও কি তারা উন্নতি করতে পেরেছেন? সব বিষয়ে কেবল অবনতিই হয়েছে। বস্তুতপক্ষে ক্ষমতায় থাকাকালে তারা কখনোই ধর্ম, ভারতীয় আগ্রাসন, ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন ইত্যাকার বিষয়ে টুঁ শব্দটিও করেননি। আজ যা ইচ্ছা তা-ই বললেই কি তাদের সব কথা আমাদের মেনে নিতে হবে?
আশ্বিনেরই আঙিনায় এক খ্যাপা শ্রাবণ নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন বস্তুতপক্ষে বাংলাদেশের নীতি ও আদর্শবিরোধী এই চক্র। তবে তাদের মনে রাখা উচিত, আশ্বিন মাসে যে খ্যাপা শ্রাবণ আসে তার উন্মাদনা অত্যন্ত ক্ষণস্থায়ী। অচিরেই আসছে হেমন্ত। চারদিক সোনার ফসলে ভরে উঠবে। বাংলার মানুষ তখন নবান্নের এই ফসল ঘরে তোলার জন্য হয়ে থাকবে উন্মুখ। কোনো রাজনীতিবিদের কোনো অপপ্রচারে কান দেওয়ার প্রবৃত্তি তাদের থাকবে না। একই সঙ্গে আমি আজকের ক্ষমতাসীনদের প্রতি আবেদন জানাতে চাই, উন্নয়নের যেসব বিষয়ে আপনারা যা যা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর করুন। তাদের বলুন এবং বস্তুতপক্ষে সময় নির্ধারণ করে দিন যে কতদিনের মধ্যে আমাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা আপনারা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবেন। তাহলে অসময়ে খ্যাপা শ্রাবণ আসবে, যাবে। কিন্তু এই ক্ষণস্থায়ী আক্রমণে মানুষকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হবে না।

আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
 

No comments

Powered by Blogger.