মিডিয়া ভাবনা-সংবাদপত্রের প্রথম সংস্করণ ও টিভির টক শো by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

মাদের কেন্দ্রীয় (ঢাকার) সংবাদপত্রগুলো ক্রমশ আধুনিক ও সমৃদ্ধ হয়ে উঠছে। পৃঠাসংখ্যা বাড়ছে। বৈচিত্র্যময় রিপোর্ট, ফিচার ও কলাম প্রকাশিত হচ্ছে। সবচেয়ে বড় কথা, সংবাদপত্রের পাঠক বাড়ছে। পাঠকের নানা চাহিদাও বাড়ছে। একসময় কেন্দ্রীয় (ঢাকার) সংবাদপত্রগুলো জেলা শহর, শহরতলিতে পৌঁছাত প্রায় দুপুর বা বিকেলের দিকে। এখন সেই দিন আর নেই। কেন্দ্রীয় সংবাদপত্রগুলোর ‘প্রথম সংস্করণ’ আগেভাগে ছাপিয়ে দ্রুত বিভিন্ন জেলা শহরের


দিকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে কাকভোরে ঢাকার সংবাদপত্র বিভিন্ন জেলা শহরের পাঠকেরা এখন পড়ার সুযোগ পায়। কিন্তু ‘প্রথম সংস্করণ’ পত্রিকা ছাপাতে গিয়ে অনেক সময় কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর বাদ পড়ে যায়। কারণ, সব খবর বিস্তারিত ছাপাতে গেলে জেলা শহরে কাকভোরে পত্রিকা পৌঁছানো সম্ভব হবে না। সেটাও কাম্য নয়। আবার কোনো খবর থেকে জেলা শহরের পাঠকদের বঞ্চিত করাও উচিত নয়।
বাংলাদেশ ছোট দেশ বলে রক্ষা। ভারতের মতো বড় দেশ হলে আরও নানা সমস্যা হতো। আমি একবার (১৯৭৮) দিল্লিতে টাইমস অব ইন্ডিয়ার প্রথম সংস্করণ ছাপা হতে দেখেছি বিকেল চারটায়। আলাপ করে জানতে পেরেছিলাম, রাত দুইটা পর্যন্ত পত্রিকাটির চারটি সংস্করণ ছাপা হবে, যা ট্রেন বা বাসযোগে ভারতবর্ষের বিভিন্ন রাজ্যে পাঠানো হবে। দিল্লির পাঠকেরা যে পত্রিকাটি হাতে পায়, তা ছাপা শুরু হয় রাত তিনটারও পর। বলা বাহুল্য, বিকেল চারটায় ছাপা পত্রিকা আর রাত তিনটায় ছাপা পত্রিকার কয়েকটি পৃষ্ঠায় ব্যাপক গরমিল থাকে। অথচ দুটোই একই তারিখের পত্রিকা। ভারতের পাঠকদের সৌভাগ্য, এখন প্রযুক্তির ও পুঁজির বিরাট অগ্রগতি হয়েছে। বহু পত্রিকা একই সঙ্গে বহু রাজ্যে, এমনকি একই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় ছাপা হচ্ছে। ১৯৭৮ সালে এই সুযোগ ছিল না।
বাংলাদেশে বহুদিন যাবৎ জনকণ্ঠ আর সম্প্রতি প্রথম আলো, ডেইলি স্টার ও করতোয়া ঢাকার বাইরে অন্য জেলায়ও ছাপা হচ্ছে। এটাও এক বিরাট অগ্রগতি।
কিন্তু একটা সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। কিছু খবর ঢাকার বাইরের পাঠকেরা পাচ্ছে না। তারা যে পাচ্ছে না, তাও তারা জানতে পারছে না। যদি না তারা একই তারিখের ঢাকা ও জেলা শহরের পত্রিকা পড়ার সুযোগ পায়।
কয়েক দিন আগেও (২৩ ডিসেম্বর) ঢাকার একটি পত্রিকায় আমি এমন একটি খবর পড়েছি, চট্টগ্রামে বিক্রীত একই পত্রিকায় ওই খবরটির মাত্র ২৫ শতাংশ ছাপা হয়েছে। (প্রথম আলো নয়) প্রথম সংস্করণে খবরটির গুরুত্বপূর্ণ অংশই ছাপা হয়নি, যা খবরটির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মহলকে খুবই ক্ষুব্ধ করেছে। খবরটি ছিল ওই পত্রিকারই একটি খবরের প্রতিবাদ। প্রতিবাদের ২৫ শতাংশ ছাপা হয়েছে সারা দেশে প্রচারিত পত্রিকার সংস্করণে। আর পূর্ণ বিবরণ ছাপা হয়েছে শুধু ঢাকার সংস্করণে। এখন দেখা যাচ্ছে, আগের দিনের ‘ভুল ও অসত্য’ খবরটি সারা দেশে প্রচারিত হয়েছে, আর পরদিন প্রতিবাদ অংশটি প্রচারিত হয়েছে ঢাকায়। তাতে কী দাঁড়াল? সারা দেশের পাঠকের কাছে কি ‘ভুল ও অসত্য’ খবরটির প্রতিবাদ ও প্রকৃত তথ্য পৌঁছাল? পৌঁছায়নি। এই যে সংবাদপত্রের দায়িত্বহীনতা ও অপেশাদারিত্ব, এর জবাব কে দেবে? এর দায়িত্ব কে নেবে?
সংবাদপত্রের দুটি সংস্করণ প্রকাশ করতে হলে অনেক সময় (সব সময় নয়) কিছু খবর ও ছবি বাদ দিতেই হবে বা সংক্ষিপ্ত করতে হবে। এ ছাড়া উপায় থাকে না। পাঠককে এই সীমাবদ্ধতাটুকু বুঝতে হবে। কিন্তু এখানে সংবাদপত্র সম্পাদকের কিছুটা দায়িত্ব রয়েছে। সম্পাদক (বা বার্তা সম্পাদক) কোন খবরটি বাদ দেবেন বা সংক্ষিপ্ত করবেন? আমাদের মতে, সবচেয়ে নিরীহ খবরটিই বাদ দিতে পারেন বা সংক্ষিপ্ত করতে পারেন। যে খবরে তেমন কোনো স্বার্থ জড়িত নয়। কিন্তু ওই পত্রিকারই ভুল খবরের প্রতিবাদে ‘প্রকৃত তথ্য’ পাওয়া গেলে তা কি বাদ দেওয়া সমীচীন হবে? যদি না সম্পাদকের কোনো কুমতলব না থাকে? (অনেক সময় অনেক পত্রিকার সম্পাদক নানা এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে ভুল তথ্যসংবলিত খবর প্রকাশ করেন, যা হলুদ সাংবাদিকতারই নামান্তর)
ঢাকার বাইরে সব দৈনিক পত্রিকারই বিরাট পাঠক গোষ্ঠী রয়েছে। এ ব্যাপারে তাদের সচেতন হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। ঢাকার বাইরে থাকে বলে তারা ঢাকার পত্রিকার একটা অসম্পূর্ণ সংস্করণ পাবে, এটা মেনে নেওয়া উচিত হবে না। এ ব্যাপারে একটা সুচিন্তিত নীতিমালা থাকা দরকার।
আমি আগেই বলেছি, সংবাদপত্রের দুটি সংস্করণ ছাপালে প্রথম পৃষ্ঠার কোনো কোনো খবর বা ছবি বাদ দিতে হবে, কোনো খবর সংক্ষিপ্ত করতে হবে। এ ছাড়া কোনো উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তাব হবে: যে খবরটি সংক্ষিপ্ত ছাপা হয়েছে, তার নিচে ‘সংক্ষেপিত’ কথাটি দিলে ভালো হয়। আগ্রহী পাঠক ‘নেট সংস্করণে’ পূর্ণাঙ্গ খবরটি পড়ে নিতে পারবে। বা অন্য কোনো উপায়ে ঢাকার সংস্করণ সংগ্রহ করে পড়ে নেবে। মনে রাখা দরকার, সব খবরের প্রতি সব পাঠকের সমান আগ্রহ থাকে না। পাঠকের একটা নিজস্ব খবর নির্বাচন পদ্ধতি থাকে।
অন্য কোনো উপায়ে যদি এই সমস্যার সমাধান করা যায়, তাও আগ্রহী পাঠকেরা প্রস্তাব করতে পারেন। এখন যেভাবে হচ্ছে, তা মেনে নেওয়া যায় না।
এর সঙ্গে আরও কয়েকটি সমস্যাও যুক্ত রয়েছে। যেমন: কোনো ‘খবর’ যদি কোনো মামলা-মোকদ্দমার প্রমাণ হিসেবে বিবেচিত হয়, তাহলে অপর পক্ষের উকিল বলবেন, ‘ওই দিনের ওই সংবাদপত্রে এ রকম কোনো খবরই প্রকাশিত হয়নি।’ একই তারিখের পত্রিকা যদি দুই রকম হয়, তাহলে এমন কথা তো উঠতেই পারে। এ ক্ষেত্রে মান্যবর বিচারক কোন ‘প্রমাণকে’ গ্রহণ করবেন?
সংবাদপত্র নিয়ে নানা গবেষণা হয়। গবেষণার উপকরণ হিসেবেও সংবাদপত্র ব্যবহূত হয়। একই তারিখের দুই রকম সংবাদপত্র প্রকাশিত হলে ভবিষ্যতে গবেষকদেরও নানা বিভ্রান্তিতে পড়তে হবে।
আমার নিজের ধারণা, আমাদের সংবাদপত্রে বাহুল্য কথা লেখার প্রবণতা বেশি। রাজনৈতিক সংবাদে এত নেতা, পাতিনেতার নাম ছাপানোর কোনো প্রয়োজন দেখি না। তাঁদের অনেকে মোটেও গুরুত্বপূর্ণ লোক নন। অথচ এ ধরনের লোকদের বক্তৃতা বা বিবৃতি সংবাদপত্রে প্রায় প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে। হরতালের যে ঘণ্টাওয়ারি ও এলাকাভিত্তিক বিস্তারিত বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়, তা খুব কম পাঠককেই আকর্ষণ করে। হরতালের খবরের জন্য সংবাদপত্রের এত মূল্যবান জায়গা ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়।
সংবাদপত্রের দুই সংস্করণের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেও খবর বাদ দেওয়া বা সংক্ষেপ করার একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রতিটি সংবাদপত্রের দায়িত্ব।

টক শো ও প্রযুক্তি
পাঠক জানেন, এখন বাংলাদেশে টিভি অনুষ্ঠানের মধ্যে ‘টক শো’ জনপ্রিয়। কত দিন এই জনপ্রিয়তা ধরে রাখা যাবে, তা বলতে পারি না। তবে এটুকু বলতে পারি, যারা টক শো পছন্দ করেন না, তাঁদেরও অনেকে নিয়মিত টক শো দেখেন। এটা একটা নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
টক শো নিয়ে আরও ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে, প্রযুক্তি ব্যবহার করে টক শোগুলো আরও বৈচিত্র্যময় ও সমৃদ্ধ করতে পারা যায়। আনন্দের বিষয়, নতুন চালু হওয়া কয়েকটি টিভি চ্যানেল টক শোতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে সাফল্যের পরিচয় দিয়েছে। এই প্রযুক্তি হলো: স্টুডিওর আলোচনার পাশাপাশি আরও নানা স্থান থেকে এমনকি অন্য জেলা থেকেও আলোচকেরা আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন। এর ফলে নিঃসন্দেহে টিভি টক শোর গুরুত্ব অনেক গুণ বেড়ে গেছে। তবে প্রযুক্তির অভাবে সব টিভি চ্যানেল এখনো তা করতে পারেনি। দু-একটি চ্যানেল পেরেছে।
টিভির টক শোগুলো বড্ড বেশি ঢাকাকেন্দ্রিক। যেমন বিষয়বস্তুতে, তেমনি আলোচক নির্বাচনেও। হয়তো সময়স্বল্পতার কারণে সব সময় ঢাকার বাইরে থেকে আলোচক বা বিশেষজ্ঞ আমন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না। তবে সপ্তাহে অন্তত এক-দুই দিন ঢাকার বাইরে থেকে আলোচক আমন্ত্রণ করলে ভালো হতো। তবে এ ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি একটা বড় সহায় হতে পারে। একই অনুষ্ঠানে ঢাকা ও অন্য জেলার আলোচকেরা নিজ নিজ শহরে বসেও আলোচনায় অংশ নিতে পারবেন।
আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোকে আরও একটি প্রযুক্তির কথাও ভাবতে হবে। যে প্রযুক্তি বাজারে রয়েছে। তা হলো: টক শোতে প্রবাসী বাংলাদেশি বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের স্কাইপের মাধ্যমে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা। পৃথিবীজুড়ে এটা করতে হবে, এমন নয়। তবে লন্ডন, নিউইয়র্ক, টরন্টো—এ রকম কয়েকটি শহর দিয়ে এটা শুরু করা যায়। পরে অন্যান্য দেশে ও শহরেও সম্প্রসারণ করা যায়। এই প্রযুক্তিও বিরাট কিছু নয়। আশা করি, টিভি চ্যানেলগুলো ২০১২ সালে এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করে বৈচিত্র্যময় টক শোর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবে।
টক শো নিয়ে দর্শকদের অনেক সমালোচনার কথা শুনি। টিভি কর্তৃপক্ষের উচিত এসব সমালোচনা শোনা। সম্ভব হলে টক শোর দুর্বলতাগুলো দূর করা দরকার। টক শো নিজ গুণেই তার কার্যকারিতা প্রমাণ করেছে। এখন উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ও দর্শকদের সমালোচনা শুনে কিছু দুর্বলতা দূর করতে পারলে আমাদের টিভি টক শো আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত হতে পারবে। সেটা কোনো অসম্ভব কাজ নয়।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়ন কর্মী।

No comments

Powered by Blogger.