আফজল পরিবারের চার প্রার্থী-ঘর না গুছিয়ে নির্বাচনে নেমেছে আওয়ামী লীগ by আনোয়ার হোসেন ও গাজীউল হক

প্রথমবার অনুষ্ঠেয় সিটি নির্বাচনে ঘর না গুছিয়েই মেয়র পদে আফজল খানকে দলীয় সমর্থন দিয়ে মাঠে নেমেছে কুমিল্লা আওয়ামী লীগ। দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটি গত ছয় বছরেও নির্বাচিত কমিটি করতে পারেনি। শহর আওয়ামী লীগ ও যুবলীগ চলছে এক যুগেরও বেশি পুরোনো কমিটি দিয়ে। আহ্বায়ক কমিটি নিয়ে ছয় বছর ধরে চলছে স্বেচ্ছাসেবক লীগ। দলের ভেতরে যথাসময়ে নেতা নির্বাচন করতে না পারার খেসারত সিটি নির্বাচনে


দিতে হতে পারে বলে মনে করছেন মাঠপর্যায়ের কর্মীরা। এরই মধ্যে দলের দুজন বিদ্রোহী প্রার্থী মেয়র পদে নির্বাচন করছেন। দল ও সহযোগী সংগঠনের কমিটি না হওয়ায় এই দুজন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা হয়েই রয়ে গেছেন।
এ ছাড়া আফজল খানের মেয়েসহ চারজন ঘনিষ্ঠ আত্মীয় লড়ছেন কাউন্সিলর পদে। স্থানীয় একাধিক নেতা, ভোটার ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, সিটি নির্বাচন নিয়ে কেন্দ্র ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের লক্ষ্য, কৌশল ও কর্মসূচি নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।
জানা গেছে, ১৯৯৫ সালের পর থেকে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাচিত কমিটি নেই। ২০০৬ সালে আ হ ম মুস্তফা কামালের নেতৃত্বে আহ্বায়ক কমিটি করা হয়। এই কমিটি এত বছরেও নির্বাচন করতে পারেনি। ১৯৯৭ সালে যুবলীগের সর্বশেষ কমিটি হয়েছিল। স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক কমিটি হয় ২০০৬ সালে। ২০০৩ সালের পর একমাত্র ছাত্রলীগের আংশিক কমিটি হয় গত জুন মাসে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় এবং বিভক্তির কারণে এই কমিটির নেতারাও নানা পক্ষে বিভক্ত।
নির্বাচনে ১৫ সদস্যের আংশিক কমিটির সাধারণ সম্পাদকসহ ছয়জন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী আনিসুর রহমানের পক্ষে মাঠে নেমেছেন। সভাপতিসহ তিনজন আফজল খান এবং দুজন আরেক বিদ্রোহী প্রার্থী নূর-উর রহমান মাহমুদের পক্ষে নির্বাচন করছেন। বাকি দুজন সিটি নির্বাচনে নিষ্ক্রিয়।
আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের একাধিক নেতা জানান, বিদ্রোহী মেয়র পদপ্রার্থী নূর-উর রহমান মাহমুদ ও আনিসুর রহমান—দুজনই ছাত্রলীগের সাবেক নেতা। দীর্ঘদিন ধরে সম্মেলন না হওয়ায় তাঁরা ছাত্ররাজনীতির পর দলের মূল ধারায় ফিরতে পারেননি। আহ্বায়ক কমিটিতেও দলীয় পদ-পদবি পাননি তাঁরা। এ ক্ষোভ থেকেই তাঁরা দল-সমর্থিত প্রার্থীর বিপরীতে গিয়ে মেয়র পদে দাঁড়িয়েছেন।
নূর-উর রহমান মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, দলের দ্বিধাবিভক্তির মূল কারণ নতুন নেতৃত্ব তৈরি না হওয়া। ইচ্ছা করেই সম্মেলন করা হয় না। কয়েকজন সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চান বলেই কিছু হয় না।
আনিসুর রহমান বলেন, কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি নিয়মিত হলে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হতো। কিন্তু এটা অনেকেই চান না। এ জন্য এখানে দলে হ-য-ব-র-ল অবস্থা। যাকে দলীয় সমর্থন দেওয়া হয়েছে, সবাই জানে তাঁর পরাজয় হবে।
জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি ও কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল-মাহমুদ বলেন, সময়মতো কমিটি না করার কারণে গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব তৈরির ক্ষেত্রে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, যে কারণে দল সংগঠিত নয়। এর প্রভাব পড়ছে সিটি নির্বাচনে।
দলীয় সূত্র জানায়, সদরে আফজল খান এবং আ ক ম বাহাউদ্দিনের মধ্যে দীর্ঘদিনের দ্বন্দ্বের সুযোগে কুমিল্লার রাজনীতি শহরের বাইরের দুই নেতা আ হ ম মুস্তফা কামাল ও হুইপ মো. মুজিবুল হকের নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। সিটি এলাকায় তাই আওয়ামী লীগ সাংগঠনিকভাবে অনেকটা দুর্বল। নির্বাচনে এর প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন দলের অনেক নেতা-কর্মী।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের কমিটি হয়ে যাবে। ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে থাকলেও ভোটার ওদের সঙ্গে নেই। তিনি দাবি করেন, নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী করার জন্য তিনি নিজে ২৩টি ওয়ার্ডের দায়িত্ব নেবেন। আর আ ক ম বাহাউদ্দিনকে ২০-২৫টি ওয়ার্ডের দায়িত্ব দেওয়া হবে। তিনি স্বীকার করেন, দলীয় কমিটি নিয়ে সমস্যা আছে। তিনি একই সঙ্গে বলেন, তা নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে না।
আফজল পরিবারের চার প্রার্থী: আফজল খান ছাড়াও তাঁর মেয়ে, আপন ভাই ও ভাগনের বউ সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে লড়ছেন। মেয়ে আনজুম সুলতানা ৩ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর পদে প্রার্থী। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী শহর যুবলীগের আহ্বায়ক আফজল খানের ভাগনে কামাল চৌধুরীর স্ত্রী আঁখি চৌধুরী। একই ওয়ার্ডে দুই আত্মীয়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে মেয়র পদে ভোট নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে কামাল চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওঁনার (আফজল খান) মেয়েকে সরিয়ে নিলে আমিও আমার স্ত্রীকে নির্বাচন থেকে প্রত্যাহার করে নেব।’ একই পরিবারের দুই প্রার্থী থাকায় জটিলতা তৈরি হয়েছে বলেও স্বীকার করেন তিনি।
আনজুম সুলতানা কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলা পরিষদের মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করার জন্য ওই পদ থেকে পদত্যাগ করেন। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আত্মীয় বলে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে আমি নিজের পাশাপাশি বাবার জন্যও কাজ করছি। তাতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
আফজল খানের ছোট ভাই আমান উল্লাহ খান নগরের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে প্রার্থী হয়েছেন। তিনি পৌরসভার কাউন্সিলর ছিলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এক পরিবারে এত প্রার্থী থাকায় ভোটারদের মধ্যে নেতিবাচক ভাবনা আসতে পারে।
আগামী ৫ জানুয়ারি নবগঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন প্রথম নির্বাচন। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী দুই প্রার্থী ছাড়াও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য চঞ্চল কুমার ঘোষ মেয়র পদে প্রার্থী হয়েছেন। তিনি আফজল খানের ডামি প্রার্থী বলে ভোটারদের মধ্যে প্রচার রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.