সুবিধা দিয়ে কেড়ে নেওয়া যায় না-প্রশাসন by আরিফ খান

স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যারা অস্ত্র ধরেছিলেন তাদের আমরা বাড়তি দুই বছর চাকরিতে বহাল রাখার ব্যবস্থা করতেই পারি। আর দেশের জন্য যারা জীবন দিতে গিয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে ৫৯ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যে সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় সেবা মিলবে, তাতে সন্দেহ কী সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অবসরের সময় দুই বছর পিছিয়ে গেল। এখন তারা ৫৭ বছরের পরিবর্তে ৫৯ বছর বয়সে চাকরি থেকে বিদায় হবেন।


৫৭ বছর বয়সে যখন অবসর গ্রহণের বিধান ছিল, একাত্তরে স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছর বয়স বাড়িয়ে ৫৯ বছরে অবসর গ্রহণের জন্য সরকার নির্ধারণ করে। এটা করা হয়েছিল এসব বীর মুক্তিযোদ্ধার মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অবদানের জন্য। এটা করে জাতি এই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত করেছিল। সরকার সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর বয়স বাড়িয়ে দেওয়ার পর এখন নাকি মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছরের ওই সুযোগ অন্যদের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। এটা যদি সত্য হয় তাহলে বিষয়টি হবে অত্যন্ত দুঃখজনক। মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের শুভাকাঙ্ক্ষীরা বয়স বৃদ্ধির ব্যাপারে ধরে নিয়েছিলেন, সবার জন্য দুই বছর বৃদ্ধি মানে অন্যদের ৫৯ বছর এবং মুক্তিযোদ্ধাদের হবে ৬১ বছর। এ হিসাব অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। যে যে কর্মচারী যে যে সময়ে অবসরে যাবেন তার থেকে দুই বছর বৃদ্ধি হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের যেহেতু আগেই ৫৯ বছর করা হয়েছে সেহেতু এখন হবে ৬১ বছর। কিন্তু সংবাদপত্র ও টেলিভিশনে যা পাওয়া যাচ্ছে কিংবা বিভিন্নজনের ব্যাখ্যায় যা বলা হচ্ছে তাতে ওই হিসাব মেলে না। ৫৭ বছর পূর্ণ হয়ে অবসর নেওয়ার পর দুই বছর বৃদ্ধির কারণে অনেক মুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবী ইতিমধ্যে ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত চাকরি করে অবসর নিয়েছেন। তারা সরকার ঘোষিত দুই বছর বয়স বৃদ্ধির সুবিধা ভোগ করেছেন। এখন যদি অন্য সবার সঙ্গে তাদের বয়স বৃদ্ধির সমতা করা হয় তাহলে একই শ্রেণী অর্থাৎ অন্য মুক্তিযোদ্ধা যারা এখন কর্মে রয়েছেন তাদের প্রতি চরম অবিচার করা হবে। একবার সম্মান দিয়ে সম্মান কেড়ে নেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। সরকারি বিধানে ধরে নেওয়া হয় যে, একবার কাউকে কোনো সুবিধা দিয়ে তা কেড়ে নেওয়া যায় না। কিন্তু চাকরিতে অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানোর পর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে সরকার কার্যত সেটাই করতে যাচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
মুক্তিযোদ্ধাদের বলা হয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একটি অংশ ছিল কৃষক ও দিনমজুর পরিবারের সন্তান। তাদের অনেকে এখন কী মানবেতর জীবনযাপন করছেন তা চারদিকে তাকালে এবং পত্রিকার পাতা ওল্টালে দেখা যায়। আর মুক্তিযোদ্ধা যারা অস্ত্র সমর্পণের পর তীব্র প্রতিযোগিতা করে চাকরি লাভের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন, তাদেরও সবাই কিন্তু ভালো নেই। আর এ কারণেই মুক্তিযোদ্ধাদের দুই বছর অতিরিক্ত চাকরির সুবিধাকে বিশেষ আনুকূল্য হিসেবে ধরে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন মনে হয়, মুক্তিযোদ্ধাদের কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করতে হয় বলেই অনেকটা করুণা করে 'শ্রেষ্ঠ' শব্দটি বলা। প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রেষ্ঠ সন্তান বললেও অনেকেই আন্তরিকতা নিয়ে সেটা বলেন না। এটা মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযোদ্ধাদের বেলায় কোনো বক্তব্য প্রদানের সময় বা লেখায় বলে তাদের নিছকই সান্ত্বনা দেওয়া এবং নিজেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক বলে প্রতিষ্ঠিত করার একটি কৌশল মাত্র। তা যদি না হবে তাহলে যাদের বদৌলতে আজকে এই স্বাধীন দেশে বুক ফুলিয়ে, মাথা উঁচু করে বাস করছি সেসব বীর সন্তান স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও এত অবহেলিত কেন? তাই আজকের দাবি, সব মুক্তিযোদ্ধাকে প্রকৃত অর্থেই শ্রেষ্ঠ সন্তানের মর্যাদা দেওয়া হোক। আশা করব, সরকার মুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবীদের অবসরের বয়সসীমা ৫৯ যোগ ২, মোট ৬১ বছর করার নির্দেশ জারি করবে। মুক্তিযোদ্ধা চাকরিজীবীর সংখ্যা প্রতিদিন কমছে। তাই খুব বেশি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে এ সুবিধা দেওয়ার দরকার পড়বে না। আর কয়েক বছর পর চাইলেও কিন্তু কোনো অফিসে একজন মুক্তিযোদ্ধাও পাওয়া যাবে না। আমাদের সেই সময়ের কথা ভাবতে কষ্ট যে, বাংলাদেশের সচিবালয়ে কিংবা প্রধানমন্ত্রীর দফতর বা গুরুত্বপূর্ণ অফিসে একজনও মুক্তিযোদ্ধা নেই। জীবন চিরস্থায়ী নয়। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য যারা অস্ত্র ধরেছিলেন তাদের আমরা বাড়তি দুই বছর চাকরিতে বহাল রাখার ব্যবস্থা করতেই পারি। আর দেশের জন্য যারা জীবন দিতে গিয়েছিলেন তাদের কাছ থেকে ৫৯ বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পরও যে সর্বোচ্চ আন্তরিকতায় সেবা মিলবে, তাতে সন্দেহ কী।

আরিফ খান :সরকারি চাকরিজীবী মুক্তিযোদ্ধা

No comments

Powered by Blogger.