ভাড়া বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাপে অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা-জ্বালানি খাত ১ by সবুজ ইউনুস ও নাজমুল ইমাম

বেসরকারি খাতে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ- কেন্দ্রগুলো সরকারের 'গলার কাঁটা' হিসেবে দেখা দিয়েছে। দ্রুত উৎপাদন বাড়িয়ে বিদ্যুতের কষ্ট লাঘব করতে গিয়ে সরকার ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সিদ্ধান্ত নেয়। সরকার সুফলও পেয়েছে। বিদ্যুতের সমস্যা অনেকটা কেটেছে। অধিকাংশ কেন্দ্র জ্বালানি তেলনির্ভর হওয়ায় তেল আমদানি করতে গিয়ে বিপিসি এখন দেউলিয়া হতে চলেছে। এ ছাড়া বেসরকারি এ বিদ্যুৎ বেশি দামে সরকারকে কিনতে হচ্ছে।


আবার কম দামে সেই বিদ্যুৎ সাধারণের কাছে বিক্রি করতে হচ্ছে। ফলে ভর্তুকির পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে এ সংকট কিছুটা কাটানোর চেষ্টা করা হলেও সার্বিক অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে। সরকার এ সমস্যা থেকে সহসা বের হয়ে আসতে পারবে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিদ্যুতের উৎপাদন বাড়লেও এখন প্রতিদিন ঘাটতি রয়েছে দেড় হাজার মেগাওয়াট। বর্তমানে প্রতিদিন চাহিদা সাড়ে ৬ হাজার মেগাওয়াট। সেখানে গড়ে উৎপাদন হচ্ছে ৫ হাজার মেগাওয়াট। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জ্বালানি তেল আমদানি করা হয় সাড়ে ৩৭ লাখ টন। গত অর্থবছরে করা হয় সাড়ে ৪৮ লাখ টন। চলতি অর্থবছরে এ চাহিদা দাঁড়াতে পারে ৬৭ লাখ টনে। কারণ এর মধ্যে জ্বালানি তেলনির্ভর আরও বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়েছে। দু'বছর আগে তেল আমদানিতে সরকারকে পৌনে ৩ বিলিয়ন ডলার বছরে খরচ করতে হতো। সেখানে চলতি অর্থবছরে ৬ বিলিয়ন ডলার লাগছে। এ অর্থের জোগান দেওয়া সরকারের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়েছে।
বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন কার্যক্রম দ্রুত এগিয়ে গেলেও সরকারি খাতে তেমনটা এগোয়নি। এ অবস্থায় বেসরকারি খাতের এই বেশি দামের বিদ্যুতের ওপরই সরকারকে নির্ভর করতে হবে। অবশ্য আগামীতে বেশকিছু সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার কথা।
সরকারি হিসাবে তিন বছরে ৪১টি নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ২ হাজার ৬৯৪ মেগাওয়াট। এর মধ্যে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রে ১ হাজার ২২৯ মেগাওয়াট এবং জ্বালানি তেলনির্ভর কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৪৬৫ মেগাওয়াট।
অর্থনীতিবিদরা আশঙ্কা করছেন, বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়ন বাজেটের (৭ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা) অর্থ দিয়ে ভর্তুকির টাকা জোগান দিতে হতে পারে। ফলে টান পড়তে পারে উন্নয়ন বাজেটের বরাদ্দেও। এতে এ অর্থবছরে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন ব্যাহত হতে পারে। বিশেষ করে সরকারি খাতে যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সেগুলোর উন্নয়ন কার্যক্রম স্থবির হয়ে যেতে পারে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বেসরকারি খাত থেকে বেশি দামে একসঙ্গে এত বেশি বিদ্যুৎ কেনার দরকার ছিল না। তাদের মতে, শুধু উৎপাদন বাড়ালেই হবে না, ভর্তুকি দেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্যও থাকতে হবে। বিদ্যুৎ সমস্যা কাটাতে গিয়ে গোটা দেশের আর্থিক অবস্থা নড়বড়ে করে ফেলা ঠিক হয়নি।
বেসরকারি বিদ্যুতের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়ার কারণ কী জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী বীরবিক্রম সমকালকে বলেন, তীব্র বিদ্যুৎ সংকটের মধ্যে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসে। বিদ্যুৎ নিয়ে জোট সরকারের মতো তত্ত্বাবধায়ক সরকারও কার্যকর কিছু করেনি। ফলে ক্ষমতাগ্রহণের শুরুতেই দেশজুড়ে তীব্র লোডশেডিংয়ে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। দ্রুত বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি করতে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল ছাড়া আর ভালো বিকল্প ছিল না। দ্রুত উৎপাদন বাড়ানোর জন্য বিশেষ আইনও করা হয়। এ আইনবলে বেসরকারি খাতে একে একে রেন্টাল বা ভাড়াটে কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে বিদ্যুৎ সমস্যা দ্রুত সমাধানের অঙ্গীকার করে। উপদেষ্টা বলেন, সরকারি কেন্দ্রও বেশ কয়েকটি চালু হয়েছে। আগামীতে আরও বেশ কয়েকটি চালু হবে। সরকারি খাতে প্রকল্প বাস্তবায়ন সময়সাপেক্ষ হওয়ায় বেসরকারি খাতের প্রকল্পগুলো আগেই চালু হয়েছে বলে মনে করেন উপদেষ্টা।
ভর্তুকির মূলে রেন্টাল : বেসরকারি খাতের কেন্দ্রগুলো থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কিনতে গিয়ে গত অর্থবছর পিডিবির ক্ষতি হয়েছে ৪ হাজার ৭৯০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর বেসরকারি খাত থেকে আরও নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসছে। সে বিদ্যুৎও সরকারকে কিনতে হবে। এ কারণে এ অর্থবছরে লোকসানের পরিমাণ ৭ হাজার ৩৪২ কোটি টাকায় পেঁৗছতে পারে বলে পিডিবি জানায়। পিডিবি আশঙ্কা করছে, ভবিষ্যতে পর্যায়ক্রমে বিদ্যুতের দাম না বাড়ালে ভর্তুকির পরিমাণ ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে, যা সরকারের সার্বিক আর্থিক শৃঙ্খলায় বিপর্যয় ডেকে আনবে। বর্তমানে সরকারের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে এ লোকসান সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে রাষ্টীয় সংস্থা পিডিবি।
৪৯টি কেন্দ্রের জন্য চুক্তি : ২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে চলতি ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৪৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য চুক্তি সই হয়। সেগুলো হলো_ রেন্টাল তিনটি (২৬৫ মেগাওয়াট), কুইক রেন্টাল ১৭টি (১ হাজার ৩৮৮ মেগাওয়াট), বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র (আইপিপি) ১০টি (১ হাজার ৬৩৫ মেগাওয়াট) এবং ১৮টি সরকারি খাতের কেন্দ্র (২ হাজার ১১ মেগাওয়াট)। এসব কেন্দ্রের মোট ক্ষমতা ৫ হাজার ২৯৯ মেগাওয়াট। এর মধ্যে ২২টি কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। এসব কেন্দ্রের ক্ষমতা ১ হাজার ৭৪৪ মেগাওয়াট। চুক্তি হওয়া আইপিপির মধ্যে একটিও উৎপাদনে আসেনি। বৃহৎ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ সরকার দেরিতে নেওয়ায় এ ক্ষেত্রে সরকার এখনও সাফল্য দেখাতে পারেনি। সর্বশেষ ২০ ডিসেম্বর অবশ্য প্রথমবারের মতো বেসরকারি খাতে তিনটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য অনুস্বাক্ষর করেছে পিডিবি। একই দিন ১৮ মেগাওয়াটের একটি সোলার থারমাল কেন্দ্রের জন্যও একটি বেসরকারি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করেছে পিডিবি।
আওয়ামী লীগের অঙ্গীকার :আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারে ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার অঙ্গীকার করে। সেটা এরই মধ্যে অর্জিত হয়েছে। ইশতেহারে একইভাবে ২০১৩ সালের মধ্যে উৎপাদন ৭ হাজার মেগাওয়াট এবং ২০২১ সালে ২০ হাজার মেগাওয়াটে পেঁৗছবে বলে উল্লেখ করা হয়।
সরকার শুধু রেন্টাল কেন্দ্রের ওপর নির্ভর করছে না। পিকিং প্লান্ট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও সরকার কিছুটা এগিয়েছে। আগামী বছরের মধ্যে ১২টি পিকিং প্লান্ট উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে। এগুলোর মোট ক্ষমতা ১ হাজার ৮ মেগাওয়াট।
অর্থসংস্থানই বড় বাধা : মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদে সরকারের নেওয়া পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে বিপুল অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন পড়বে। সরকারি হিসাবে ২০১৬ সাল পর্যন্ত যেসব বিদ্যুৎ প্রকল্পের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তা বাস্তবায়নে লাগবে ১৭ বিলিয়ন ডলার; যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা। সরকারি-বেসরকারি খাতে এ পর্যন্ত প্রায় ৭ বিলিয়ন বা ৫৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের ব্যাপারে নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে। এ জন্য সরকার দেশ-বিদেশে রোড শোও করেছে। চলতি অর্থবছরে উন্নয়ন বাজেট এবং ভর্তুকি মিলিয়ে বিদ্যুৎ খাতের জন্য খরচ হবে প্রায় সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। এ অর্থ জোগাড় করার পাশাপাশি ওই বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ সংগ্রহ করা সরকারের জন্য রীতিমতো কষ্টসাধ্য হবে।
বিদ্যুতের কারণে বিপিসির লোকসান : বিদ্যুৎকেন্দ্রে ভর্তুকি মূল্যে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। আর্থিক লোকসান অনেকগুণ বেড়ে যাওয়ায় সংস্থাটি ব্যাপক আর্থিক সংকটে পড়েছে। গত অর্থবছর জ্বালানি তেল বিক্রি করতে গিয়ে বিপিসি ৮ হাজার ২০০ কোটি টাকা লোকসান দেয়। নতুন নতুন তেলনির্ভর কেন্দ্র গড়ে ওঠায় এক বছরের ব্যবধানে তেলের ব্যবহার বেড়েছে প্রায় ২০ লাখ টন। এর ফলে চলতি অর্থবছর বিপিসির লোকসানের পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকায় পেঁৗছতে পারে বলে সংস্থাটি আশঙ্কা করছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের এ ভর্তুকির চাপ দেশের অর্থনীতির ওপরও পড়েছে। বিশেষ করে চাপের মুখে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ।

No comments

Powered by Blogger.