দুর্নীতি-ভারতে সরকার বনাম সুশীল সমাজ! by কুলদীপ নায়ার

ভারতে সরকার আর সুশীল সমাজের মধ্যে যেন লড়াই শুরু হয়েছে। পার্লামেন্টের বর্ধিত অধিবেশনে উত্থাপিত সংশোধনী বিলে সরকারি দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার মতো যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়নি লোকপাল প্রতিষ্ঠানকে। তবে গান্ধীবাদী নেতা আন্না হাজারের দাবি অনুযায়ীই লোকপাল বিলটিতে যথেষ্ট ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে বলে দাবি করছে সরকার। উল্টো দিকে আন্দোলনকারী আন্না পার্লামেন্টে উত্থাপিত এই বিল প্রত্যাখ্যান করে দাবি আদায়ে
আবারও অনশন শুরুর হুমকি দিয়েছেন। উপরন্তু এবার তিনি জনগণের প্রতি ‘জেল ভরো’ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন। সেই সঙ্গে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকে হুঁশিয়ার করে বলেছেন, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাবসহ পাঁচ রাজ্যে আসন্ন নির্বাচনে তিনি নিজে দলটির বিরুদ্ধে প্রচারণায় নামবেন। কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীও এই হুমকিকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে তাঁর দলও লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থার (সিবিআই) ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়েই সরকার ও সুশীল সমাজের মধ্যে এই বিরোধ। সুশীল সমাজের দাবি অনুযায়ী সিবিআইয়ের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ লোকপাল বা অন্য কোনো স্বাধীন সংস্থার হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করছে সরকার। এর কারণ অবশ্য স্পষ্ট। কারণটা হলো, সব সরকারেরই গোপন করার মতো অনেক বিষয় থাকে। কাজেই তারা তদন্ত সংস্থাটিকে হাতছাড়া বা অন্যের হাতে তুলে দিতে পারছে না। যেমন, মনমোহন সরকারের কথাই ধরা যাক। এ সরকার লোকসভায় হুমকির মুখে পড়লে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী ও সাবেক মুখ্যমন্ত্রী মুলায়াম সিংকে চাপে ফেলে নিজেদের পক্ষে থাকতে বাধ্য করে। ৫৪৫ আসনের লোকসভায় কংগ্রেস ২০৭টি আসনের অধিকারী। সিবিআইয়ের মারফত মায়াবতী আর মুলায়াম সিংয়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করাটা কংগ্রেসের জন্য বেশ সহায়ক হয়। রাজ্যের ক্ষমতা গ্রহণের পর অবৈধ সম্পদের অধিকারী হওয়া এই দুই নেতার বিরুদ্ধে তখন তদন্ত সংস্থাটি একটি মামলা চালাচ্ছিল। ফলে ওই সংস্থাকে কাজে লাগিয়ে তাঁদের ওপর চাপ সৃষ্টি করাটা সরকারের জন্য সহজ হয়েছিল।
কংগ্রেসকে একা দোষ দিলে হবে না। অটল বিহারি বাজপেয়ির নেতৃত্বাধীন বিজেপিসহ ভারতের সব সরকারই সিবিআইকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছে। লোকসভার ফ্লোরে দাঁড়িয়ে বিহারের একজন প্রবীণ নেতা স্বীকারও করেছিলেন, ক্ষমতায় থাকাকালে তদন্ত সংস্থাটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেছিল তাঁর সরকার। সংস্থাটির বেশ কয়েকজন সাবেক পরিচালকও তাঁদের লেখা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ওমুক ওমুক সরকার বিশেষ কোনো ব্যক্তি বা রাজনৈতিক দলের বিপক্ষে ফৌজদারি মামলা করতে বা চলমান মামলা বন্ধে তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল। আমি যখন রাজ্যসভার সদস্য ছিলাম, তখনই সিবিআইয়ের নিয়ন্ত্রণসংক্রান্ত বিলটি স্বরাষ্ট্রবিষয়ক সংসদীয় কমিটির কাছে আসে। সে সময় ভারতের প্রধান বিচারপতি জে এস ভার্মা একটি হাওলা মামলায় সিবিআইয়ের নিয়ন্ত্রণ বিচার পরিচালনাসংক্রান্ত স্বাধীন দপ্তরের (ডিওপি) হাতে তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করেছিলেন। কোনো রাজনৈতিক দলই তখন সিবিআইয়ের স্বায়ত্তশাসন মেনে নেয়নি। বিচারপতি ভার্মার প্রস্তাব এভাবে সরাসরি নাকচ হয়ে যাওয়ায় ওই সময় আমি খুব হতাশ হয়েছিলাম। সংস্থাটির ওপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ ছিল অনেকটা স্বতঃসিদ্ধ। সুপ্রিম কোর্টকে সরিয়ে সরকারই এখন সংস্থাটির একক নিয়ন্ত্রক। অর্থাৎ যুগ্মসচিব বা এ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত বা পদক্ষেপ নিতে সংস্থাটিকে সরকারের অনুমতি নিতে হয়। এমন কোনো মন্ত্রী পাওয়া কঠিন, যিনি তাঁর নিজ ব্যক্তি বা দলীয় স্বার্থে এ সুযোগ কাজে লাগাননি। সিবিআইয়ের তদন্তে দ্বিতীয় প্রজন্মের ফোনের নিবন্ধন নিয়ে যে দুর্নীতি উদ্ঘাটিত হয়েছে, তাতেও দেখা গেছে মন্ত্রীরা কীভাবে কোনো নিয়মনীতির ধার না ধেরে বেসরকারি গোষ্ঠীগুলোকে সুবিধা দিয়েছেন।
এখন আন্না হাজারে আশঙ্কা করছেন, তাঁদের আন্দোলনের পর সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা হচ্ছে, তারা বিলটির প্রথম দিককার অবস্থায় ফিরে গেছে। ওই বিলে লোকপালকেই তদন্ত-ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সিবিআইয়ের নিয়ন্ত্রণ ছাড়া লোকপাল একেবারেই ক্ষমতাহীন। সিবিআই ছাড়া মন্ত্রী বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দুর্নীতি প্রমাণে লোকপাল পুরোপুরি অসহায়। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও প্রধান বিচারপতি মিলেও যদি সিবিআইয়ের পরিচালক নির্বাচন করেন, তা হলেও পরিস্থিতির অন্যথা হবে না। কারণ, এই তিন পক্ষের মধ্যে দুই পক্ষই রাজনৈতিক। অন্য দিকে, আন্না হাজারে প্রস্তাবিত নয় সদস্যের লোকপাল হবে স্বাধীনভাবে নির্বাচিত। তাঁরাই সিবিআইয়ের পরিচালক নির্বাচন করবেন। তা ছাড়া সিবিআই সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতেও থাকতে পারে। কারণ, জনগণের এখনো দেশের বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা আছে। এ আস্থা লোকপাল ব্যবস্থার প্রতিও তাদের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে। তবে আমার মূল আপত্তি হচ্ছে লোকপাল ব্যবস্থায় ৫০ শতাংশ সংরক্ষিত ব্যবস্থার প্রতি। এই মনোভাব আমাদের কখনোই একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে দাঁড়াতে দেবে না। চাকরি বা শিক্ষা ক্ষেত্রে কোটাব্যবস্থা থাকে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আমরা যখন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের নির্বাচন করছি, তখন সবচেয়ে যোগ্যতমকেই বেছে নেওয়া দরকার। লোকপাল ব্যবস্থায় সংরক্ষণনীতি প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে সরকার প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দ্বন্দ্ব ও বিভেদের বীজই বপন করছে। আমি আশা করি, আন্না হাজারের নেতৃত্বাধীন দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা লোকপাল ব্যবস্থায় সংরক্ষণনীতির বিরুদ্ধেও সোচ্চার হবেন।
লোকপাল বিলের বিরুদ্ধে আন্নার কঠোর অবস্থান থেকে মনে হচ্ছে, সরকার ও সুশীল সমাজের এ লড়াই রাস্তা পর্যন্ত গড়াবে। এটা দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাবে। সহিংসতার পথ থেকে সরে রাজনৈতিক দলগুলোর একত্রে বসে এ বিষয়ে সমাধানের পথ খোঁজা উচিত। একজনের বিজয় মানেই আরেকজনের পরাজয়—এ ধরনের কথা আসলে আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। তা ছাড়া রাজনীতিবিদেরা যে পদক্ষেপই নিন, জনগণকে সতর্কতার সঙ্গে তা পর্যবেক্ষণ করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর খেলার পুতুল হওয়া যাবে না। অবশ্য আন্না হাজারের দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলন কী আকার ধারণ করে তার ওপরও অনেক কিছুই নির্ভর করছে।

ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: ইসরাত জাহান
কুলদীপ নায়ার: ভারতীয় সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.