মুক্তিযুদ্ধের ছিন্ন দলিলপত্র-৪৬ ॥ ২ ডিসেম্বরের 'রণাঙ্গন' পত্রিকার শিরোনাম_ 'ডিসেম্বরে বাঙলা মুক্ ত' by মুনতাসীর মামুন

হাসিনা আহমেদ গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ড মুজিবনগর/ মুক্তাঞ্চল থেকে প্রকাশিত ৬৪টি পত্রপত্রিকার বিবরণ দিয়েছেন। সেখানে রণাঙ্গন নামে তিনটি পত্রিকার উল্লেখ করেছেন।
একটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। অপর দু'টি খন্দকার গোলাম মোসত্মফা ও মুস্তফা করিম প্রকাশ করেছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। আসলে মোস্তফা ও মুস্তফা করিম একই ব্যক্তি।সম্প্রতি খন্দকার গোলাম মোস্তফা আমাকে একটি চিঠি ও তাঁর পত্রিকার একটি কপি পাঠিয়েছেন। তিনি লিখেছেন_
"মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতের ময়নাকুড়ি নামক স্থান থেকে ১৯৭১ সালের ২৭ মে 'সাপ্তাহিক রণাঙ্গন' নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনা শুরম্ন করি। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিরলসভাবে পত্রিকাটির প্রকাশনা অব্যাহত রাখি। প্রকাশনার ৰেত্রে আমরা নানা প্রতিকূল অবস্থার মুখোমুখি হয়েছিলাম। এ প্রসঙ্গে উলেস্নখ করতে হয় আমাদের দুইজন সহকর্মী খন্দকার বদিউজ্জামান ও নুরম্নল ইসলাম ঢালি, যথাক্রমে কুড়িগ্রামের নাজিম খাঁও রংপুরে রাজাকারদের হাতে আটক হয়ে নির্মমভাবে শহীদ হয়েছেন।"
গোলাম মোসত্মফা আমাকে যে সংখ্যাটি পাঠিয়েছেন সেটি ২ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের। আসন্ন জয় সম্পর্কে তারা শিরোনাম করেছিল_ 'ডিসেম্বরে বাঙলা মুক্্ত' তাদের ভাষ্য অনুযায়ী।
"সমগ্র বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনী অপরাজেয় অগ্রগতিতে তাদের অভিযান পরিচালনা করে প্রমাণ করেছেন যে, ডিসেম্বর মাসে বাঙলাদেশ থেকে শত্রম্নদেরকে সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন করে বাঙলাদেশের কতর্ৃত্ব দখল করে নেবেন। ২৫শে মার্চের ভয়াবহ রাতের দুঃসহ দুঃখ-যন্ত্রণার কেশ ভেদ করে বর্তমানে অদম্য মনোবলের অধিকারী মুক্তিবাহিনীর বীরগেরিলারা

নিজেদের মা, বোনের ইজ্জত লুণ্ঠনকারীদের সমুচিত শিৰা দিয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য তৎপর হয়ে উঠেছেন। বর্তমানে সমগ্র বাঙলাদেশ মুক্তিবাহিনী কতর্ৃক অবরম্নদ্ধ হয়ে পড়েছে। ফলে, খান সেনাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। অনেক স্থানেই খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিসহ অস্ত্র-শস্ত্র ও গোলাবারম্নদ পর্যাপ্ত সরবরাহ করতে না পারায় খান সেনারা চরম বিপাকে পড়ে দিন গুনছে। অনেকেই প্রমাদ গুনছেন। বর্তমান মাস শেষ হবার পূবের্্বই বাঙলাদেশ সম্পূর্ণ শত্রম্ন কবল মুক্ত হবে।
'ওসত্মাদের মার শেষ রাতে'_ প্রবাদ বাক্যটির প্রয়োগ করার জন্য মুক্তিবাহিনী সদা প্রস্তুত। বাঙলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরম্ন হ'বার পর প্রথম দিকে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বিলম্ব ঘটায় সাময়িকভাবে খান সেনারা সুবিধা করে উঠলেও মুক্তি বাহিনীর প্রস্তুতিপর্ব শেষ হ'বার সঙ্গে সঙ্গে খান সেনারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে চরম মার খেয়ে দিনের পর দিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর অপ্রতিরোধ্য আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে খান সেনারা রংপুর জেলার উলিপুর, নাগেশ্বরী, হাতীবান্ধা, ডোমার, দিনাজপুর জেলার পঁচাগড়, বগুড়া জেলার জয়পুরহাট, কুমিলস্নার কসবা, নোয়াখালীর ফেনী, সিলেটের সুনামগঞ্জ, মৌলবীবাজার, হবিগঞ্জ, আজমীরিগঞ্জ, কুষ্টিয়ার-জীবননগর, যশোহর ও বাংলাদেশের বিসত্মীর্ণ এলাকা মুক্তিবাহিনী খান সেনাদের মারণ ছোবল থেকে মুক্ত করতে সৰম হয়েছেন।'
নারী যোদ্ধাদের নিয়ে তেমন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রকাশিত পত্রপত্রিকাগুলিতে। রণাঙ্গনে এ সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন ছিল_ বাঙলা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে
মহিলা গেরিলা বাহিনী
বাঙলা দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে ত্বরাণি্বত করার জন্য বাঙলা দেশের বিসত্মীর্ণ অঞ্চলের মহিলা সমাজের পৰ থেকে মহিলা গেরিলা বাহিনী গঠনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। ইয়াহিয়ার বর্বর সৈন্যবাহিনী নারীজাতির প্রতি যে পৈশাচিক ব্যবহার করেছে তারই প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য এখন মহিলা সমাজ প্রস্তুত।
সাপ্তাহিক রণাঙ্গনের প্রতিনিধি বাঙলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আগমন করলে মহিলা সমাজের পৰ থেকে গেরিলা বাহিনীতে কাজ করার ইচ্ছা প্রকাশ করা হয়। ইচ্ছা প্রকাশকৃত মহিলাদের পৰ থেকে বলা হয় জঙ্গী ইয়াহিয়া বাহিনী বিশেষ করে মহিলা সমাজের প্রতি ঘৃণ্য আক্রমণ পরিচালনা করে বিশ্বের ইতিহাসে যে কালিমার ছাপ এঁকে দিয়েছে তার ইতিহাস বিরল। তাই ইয়াহিয়ার এই ধর্ষণপ্রিয় সৈন্যদের মোকাবিলা করার জন্য মহিলা সমাজেরও প্রচুর কর্তব্য রয়েছে বলে তারা তথ্য প্রকাশ করেন। ইতিমধ্যেই কতিপয় স্থানে মহিলাদের পৰ থেকে নিজেদের মান সম্মান ইজ্জত ও সর্বোপরি জীবনের বিনিময়ে খান সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ সমরে ঝেঁপে পড়ে কৃতিত্ব লাভ করতে সৰম হয়েছে বলে অনেক তথ্য পাওয়া গিয়েছে।
উত্তরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া_ হামার দেশের ঐ ছাওয়াগুল্যা_ ভেটাগান দিয়া গড়িয়া ফাইট দিতোছে : স্বদেশ চক্রবর্তী
বাঙলাদেশের উত্তরাঞ্চলের মুক্ত এলাকা দিয়ে পথ চলতে চলতে গিয়ে হঠাৎ করে থমকে দাঁড়ালাম। কানে ভেসে আসল এক অশীতিপর বৃদ্ধের কণ্ঠস্বর। একটু এগুতেই চোখে পড়ল একদল নানান বয়সের লোক আলাপ করছেন বাঙলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন দিক ও অগ্রগতি নিয়ে।
লৰ্য করলাম ওদের মাঝে প্রৌঢ়দের সংখ্যাই বেশী। ওদের একটু কাছে যেতেই ওরা ওদের আলোচনা বন্ধ করলেন। আর আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকালেন যে আমি রীতিমত ঘাবড়ে গেলাম। শুরম্ন হল জেরা_ কোথায় নিবাস, কোথায় যাব, কেন যাব ইত্যাদি থেকে শুরম্ন করে চৌদ্দ পুরম্নষের নাম ধাম পর্যর্নত্ম। আমার তখনকার অবস্থা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন? 'খবরের কাগজের লোক' ুএই বলে সাৰী-প্রমাণপত্রের পর ওদের কাছে জানলাম_ ওরা আত্মঘাতী, স্বার্থবিরোধী (বাঙলাদেশের) লোকদের প্রতি সদা সচেতন-সন্দিহান। প্রশ্ন করলাম মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্রসঙ্গে। সেই অশীতিপর বৃদ্ধ তাঁর আঞ্চলিক ভাষাতে বললেন- 'বাহে, হামরা হনু মুকু্যসুকু্য নোক। ন্যাকাপড়া শিখঙ নাই। হামরা উয়ার কি বোঝঙ। তবে, হয়, আইত হবার সাতে সাতে এই যে গুড়ুম-গুড়ুম আর ট্যার ট্যার আওয়াজ শুনির পাওয়া যায় উয়াত হামার বুকখান আরও ফুলি ওঠে। আর মনে হয় হামার ছাত্তয়া রহিম আর গোপাল ধনীর ব্যাটা কমলের মত হাজার হাজার ছাওয়াল হামার দ্যাশের মুক্তি বাহিনীত নাম ন্যাকেয়া ঐ বেইমান শত্রম্নদের শ্যাস করির ধরচে?
আরেক প্রশ্নের উত্তরে ঐ অশীতিপর বৃদ্ধ জনৈক মুক্তিবাহিনীর যুবকের সাথে তাঁর সাম্প্রতিক আলোচনার কথা উলেস্নখ করে বললেন ু"হামার দ্যাশের এই ছাওয়াগুলান ভ্যাটাগান ধরি গড়িয়া ফাইট দিতোছে আর ঐ খানের পোষা কুত্তাগুলাক একটার পর একটাক খতম করির ধচছে।"

No comments

Powered by Blogger.