এভারেস্টের চূড়ায় শচীন, একা by মাহমুদুন্নবী চঞ্চল

বাবা রমেশ তেন্ডুলকর ছিলেন মারাঠি ভাষার জনপ্রিয় কবি ও লেখক। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি তাঁর ছিল গভীর অনুরাগ। ছেলের নামও তাই মিলিয়ে রেখেছিলেন বিখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক শচীন দেব বর্মণের নামানুসারে।
হয়ত বাবার স্বপ্ন ছিল তার পথেই হাঁটবে তাঁর ছোট ছেলে। বড় ছেলে অজিত তেন্ডুলকর কিছুটা বাবার পথে হাঁটলেও ছোট্ট ছেলের গতি ছিল ভিন্ন কৰপথে। খেলাধুলায় সে ছিল অনত্মঃপ্রাণ। কোন ক্রিকেটার নয়, শৈশবে তাঁর স্পোর্টিং হিরো ছিল টেনিস তারকা বিয়ন বর্গ। বর্গের খেলা থাকলেই আঠার মতো টিভির সামনে বসে থাকত সে। টিভিতে খেলা দেখা ছাড়া তাকে ঘরে আটকে রাখা দুষ্কর ছিল বাবা-মায়ের। স্কুলের পর বন্ধুরা যখন ঘরে বসে কমিকস্্ পড়ত, তখন সে খেলার মাঠে। খেলা যেটাই হোক তাতে থাকতেই হবে তাঁকে। হয় সমবয়সীদের সাথে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে, সাইকেল চালাচ্ছে, না হয় মার্বেল লাট্টু ঘোরাচ্ছে। স্থির হয়ে বসার বান্দা সে নয়। অন্যান্য খেলায় কাউকে না কাউকে সে নকল করতে চাইত। কিন্তু ক্রিকেটের বেলায় সে ছিল স্বাতন্ত্র্য। ব্যাট বা বল করার সময় তাঁর স্টাইলটা ছিল একদমই নিজের মতো। ক্রিকেটের প্রতি ছোট্ট এই কিশোরের এমন ঝোঁক চোখে পড়ে বড় ভাই অজিতের চোখে। তারই হাত ধরে সেই ছোট্ট কিশোরের পথ চলা। মুম্বাইয়ের সবচেয়ে সুশৃঙ্খল কোচদের একজন রমাকানত্ম আচরেকারের কাছে ক্রিকেটের হাতেখড়ি। শুরম্ন ক্রিকেট অধ্যায়। শিষ্যের মধ্যে অমিত সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন রমাকানত্ম। এতদিনে বাবা বুঝে গিয়েছিলেন ছেলের পছন্দ অপছন্দ। কোচের পরামর্শেই রমেশ ছেলেকে ভর্তি করিয়ে দিলেন সারদাশ্রম স্কুলে। যেখানে পড়ালেখার ফাঁকে বিসত্মর সুযোগ ক্রিকেট অনুশীলনের। ছোট্ট ছেলেও সানন্দে রাজি। সারদাশ্রম স্কুলে দু'টি শাখা ছিল। একটি মারাঠি, একটি ইংরেজী। সে বেছে নিল প্রথমটি। সেবারই হ্যারিস শিল্ডের পাঁচ ইনিংসে তাঁর রান ৫৯৬। এরপর জাইলস শিল্ডের ৬ ইনিংসে ৬৬৫। এমন সাফল্য ছড়িয়ে মিডিয়াতে। মুম্বাইয়ের সান্ধ্য পত্রিকা 'সুনীল ওয়ারিয়র' সাৰাতকার চাইল এই কিশোরের । শিবাজি পার্কের অদূরে এক ইরানী রেস্টুরেন্টে জীবনের প্রথম সাৰাতকার দিল সে। প্রথমবারের মতো হলো খবরের শিরোনাম 'নিউ স্টার শচীন তেন্ডুলকর ।' সই ছোট্ট কিশোর আজকের শচীন তেন্ডুলকর। শৈশবই জানান দিয়েছিল ভবিষ্যতের ক্রিকেট স্টার শচীন। বর্তমানে ক্রিকেট আর শচীন যেন সমার্থক। কি নেই তার ক্যারিয়ারে? কি ওয়ানডে, কি টেস্ট_ সব জায়গাতেই তার দু্যতি ঝলমলে করছে। ওয়ানডেতে ৪৬, টেস্টে ৪৭ সেঞ্চুরি। এখন অবিশ্বাস্যই মনে হয় যে, ওয়ানডে সেঞ্চুরি তার কাছে খাওয়া-ঘুমানোর মতো সহজাত ব্যাপার। মাঠে নামলেই সেঞ্চুরির দেখা। আর কত না রেকর্ডের মেলা। তবে এই ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হওয়ার পর সেঞ্চুরি ছিল শচীনের কাছে অনেকটাই দুরূহ। ওয়ানডে অভিষেক সেঞ্চুরি জন্য কি কষ্টই না করতে হয়েছে তাঁকে। সেঞ্চুরি পেতে তাঁকে অপেৰা করতে হয়েছিল ৭৯তম ইনিংস পর্যনত্ম। সময় হিসেবে প্রায় পাঁচ বছর। ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৪। ভেনু্য শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম। শক্তিশালী অস্ট্রেলিয়ার বিরম্নদ্ধে সেঞ্চুরিয়ান শচীনের আবির্ভাব। দুই ছক্কা আর আট চারের সমন্বয়ে করেন ১১০ রান। বল খেলেন ১৩০। কাঙ্ৰিত এই সেঞ্চুরির পর খুব একট উদ্বেলিত ছিলেন না তিনি। প্রথম সেঞ্চুরির সামান্যতম উচ্ছ্বাসও ছিল না তাঁর মধ্যে। উল্টো নির্লিপ্ত মুখে বলেছিলেন 'না না, ওয়ানডে সেঞ্চুরির না পাওয়া নিয়ে আমি একদমই চিনত্মিত ছিলাম না।' তখনই আভাস দিয়েছিল শচীন অল্পতে তুষ্ট নয়। লৰ্য যার ভিনগ্রহের দিকে সে কি আর মাটির দিকে তাকায়! ক্যারিয়ারের পরবর্তী শতকগুলোই তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ওয়ানডে সেঞ্চুরি জন্য দীর্ঘ পাঁচ বছর অপেৰা করতে হলেও টেস্ট ক্রিকেটে এমনটা হয়নি। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৮৯ সালের ১৫ নবেম্বর টেস্ট অভিষেক হয় তার । করাচীতে তার প্রতিপৰ ছিল পাকিসত্মান। প্রথম টেস্টে শচীনের তিক্ত অভিজ্ঞতা সবারই জানা। পাক বোলার ওয়াকারের বাউন্সি বলে নাক ফেটে রক্তাক্ত হয়েছিলেন শচীন। কিন্তু মাঠ ছাড়েননি এই কিশোর শচীন। দাঁতে দাঁত চেপে পরের বলেই বাউন্ডারি হাঁকিয়ে নিজেকে জানান দিয়েছিলেন তিনি। এই তিক্ত অভিজ্ঞতা শচীনের জেদকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল। বোলারদের শাসন করার মূলমন্ত্র খুঁজে পেতে তেমন বেগ পেতে হয়নি তার। সাদা পোশাকে মাত্র ১০ মাসের ব্যবধানেই প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি আসে তাঁর ব্যাটে। ৯ আগস্ট, ১৯৯০। ম্যানচেস্টারে ইংল্যান্ডের বিরম্নদ্ধে করেন ১১৯ রানের অপরাজিত ইনিংস। কাসিক্যাল ব্যাটসম্যানের রূপ পরিলৰিত হয় এই ইনিংসে ১৭টি বাউন্ডারি হাঁকানোর জন্য। সেই থেকে শুরম্ন। ক্রমে ক্রমে পার করছেন সাফল্যের সব সিঁড়ি। উঠে যাচ্ছেন অনন্য উচ্চতায়। সময়ের বিবর্তনে তাকে ডন ব্রাডম্যানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। কিন্তু বারবার শচীন প্রমাণ করেছেন তিনি অতুলনীয়। শচীনের বিকল্প শচীনই। সেই ১৯৮৯ থেকে খেলে যাচ্ছেন। একটানা কানত্মিহীন। তাঁর সতীর্থ, সমসাময়িকরা বেশির ভাগই বিদায় নিয়েছেন দৃশ্যপট থেকে। কিন্তু তিনি এখনও উজ্জ্বল। কোটি কোটি ভক্তের চাপ নিয়ে শচীন এখনও বহমান-চলমান। উভয় ঘরানার ক্রিকেটে সর্বাধিক রান, ৯৩টি সেঞ্চুরিসহ যার ক্যারিয়ারে রয়েছে ৮০টিরই বেশি বিশ্বরেকর্ড। সে শচীন কি আসলেই রক্তে মাংসে গড়া ? নাকি অতিমানব? তিনি কি সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান? ২৪ ফেব্রম্নয়ারি, ২০১০ এর আগে এই প্রশ্নের বিতর্ক ছিল। অনেকেই তাঁকে ঐ সময়ে সেরা ক্রিকেটারের মর্যাদা দিতে কুণ্ঠাবোধ করতেন। তুলনা এসে যেত ব্রাডম্যান কিংবা লারার সঙ্গে। যতই বেশি সেঞ্চুরি আর রেকর্ডের বন্যা বইয়ে দিক ব্রাডম্যানের নিচে শচীন। সমালোচকদের মতে, তার সব সেঞ্চুরি দলের জয়ে ভূমিকা রাখতে পারেনি। কয়েক বিশ্বকাপে নিজে আলোকিত হলেও দলের পারফরমেন্স ছিল নিতানত্মই নাজুক। সেই ১৯৮৩ সালের পর বিশ্বকাপের ট্রফি ছুঁয়ে দেখা হয়নি শচীনদের। তারপর দু'দফায় দলের ক্যাপ্টেন হিসাবেও ব্যর্থ শচীন। এমন সমালোচনায় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুটটা হাতের নাগালে পাচ্ছিলেন না তিনি। কিন্তু আবারও ঐ ২৪ ফেব্রম্নয়ারি ২০১০। আলোকিত ব্যাটিং ছটায় সব তুলনা আর সমালোচনার উর্ধে এখন শচীন।
জয়পুরে দৰিণ আফ্রিকার বিরম্নদ্ধে দ্বিতীয় ওয়ানডে ম্যাচে তার মহাকাব্যিক ইনিংস বদলে দিয়েছে সমসত্ম দৃশ্যপট। ওয়ানডে ক্রিকেটে প্রথম চোখ ধাঁধানো ডবল সেঞ্চুরি তাকে পেঁৗছে দিয়েছে ভিনগ্রহে। যেখানে শচীন ছাড়া আর কারও অসত্মিত্ব নেই। বলতে বাধা নেই, তিনিই সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। উনিশ শতকের দিকে টেস্ট ক্রিকেটের যাত্রা শুরম্ন হলেও ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রচলন ১৯৭১ সাল থেকে। সময়ের হিসাবে চলিস্নশ ছুঁইছুঁই। ওয়ানডে ক্রিকেটের ২৯৬২ নং ম্যাচটি ছিল আগের সব ম্যাচের চেয়ে আলাদা। প্রায় তিন হাজার ওয়ানডে ম্যাচে অনেক বিশ্বরেকর্ড দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। অনেক ক্রিকেট গ্রেট রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়ে হয়ে আছেন স্মরণীয়। প্রায় সব রেকর্ড হলেও বর্তমানের টি২০ যুগের মারমার কাটের আমলে মিলছিল না ওয়ানডে ক্রিকেট ডবল সেঞ্চুরির। হয়ত বলের অভাবে কিংবা কাছাকাছি গিয়েই দুর্ভাগ্যজনক আউট। ফলে দেখা মেলেনি বহুল কাঙ্ৰিত দ্বিশতকের। সেই ডবল সেঞ্চুরি অবশেষে এলো মাস্টার বস্নাস্টার শচীনের ব্যাটে। তাঁর অপরাজিত ২০০ রানের ইনিংসের জ্বলনত্ম সাৰী হয়ে ইতিহাস বয়ে বেড়াবে গোয়ালিয়রের ক্যাপ্টেন রূপ সিং স্টেডিয়াম। যেখানে দেখা মিলেছে শচীন উইলো ঝড়ের। যে ঝড়ের তা-বে উড়ে গেছে সমালোচকদের সব বুলি। তীৰ্ন সমালোচনা রূপানত্মরিত হয়ে গেছে অকুন্ঠ ভালবাসা আর প্রশংসায়। ভিনগ্রহে বসতি শুরম্ন করা শচীনের পা কিন্তু রয়ে গেছে ধরণীতেই। শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট মাথায় উঠলেও নূ্যনতম অহমিকা ছুঁতে পারেনি তাঁকে। চলিস্নশ বছরের ইতিহাসে যা ছিল না, তাই করার পরও শচীন যেন খুবই সাধারণ। গোয়ালিয়রের মাটিতে এমন ঐতিহাসিক অর্জনের পরও শচীন সেই আগের মতোই সংযত, মার্জিত আর হিসেবী। যেন সেই ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির প্রতিক্রিয়ায় পুনরাবৃত্তি।
ডবল সেঞ্চুরি করার পর সেদিন ম্যাচ পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে হাজির হন শচীন। তাকে পেয়ে চেপে রাখা কৌতূহলের বাঁধ উপচে পড়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের। ধৈর্য ধরেই তাঁদের সমসত্ম কৌতূহল মেটালেন লিটল মাস্টার। কেমন লাগছে_ এমন প্রশ্নের জবাবে শচীনের সাদামাটা উত্তর 'অবশ্যই ভাল। তবে রেকর্ডের জন্য খেলি না। ক্রিকেটের প্রতি ভালবাসার টানেই ক্রিকেটার হয়েছি। সেই শিশু বয়স যেমন এখনও তেমনই আমাকে আনন্দ দেয় ক্রিকেট। সেই আনন্দ উপভোগ করার পথে যখন যা অর্জন হয়েছে এর সবই আনন্দ দিয়েছে আমাকে। ওয়ানডে ক্রিকেটে ডবল সেঞ্চুরি গড়ার পর স্বাভাবিকভাবেই আনন্দিত আমি।' শচীনের এই অনুভূতির সঙ্গে মিলে যায় তাঁর স্ত্রী অঞ্জলির বক্তব্যও। ক্যারিয়ারের বিশ বছর পূর্তি উপলৰে শচীনের ডাক্তার বউ বলেছিলেন, 'আমি শতভাগ নিশ্চিত, যখন উপভোগ করবে না, শচীন তখন আর এক মিনিটও খেলবে না। তবে এখনও সে মাঠে নামার জন্য মুখিয়ে থাকে। যতদিন খেলার ইচ্ছে থাকবে, সে ততদিন খেলতে পারবে'। ক্যারিয়ারের বিশ বছর পূর্তিতে প্রশংসার বন্যায় ভেসেছেন শচীন। তবে ইদানীং এর মাত্রাটা আরও বেশি প্রখর, দেদীপ্যমান। ডবল সেঞ্চুরিয়ান হিসাবে শচীনের জায়গা যে কোথায়, তা বিশিষ্টজনদের প্রশংসা থেকেই বোঝা যায়। সুনীল গাভাস্কার শচীনের আদর্শ। এই মহাকীর্তি গড়ার পর শচীনের পা ছুঁয়ে প্রণাম করার অভিলাষ বাড়তি কোন কিছু নয় গাভাস্কারের। তিনি দেখেছেন কিভাবে গ্রেটদের ছাড়িয়ে যাচ্ছেন এই ভারতীয় লিটল মাস্টার। প্রতিক্রিয়ায় গাভাস্কার বলেন, 'আর কোন প্রশ্ন থাকল না। ক্রিকেট যত ব্যাটসম্যান দেখেছে তাদের মধ্যে শচীনই সেরা, গ্রেটেস্ট। নিঃসন্দেহে সর্বকালের সেরা সে-ই। চিরশ্রেষ্ঠ।' গাভাস্কারের যুক্তি, 'আনত্মর্জাতিক ক্রিকেটে কার ৯৩টি সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব আছে, ১৩ হাজারেরও বেশি রান কার আছে টেস্টে? ১৭ হাজারেরও বেশি রান ওয়ানডেতে করার দৰতা কে দেখিয়েছে? শুধুই তেন্ডুলকর। এমন কীর্তিমানের পদধূলি নিতে চাই।' তবে গাভাস্কারের আশা আরও এগিয়ে যেতে হবে শচীনকে। ১৯৮৩ সালের বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক কপিল দেব বলেছেন, "গত আট মাসে ও যে ক্রিকেট খেলেছে আমার মনে হয়, গত দশ বছরেও ও এটা খেলেনি। আর খেলছে কিনা 'মাত্র' সাঁইত্রিশ বছর বয়সে! আমি তো পঁয়ত্রিশেই অবসর নিয়েছিলাম।" অনিল কুম্বলে তো শচীনের ব্যক্তিত্ব নিয়েই প্রশংসা করলেন, 'ও যেভাবে ডবল সেঞ্চুরি উদযাপন করল, তাতেও ফুটে উঠল ওর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। মাঠে চক্কর দেয়া নেই, আগ্রাসী উলস্নাস নেই, কোন বাগাড়ম্বর নেই। সব সময় ও যা করে_গোয়ালিয়রেও তাই করেছে, হাত দুটো ওপরে উঠিয়েছে, কিছু সময়ের জন্য চোখ বন্ধ রেখেছে এবং এমনই শানত্ম ভাব, যেন এটা হতে যাচ্ছে তা আগে থেকেই ও জানত।' শচীনকে নিয়ে প্রশংসার এমন ঝড় বয়ে গেছে শেন ওয়ার্ন , ম্যাথু হেইডেন, জাভেদ মিয়াঁদাদ, কুমার সাঙ্গাকারাসহ অনেক ক্রিকেট গ্রেটদের মুখে। ১৪৭ বলে অপরাজিত ২০০ রানের ইনিংস একে তো প্রথম ডবল সেঞ্চুরি, আবার সাঈদ আনোয়ারের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের রেকর্ড অতিক্রম। এ প্রসঙ্গে পাকিসত্মানের সাবেক অধিনায়ক আমির সোহেল বলেন, 'সাঈদ আনোয়ারকে জিজ্ঞেস করম্নন। নিশ্চিত ও বলবে শচীনের এই কীর্তিতে তিনি খুশি।' আনোয়ারের প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেল । মিলে গেল তা আমির সোহেলের কথার সঙ্গে, 'আমি জানতাম আমার রেকর্ড ভাঙ্গার দৰতা শুধু শচীনেরই আছে। আমি খুশি যে যোগ্য লোকের হাতেই বিশ্বরেকর্ড হয়েছে।' শুধু কি সেঞ্চুরি আর নয়ন জুড়ানো ব্যাটিং লীলায় শচীন সেরা? না, মানুষ হিসাবেও দারম্নণ। মাঠের বাইরেও অসাধারণ এক ব্যক্তির নাম শচীন। বিশ বছর ধরে মাঠে যে ক্রিকেটের শুদ্ধতার প্রতীক, ব্যক্তিগত জীবনেও একই রকম নিষ্কলুষ এক নাম। সহজ সরল, বন্ধুভাবাপন্ন, আদর্শ বাবা, প্রেমময়ী স্বামী সব গুণই রয়েছে তাঁর মধ্যে। ক্যারিয়ারে এত শতক, কিন্তু কখনও অহংকারবোধে ফেটে পড়েননি তিনি। শুধু ব্যাটিং নয়, ভদ্রতা আর বিনয়েও তিনি সবার উপরে। একটা দুটো সেঞ্চুরি করে যাদের পা শূন্যে ভাসে তাদের শিৰা নেয়া উচিত শচীনের কাছ থেকে। আকাশছোঁয়া অর্জনের পরও এমন মাটিতেই রয়েছে শচীনের পা। এখানেই তো শচীনের মাহাত্ম্য, গ্রেটনেস আর সেরা হওয়ার মূলমন্ত্র।
ফুটবলে ম্যারাডোনা, টেনিসে ফেদেরার, গলফে টাইগার উডস যদি হয়ে থাকেন ঈশ্বর তাহলে ক্রিকেটের ঈশ্বর শচীন তেন্ডুলকর। যার বদৌলতে এভারেস্টে চূড়ায় এখন শচীন। যেখানে শচীন ছাড়া আর কেউ নেই। ক্যারিয়ারে সবই পেয়েছেন। নাম যশ অর্থ প্রতিপত্তি কোটি কোটি দর্শকের ভালবাসা। আর কি কিছু বাকি আছে? আছে। শচীনের টার্গেট দলকে বিশ্বকাপের ট্রফি এনে দেয়া। সেই '৮৩ সালের পর থেকে যার জন্য তৃষ্ণার্ত চাতক পৰীর মতো অধীর প্রতীৰায় গোটা ভারতবাসী। শচীন কি পারবেন তার অভীষ্ট লৰ্যে পেঁৗছুতে? পারবেন কি দেশের কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর স্বপ্ন পূরণ করতে। সময়ই বলে বলে দেবে তা। সে লৰ্যেই পেঁৗছাতে চান ক্রিকেটের এই ঈশ্বর।

ওয়ানডেতে শচীনের যত রেকর্ড

* সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি (৪৬টি)
* এক ইনিংসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান (২০০*)
* সবচেয়ে বেশি ফিফটি (৯৩)
* সবচেয়ে বেশি রান (১৭৫৯৮)
* সবচেয়ে বেশি চার (১৯২৭)
* সবচেয়ে বেশি নার্ভাস নাইনটিজ (১৮বার)
* এক বর্ষপঞ্জিতে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি (৯)
* এক দলের বিপৰে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি (৯টি প্রতিপৰ অস্ট্রেলিয়া)
* সব চেয়ে বেশিবার ম্যাচ সেরা (৬১)
* সবচেয়ে বেশিবার সিরিজ সেরা (১৪)
* টানা সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা ( ১৮৫টি, ২৫ এপ্রিল ১৯৯০ থেকে ২৪ এপ্রিল ১৯৯৮)
* সবচেয়ে বেশিবার এক বর্ষপঞ্জিতে এক হাজার কিংবা তারও বেশি রান (১৭ বার)
* প্রথম এবং এ পর্যনত্ম একমাত্র ব্যাটসম্যান হিসাবে ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ হাজার রান পূর্ণ করা।
* বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ রানের মালিক (১৭৯৬, গড় ৫৭.৯৩)।
* বিশ্বকাপে সবচেয়েৎ বেশিবার ম্যান অব দি ম্যাচ (৮ বার, ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে হয়েছিলেন টুর্নামেন্ট সেরা ) ।
* বিশ্বকাপের এক আসরে সবচেয়ে বেশি রান ( ২০০৩ বিশ্বকাপে ৬৭৩)।
* যেকোন উইকেটে সর্বোচ্চ পার্টনারশিপ ( ২য় উইকেটে রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে ৩৩১ রান) ।
* তৃতীয় উইকেটে সর্বোচ্চ পার্টনারশিপ ( রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে ২৩৭* রান)।
* উদ্বোধনী জুটিতে সবচেয়ে বেশি রান ( গাঙ্গুলীর সঙ্গে ৬৬০৯) ।
* জুটি বেঁধে সবচেয়ে বেশি রান (গাঙ্গুলীর সঙ্গে, ৮২২৭)।
* সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ (গাঙ্গুলীর সঙ্গে ২৬টি)।
* প্রথম ব্যাটসম্যান হিসাবে ১০ হাজার, ১১, ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ এবং ১৭ হাজার রান পূর্ণ করেছেন।
* টেস্ট খেলুড়ে সব দেশের বিপৰেই সেঞ্চুরি।
* বড় সব দলের বিরম্নদ্ধে ১ হাজার রান।

বহুরূপী শচীন

বাঁ হাতি ॥ ব্যাট করেন ডান হাতে। বলও । কিন্তু খেয়াল করেছেন শচীন ভক্তদের অটোগ্রাফ দেন বাঁ হাতে।
ছদ্মবেশী ॥ তারকা খ্যাতি সবকিছুই বদলে দেয়। শচীনও ব্যতিক্রম নয়। ভক্তদের হাত থেকে বাঁচতেই মাঝে মধ্যে পরচুলা পরে, ছদ্মবেশ নিয়ে সিনেমা কিংবা শপিংয়ে বের হন শচীন।
কুসংস্কার বিশ্বাসী ॥ বেশির ভাগ ক্রীড়াবিদদের মতো কিছু কুসংস্কার মেনে চলেন শচীনও। সবচেয়ে উলেস্নখযোগ্যটি হলো বাঁ পায়ের প্যাড সব সময়ই আগে পরেন।
ব্যবসায়ী ॥ মাঠের বাইরে ব্যবসায়ী হিসাবেও সফল শচীন। মোট তিনটি রেস্টুরেন্টের মালিক তিনি। মুম্বাইয়ের কোলাবা ও মুলন্দে রেস্টুরেন্ট দু'টির নাম ' 'তেন্ডুলকরস' ও 'শচীনস'। ব্যাঙ্গালোরেরটির নামও 'শচীনস'।
সেবক ॥ মুম্বাইভিত্তিক এনজিও 'আপনালয়ে'র মাধ্যমে প্রতিবছর ২০০ সুবিধাবঞ্চিত শিশুর ভরণপোষণ করেন তেন্ডুলকর। এর সাথে যুক্ত আছেন তার শাশুড়ি অ্যানাবেন মেহতাও।

No comments

Powered by Blogger.