শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে মুখর বিএনপি by কাফি কামাল

শাহবাগে প্রতিবাদী তরুণদের আন্দোলন নিয়ে মুখর হয়ে উঠেছে বিএনপি। প্রতিবাদের মূল স্পিরিটকে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি কিছু জাতীয় ইস্যু যুক্ত আন্দোলনের পরিধি বাড়ানোর আহবান জানিয়েছে দলটি।
সরকার যাতে আন্দোলনকে দলীয়করণ করতে না পারে সে ব্যাপারে প্রতিবাদী তরুণদের সতর্ক থাকার পরামর্শও দিয়েছেন দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরামের নেতারা। শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে এক বিবৃতিতে আন্দোলনের পরিধি বাড়ানোর আহ্বানের পাশাপাশি সরকারের ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছে বিএনপি। বিবৃতি বলা হয়েছে, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকার-ব্যবস্থা সংবিধানে বহাল, বিরোধী নেতাকর্মীদের গুম-গুপ্তহত্যা, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, সরকারের লুটপাটের ইস্যুগুলো তরুণদের মুখে উচ্চারিত হলে সারা দেশের মানুষের কাছে তরুণদের দাবি আরও গ্রহণযোগ্য ও যথার্থ হয়ে উঠত। দেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন, সীমান্তে বাংলাদেশী হত্যায় সরকারের নির্লিপ্ততার প্রতিবাদ করলে দল-মত নির্বিশেষে একটি অভিন্ন মাত্রা ও সর্বব্যাপী রূপ পেতো। প্রতিটি আন্দোলন সফল হয় উচ্চ নৈতিকতার মাত্রা যোগ হলে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন করার ‘অশুভ অভিপ্রায়’ নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার শাহবাগ চত্বরকে ব্যবহার করার চক্রান্ত করছে। কিন্তু বিএনপি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ্য করছে, তরুণদের এই দাবি মহলবিশেষ দলীয়করণ করার সর্বাত্মক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তরুণদের উচ্ছ্বাসকে একদলীয় অখণ্ড কর্তৃত্বাধীন করার জন্য ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী রাষ্ট্রক্ষমতাকে ব্যবহার করে বিভিন্ন ধরনের কুটিল ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি নীল-নকশায় তরুণদের এই আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করার বিষয়টি ইতিমধ্যে জনগণের চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। প্রতিবাদী কিশোরী লাকী আক্তারের ওপর ছাত্রলীগের হামলা, মঞ্চ থেকে আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীদের মুখে কয়েকটি গণমাধ্যম বন্ধ ও বুদ্ধিজীবীদের হুমকির মধ্যদিয়ে ’৭৫-এর একদলীয় ফ্যাসিবাদের সু¯পষ্ট প্রতিধ্বনি পাওয়া যাচ্ছে। আন্দোলনের এক সপ্তাহের মাথায় সোমবার এ বিবৃতির মাধ্যমে আন্দোলনের ব্যাপারে আনুষ্ঠানিকভাবে নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করে বিএনপি। যদিও শাহবাগের আন্দোলন নিয়ে প্রথম কয়েকদিন নীরব ছিল দলটি। আন্দোলন শুরুর পর অনুষ্ঠিত বৈঠকে আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি ও সরকারের ভূমিকা পর্যবেক্ষণ এবং আপাতত নীরব থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল স্থায়ী কমিটি। সভা-সমাবেশ এমনকি গণমাধ্যমের কাছেও এ প্রসঙ্গ এড়িয়েছেন তারা। ৮ই ফেব্রুয়ারি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধাঞ্জলী শেষে দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা আলমগীর জনগণ আজ জেগে উঠেছে। জনগণের আন্দোলন শুরু হয়েছে। পরেরদিন ৯ই ফেব্রুয়ারি ১৮ দলের পূর্বঘোষিত একটি কর্মসূচি স্থগিত করার মাধ্যমে কৌশলে শাহবাগের আন্দোলনের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে বিএনপি। সেদিন ১৮ দলের মঞ্চ থেকে জোটের শরিক দল জামায়াতের নেতারা যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেবেন তাই অনুমতি না পাওয়ার অজুহাতে কর্মসূচিটি স্থগিত করে বিএনপি। একই দিন বিএনপির বিক্ষোভ মিছিল পূর্ব সমাবেশে শাহবাগের ব্যাপারে প্রথম মুখ খোলেন দলের ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা। শাহবাগের প্রতিবাদী তরুণদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, শাহবাগে বেশকিছু তরুণের আহ্বানে যে সমাবেশ চলছে, সেখানে তারা যে দাবির কথা তুলে ধরছেন; মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল হিসেবে সমাবেশের তরুণদের দেশপ্রেমবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের আবেগকে সম্মান করি। আন্দোলনের প্রতি আমাদের সম্মান আছে। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের সঙ্গে নির্দলীয় সরকারের দাবিটিও সম্পৃক্ত করার জন্য আমি তাদের প্রতি বিনীত আহবান জানাচ্ছি। কারণ আজ বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা হচ্ছে মানুষের ভোটাধিকার খর্ব করে শেখ হাসিনা একদলীয় সরকার-ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে চান। এটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ১০ই ফেব্রুয়ারি জাতীয় প্রেস ক্লাবে একটি অনুষ্ঠানে সাদেক হোসেন খোকা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণ প্রজন্ম শাহবাগে আন্দোলন করছে। কিন্তু সরকার এই আন্দোলন নিয়ে ভাওতাবাজি করছে। অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলে খোকা বলেন, যার অপরাধ কম তাকে বেশি সাজা এবং যার অপরাধ বেশি তাকে কম সাজা দিয়ে ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। যে বিচার কাজ চলছে তাতে কয়েকটা লোককে ফাঁসি দিয়েই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন করা যাবে না। এদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে আরেকটি অনুষ্ঠানে বিএনপি স্থায়ী কমিটির এক সদস্য ব্রিগেডিয়ার (অব.) আসম হান্নান শাহ বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগে চলমান আন্দোলন সরকারের দ্বৈত চরিত্রের নাটক। পরদিন ১১ই ফেব্রুয়ারি বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ শাহবাগের আন্দোলন ও সে আন্দোলনের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনের প্রেক্ষাপটে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের পদত্যাগ উচিত বলে মন্তব্য করেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনা সভায় তিনি বলেছেন, ট্রাইব্যুনালের ওপর নতুন প্রজন্ম আর সংসদে প্রধানমন্ত্রী যে অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন, সে প্রেক্ষাপটে ট্রাইব্যুনালের বিচারকদের পদত্যাগ করা উচিত হবে। তরুণ প্রজন্ম প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছে, ট্রাইব্যুনালের রায়ের ওপর তাদের আস্থা নেই। তাদের সে দাবির প্রতি প্রধানমন্ত্রীর পূর্ণ সমর্থনে সরকারের স্ববিরোধিতা ও দ্বিমুখী নীতি মানুষের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। ফলে বর্তমান পরিস্থিতিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে বিচারকেরা আর স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কর্তব্য পালন করতে পারবেন না। এখন তাঁরা যে রায়ই দেবেন, তা কোন পক্ষের কাছেই গ্রহণযোগ্য হবে না। এদিন ছাত্রদলের এক কর্মসূচি থেকে বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস শাহবাগের প্রতিবাদী তরুণদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। বলেছেন, শাহবাগের সমাবেশেও সরকার দলীয় করতে চাইছে। এ সমাবেশে আওয়ামী লীগ ঢুকে দেশবাসীকে যেন বিভ্রান্ত না করতে পারে সেজন্য নতুন প্রজন্মকে সতর্ক থাকতে হবে। একই সঙ্গে তিনি এ আন্দোলনে তত্ত্বাবধায়ক পুনর্বহাল ইস্যুটি যোগ করার আহ্বান জানান প্রতিবাদী তরুণদের। একই দিন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ জয়নুল আবদিন ফারুক শাহবাগ আন্দোলনের তমা, লাকীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা খুশি হতাম, যদি তমা-লাকীরা এ সরকারের চার বছরে বিএনপির ১৬ হাজার নেতাকর্মী হতাকাণ্ডের বিচার চাইতো।

No comments

Powered by Blogger.