শাহবাগের ডাকে সব মানুষের সংহতিঃ তিন মিনিট দাঁড়িয়ে থাকল বাংলাদেশ

ঘড়ির কাঁটায় বিকেল তিনটা ঊনষাট মিনিট। শুরু হয় কাউন্ট ডাউন। শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে সবাই দাঁড়িয়ে যান যার যার স্থানে।
নিরাপত্তার চাদরে প্রজন্ম চত্বর
শাহবাগ চত্বরের অবস্থান কর্মসূচি পালনকারীদের সার্বিক নিরাপত্তা দিতে গতকাল নিরাপত্তাকে আরও জোরদার করা হয়েছে। সোমবার ৩২টি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসিয়ে পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি অবিরাম পাহারায় নিয়োজিত রয়েছে আইনশৃঙ্খলা মঞ্চ থেকে মাইকে গুণতে থাকেন ঊনষাট, আটন্ন, সাতান্ন... তিন, দুই, এক। ঘড়ির কাঁটা যতই চারটার দিকে গড়াচ্ছে ততই বাড়ছে উপস্থিত হাজারও জনতার সময় গণনার উচ্চাওয়াজ। চারটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে হঠাৎ স্তব্দ হয়ে যায় শাহবাগের মুখরিত চত্বর। তিন মিনিটের জন্য থমকে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। উপস্থিত হাজার হাজার জনতা হাত উঁচু করে দাবি আদায়ে তিন মিনিট পিনপতন নীরবতা পালন করেন। শিশু-বৃদ্ধ, নারী-পুরষ সব স্তরের হাজারও মানুষ নীরবতা পালন করেন। শাহবাগ থেকে যতদূর চোখ যায় ততদূরই দেখা যায় শুধু আকাশপানে উঁচু করা হাত আর হাত। এরপর আবারও প্রকম্পিত হয়ে ওঠে সেই চিরচেনা 'জয় বাংলা' সস্নোগানে। একই দৃশ্যের খবর আসে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা, দিনাজপুর, রংপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া সব জেলা-উপজেলা-গ্রামসহ সারা বাংলাদেশ থেকে।
জামায়াত নেতা কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসির দাবিতে সারাদেশের মতো গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে চারটায় এভাবেই নীরবতা পালনের প্রতিবাদী কর্মসূচি পালন করেন শাহবাগ এলাকার বিক্ষুব্ধ জনতা। গত সোমবার বিকেলে বস্নগার অ্যান্ড অনলাইন এক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ডা. ইমরান এইচ সরকার সারাদেশে বিকেল চারটা থেকে তিন মিনিট দাঁড়িয়ে নীরবতা পালনের কর্মসূচির ঘোষণা দেন। কর্মসূচি পালনে শাহবাগ প্রজন্ম মঞ্চে উপস্থিত হন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, শিক্ষাবিদসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। চারটা বাজার আগেই এখানে উপস্থিত হয়ে কর্মসূচিতে যোগ দেন জাতীয় সংসদের ডেপুটি স্পিকার শওকত আলী, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, পররাষ্টমন্ত্রী ডা. দীপু মনি, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, ডাকসু'র সাবেক ভিপি মাহফুজা খানম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও টিএসসি এলাকাতেও উপস্থিত সবাই পালন করেন প্রতিবাদী নীরবতা। এ এলাকার যারা শাহবাগ চত্বরে অংশ নিতে পারেননি তারা গাড়ি, বাড়ি ও অফিসে যে যেখানেই ছিলেন তরুণদের এ কর্মসূচিতে একাত্মতা পোষণ করে দাঁড়িয়ে তিন মিনিট নীরবতা পালন করেন। টিএসসিতে গিয়ে উপস্থিতদের সঙ্গে কথা বলে এ কথা জানা যায়।
এদিকে প্রতিদিনের মতো সন্ধ্যায় একই দৃশ্য দেখা যায় শাহবাগ চত্বরে। বিভিন্ন সংগঠনের নেতারাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে মশাল মিছিল নিয়ে আলোর মোহনায় পরিণত করেন এ এলাকা। মশালের অগি্নস্ফুলিঙ্গের মতো মুখে ঝরে তাদের দাবির অকুতোভয় গর্জন। সস্নোগান ধরেন, একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে ওঠো আরেকবার, ফাঁসি ফাঁসি ফাঁসি চাই, সব রাজাকারের ফাঁসি চাই'। সন্ধ্যায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা মশাল মিছিল নিয়ে শাহবাগের মোহনায় যোগ দেন।
সারারাত অবস্থান কর্মসূচি পালনকারীদের সঙ্গে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে যোগ দেন হাজার হাজার প্রতিবাদী জনতা। দুপুর গড়াতেই তীব্র হতে থাকে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সস্নোগান ও প্রতিবাদী গান-কবিতাসহ নানা কর্মসূচিতে দাবি আদায়ের কর্মসূচি। এতে প্রতিদিনের মতো যোগ দেন বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যক্তিরাও সংহতি জানিয়ে অংশ নেন এসব কর্মসূচিতে।
এক সময় শুধু শাহবাগ চত্বরে শুরু হওয়া অবস্থান গতকালও ছাড়িয়ে যায় ঢাবি চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে টিএসসি, বারডেম হাসপাতাল হয়ে রূপসী বাংলা হোটেল এলাকা, আজিজ সুপার মার্কেট হয়ে কাঁটাবন ও শিশুপার্ক হয়ে মৎস্য ভবন এলাকা পর্যন্ত।
বিকেলে চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে দেখা যায়, সাংস্কৃতিক সংগঠন তীরন্দাজ'র আয়োজনে রাজাকারদের নির্মূলে বন্দুক চালানোর মহড়া। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে উপস্থিতরা বোর্ডে সাঁটানো ছোট ছোট বেলুন লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন।
সেখানে লাইনে দাঁড়ানো শারমিন আহমেদের সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, '৭১-র মুক্তিযুদ্ধে বীর বাঙালিরা দেশকে মুক্ত করার জন্য রাইফেল হাতে নিয়েছিল। আজ আমরা সেই যুদ্ধে যারা তাদের সঙ্গে বিরোধিতা করে পাক বাহিনীকে সহায়তা করেছিল তাদের নির্মূলে এ রাইফেল হাতে নিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা চাই এ দেশে কোন যুদ্ধাপরাধীর চিহ্নও যেন না থাকে।
এদিকে সাড়ে এগারোটার দিকে প্রজন্ম চত্বরে সংহতি জানাতে আসেন জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত। তরুণদের আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৪২ বছর পর এই প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধারা যে পথ দেখাল, আমি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। তিনি এ সময় রাজাকারের ফাঁসি, রাজাকারমুক্ত বাংলাদেশ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ, ধর্ম যার যার রাষ্ট্র সবার, মৌলবাদের অর্থনীতির যে ভিত গড়ে উঠেছে তা বয়কটের কথা বলেন। পরে আবুল বারকাতের লেখা 'বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক অর্থনীতি' বইটির ১০ হাজার কপি বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়।
এছাড়া সংহতি জানান চলচ্চিত্র পরিচালক তানভীর মোকাম্মেল। তিনি আন্দোলনকারী তরুণ প্রজন্মকে এ আন্দোলন অব্যাহত রাখার জন্য ধন্যবাদ জানান।
আন্দোলনে সংহতি জানাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগ ও দর্শন বিভাগসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে দলে দলে যোগ দেন এ আন্দোলনে। উদয়ন স্কুল, হলিক্রস কলেজ, ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও আসেন এ প্রজন্ম চত্বরে।রক্ষাকারী বাহিনীর পাঁচশ' সদস্য।
প্রতিনিয়ত আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তারা সতর্ক পাহারায় আছেন বলে জানান র‌্যাবের সিনিয়র এএসপি কুদরত-ই-খুদা। তিনি জানান_ পুলিশ, র‌্যাব, ডিবি সদস্যরা সব সময় সবাইকে নজরে রাখার চেষ্টা করছেন। শুধু এসব সদস্যই নন, সঙ্গে আছে অর্ধশত সিসি ক্যামেরা ও বাইনোকুলার। এসব যন্ত্রের আড়ালেও অপলক পাহারায় আছেন সদস্যরা। আগতদের গতিবিধি থেকে শুরু করে মুখ-চোখের হাবভাবও লক্ষ্য করা হচ্ছে। কাউকে সন্দেহজনক মনে হলেই আরও বেশি লক্ষ্য রাখা হচ্ছে, যতক্ষণ না সেই ব্যক্তির প্রতি নিঃসন্দেহ হওয়া যায়। তিনি আরও জানান, বিভিন্ন ভবনের ছাদসহ বেশ কয়েকটি স্থানে ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে এসব বিষয় নজরদারি করা হচ্ছে।
লাগাতার আন্দোলনে স্বেচ্ছাসেবা
টানা আটদিন ধরে চলে আসা আন্দোলনের সঙ্গে রাজধানী ছাড়াও দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এসে যোগ দিচ্ছেন শাহবাগ চত্বরের এ আন্দোলনে। দিন-রাত চবি্বশ ঘণ্টা অবস্থানের ফলে অনেকেই শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। আন্দোলনে অংশ নেয়া এসব হাজার হাজার মানুষের বিভিন্ন সেবা দিতে স্বেচ্ছাসেবীরাও এগিয়ে এসেছেন।
আন্দোলনকারীদের প্রাথমিক চিকিৎসা, খাদ্য বিতরণ ও জমায়েতস্থল পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য নিরলস পরিশ্রম করছেন তারা। গণআন্দোলনে আসা আন্দোলনকারীদের প্রাথমিক চিকিৎসা নিশ্চিত করতে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ), রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি, বারডেম হাসপাতালের ইন্টার্নি চিকিৎসক এবং ডক্টর ফর হেলথ অ্যান্ড ইনভায়রনমেন্ট চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। জাতীয় জাদুঘরের মূল গেটে এই সেবামূলক কাজ পরিচালনা করছেন তারা।
ডক্টর ফর হেলথ অ্যান্ড ইনভায়রনমেন্টের সভাপতি অধ্যাপক ড. রশিদী মাহবুব জানান, সমাবেশে যারা অসুস্থ হয়ে পড়ছেন তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছি। বড় সমস্যা দেখা দিলে সে অনুযায়ী ব্যবস্থাপত্র ?ও নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে। তিনি জানান, খাবার স্যালাইনসহ প্রাথমিক সেবার বিভিন্ন ওষুধ বিতরণ করছি আমরা।
সমাবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার জন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ফার্স্ট এইড নানা ধরনের নাগরিক সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। দুটি খাবার পানির গাড়ি, ভ্রাম্যমাণ টয়লেট, অ্যাম্বুলেন্স রাখা হয়েছে জমায়েতস্থলে। সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সুবিধাসহ শিফটিং করে প্রায় শতাধিক ব্যক্তি রাত-দিন নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন সমাবেশে। জাদুঘরের সামনে তথ্য সেল থেকে দেয়া হচ্ছে চিকিৎসা সেবা।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শাহাবুদ্দিন আহমেদ বলেন, আগতরা যাতে কোন ভোগান্তির শিকার না হন, সে ব্যাপারে আমরা সার্বক্ষণিক কাজ করছি। আগতদের প্রাথমিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি। এছাড়া নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে যারা এখানে অবস্থান নিচ্ছেন তাদের জন্য এখানে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন শুকনো খাবার যেমন- কেক, রুটি, বিস্কুট, সিঙ্গাড়া, মোয়া, কলা বিতরণ করছেন।

No comments

Powered by Blogger.