‘এডিরে মানুষ করবাম ক্যামনে’ by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

ওরা এতিম, অসহায়। হতদরিদ্র নিহত আনোয়ার হোসেনের তিন কন্যা শাহিদা, সানজিদা ও মীম। ওরা জানে না ওদের বাবা বেঁচে নেই। মা রীনা বেগমের সঙ্গে বিমানবন্দরে এসেছে ওরা।
দু’বছর বয়সের মীম বলছে ‘বাবা বিদেশ গেছে কাজ করতে। আজ এইন দিয়ে আসবে। বাবাকে নিতে আইছি।’ আর কিছুই বলতে পারছে না। পরিবারটি এতই দরিদ্র যে তাদের তিন বোনের পায়ে কোন জুতাও নেই। ওদের তিন জনের বয়স ৮ বছরে নিচে। মা রীনা বেগমের পরনেও সাধারণ একটা থ্রি পিস। তাই বিমানবন্দরে ওদের প্রতি সকলের দৃষ্টি ছিল অন্যরকম। দেশে থাকাকালীন কুমিল্লা মুরাদনগরের আলীচর গ্রামের নিহত আনোয়ার মাটিকাটার কাজ করতেন। সেদিন উপার্জন হতো সে দিন দু’মুঠো খেতে পারতেন। কোন দিন উপোসও থেকেছেন। এমনই কষ্টে দিন যেতো তাদের। বাড়িঘর নেই। তাই ভাগ্য বদলানোর জন্য ধার-কর্জ করে সাড়ে ৩ লাখ খরচ করে দু’বছর আগে গিয়ে ছিলেন বিভূঁইয়ে। মাসে ৬-৭ হাজার টাকা করে পাঠাতেন তিনি। এমনই কথা বলছেন নিহতের স্ত্রী। আর কিছুক্ষণ পর পর চোখ মুচছেন। বলছেন, আমি এডিরে (তিন শিশুকে) মানুষ করে স্বামীর ছায়ায় রাখতে চাই। আর লাশ গ্রহণের সময় নিহতের স্ত্রী কফিন ছুঁয়েই অজ্ঞান হয়ে পড়েন। অঝোর ধারায় হাইমাউ করে কাঁদতে থাকে তিন শিশু। আরেক নিহত কর্মী মুন্সীগঞ্জের বাশার। তার স্ত্রী মুক্তা লাশ নিতে আসেন। সঙ্গে দুই শিশু মারিয়া ও উর্মি। বুঝছে না ওরা, তাদের আব্বু দুনিয়াতে নেই। স্ত্রী জানান, দু’বছর আগে গিয়েছে। ঋণের ওপর টাকা নিয়ে। পাশে বাশারের পিতা শেখ আলিফ বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছেলের শোকে পাথর হয়ে গেছেন তিনি। ছেলের লাশ নিতে আসা নিহত হাবিবুর রহমানের পিতা কান্না কণ্ঠে মো. মালু মিয়া বলেন, ছেলে পাবো কোথায়। লক্ষ্মীপুর থেকে পিতা মনির হোসেন ছেলে ফারুক হোসেনের লাশ নিতে আসেন। নেত্রকোনার নিহত উজ্জ্বল মিয়ার ভাই রেজাউল মিয়া তার ছোটভাইয়ের কফিন ধরেই বলছেন, ‘ওরে ভাই। তুই কি সুন্দর বক্সের মধ্যে শুয়া আছোছ। এজন্যই কি তোকে বিদেশ পাঠিয়েছি। কথা বল।’ ৭৫ বছরের বৃদ্ধ বাবা সামাদ মোল্যা। ছেলে শাহজাহান মোল্যার লাশ নিতে এসেছেন। সঙ্গে নিহতের স্ত্রী খোদেজা বেগম। স্ত্রী জানান, ‘দু’মাসের মধ্যে আসার কথা ছিল। এসেছে ঠিকই। লাশ হয়ে।’ বিমানবন্দরে স্বজনদের শোকের মাতম। অঝোর ধারায় কাঁদছেন পিতামাতা, ভাইবোন বা স্ত্রী-সন্তানরা। গতকাল দ্বিতীয় দফায় নিহত ১১ জনের লাশ আসে। এ দফায় ১০ জনের লাশ নিয়ে বিজি-০২৮ ফ্লাইট সকাল ১০টা ৩৫ মিনিটে ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। তবে একজনের লাশ এ বিমানই চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে রেখে আসে। বিমানবন্দর ৮ নম্বর গেট দিয়ে একেক করে ১০টি লাশ স্বজনদের হস্তান্তর করা হয়। নিহত ১০ বাংলাদেশীরা হলেন সামাদ মোল্যার ছেলে শাহজাহান মোল্যা, গ্রাম বাগারকান্দি থানা বোয়ালমারী জেলা ফরিদপুর, জহুর উদ্দিন মুন্সীর ছেলে রোকন মুন্সী, গ্রাম চেরাগ আলী থানা সদরপুর জেলা ফরিদপুর, শেখ আলিফের ছেলে বাশার, গ্রাম মদনখালী থানা শ্রীনগর জেলা মুন্সিগঞ্জ, মো. মালু মিয়ার ছেলে হাবিবুর রহমান, গ্রাম হিরাপুর থানা মুরাদনগর, জেলা কুমিল্লা, সুন্দর আলীর ছেলে আনোয়ার হোসেন, গ্রাম আলীর চর থানা মুরাদনগর জেলা কুমিল্লা, আবুল হোসাইনের ছেলে নূর আলম, গ্রাম নারার পাড় থানা মনোহরগঞ্জ জেলা কুমিল্লা, রুহুল আমিনের ছেলে মো. ফারুক হোসাইন, গ্রাম চর ফ্যালকন থানা কমলনগর জেলা লক্ষ্মীপুর, রুজ আলীর ছেলে উজ্জ্বল মিয়া, গ্রাম বাউশি থানা বারহাট্টা জেলা নেত্রকোনা, কাসেম কবিরাজের ছেলে জযনাল কবিরাজ, গ্রাম রামকান্তপুর থানা সদর জেলা রাজবাড়ী, মো. মনির হোসেনের ছেলে ফারুক হোসেন, গ্রাম চরজগবন্ধু থানা কমলনগর জেলা লক্ষ্মীপুর। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে হস্তান্তর হয় আমিনুল হকের ছেলে মো. নূরুল আলম, গ্রাম মধ্যকাঞ্চন নগর থানা ফটিকছড়ি জেলা চট্টগ্রামের লাশ। এর আগে ১০ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে এসেছে ৭ জনের লাশ। নিহতদের প্রত্যেকটি পরিবারকে বিমানবন্দরে লাশ হস্তান্তরের পাশাপাশি ৩৫ হাজার টাকা পরিবহন ও দাফন বাবদ নগদ প্রদান করে সরকার। পরে ওয়ারিশগণের সনদ সাপেক্ষে আরও ২ লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা পাবে বাংলাদেশ সরকার থেকে। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার বাংলাদেশী টাকায় ৪০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। নিহত ২০ জন বৈধভাবে আরব আমিরাতে গিয়েছিলেন। তাই ক্ষতিপূরণ সহজে আদায় করা যাবে বলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছেন। অবৈধভাবে বিদেশ না যাওয়ার সকলের প্রতি অনুরোধ জানান। আজ একজনের লাশ আসবে ভোর ৫টায় বিজি-১০১৮ ফ্লাইটে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে। উল্লেখ্য, ৪ঠা ফেব্রুয়ারির এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০ বাংলাদেশী কর্মী নিহত হয়েছেন। বিমানবন্দরে আরও উপস্থিত ছিলেন সচিব ড. জাফর আহমেদ খান, জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) মহাপরিচালক বেগম শামছুন নাহার, বিএমইটির অতিরিক্ত মহাপরিচালক  মাফরূহা সুলতানা, পরিচালক (কল্যাণ) মু. মোহসিন চৌধুরী ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাবৃন্দ। বিমানবন্দরে নিহতদের রুহের মাগফিরাত কামনা করে দোয়া করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.