বগুড়ায় আজ হরতাল- শিবিরের কেউ নয় নিহত মামুন

বৃহস্পতিবার জামায়াতে ইসলামীর ডাকা হরতাল চলাকালে বগুড়ায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত কলেজছাত্র আবদুল্লাহ আল মামুন (১৭) কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী নয় বলে দাবি করেছে তার পরিবার।
সে বগুড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের তড়িৎ কৌশল বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র। মামুনের বাবা আখের আলী প্রথম আলোকে বলেন, হরতাল শেষে তাঁর ছেলের জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। তার কাছে বাসভাড়া ছিল না। তাই ভাড়ার টাকার জন্য বগুড়া শহরের জামিলনগরে মামাতো ভাই বিদ্যুতের কাছে যায়। ফেরার পথে পুলিশ-র‌্যাবের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে আবদুল্লাহ গুলিবিদ্ধ হয়।
কার গুলিতে মামুন মারা গেছে, তা এখনো নিশ্চিত করে বলতে পারেনি পুলিশ। পুলিশের দাবি অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার ওই সংঘর্ষের সময় শিবিরের কর্মীরা বিভিন্ন বাড়ির ছাদ থেকে র‌্যাব ও পুলিশকে লক্ষ্য করে ককটেল নিক্ষেপের পাশাপাশি গুলিও করেছেন। র‌্যাব-পুলিশও পাল্টা গুলি ও কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে।
এদিকে ময়নাতদন্ত শেষে বৃহস্পতিবার নিহত তিনজনের লাশ গতকাল সকালে নিজ নিজ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। পুলিশি পাহারায় তিনজনের লাশ তাদের নিজ গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়।
মামুন ছাড়া নিহত বাকি দুজন হলেন পোলট্রি ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান (২৮) ও সরকারি আজিজুল হক কলেজের পুরোনো ভবন শাখার ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু রূহানী (২০)। তবে, নিহত তিনজনকে নিজেদের নেতা-কর্মী দাবি করে গতকাল জুমার নামাজের পর বগুড়া শহরের সেন্ট্রাল উচ্চবিদ্যালয় মাঠে গায়েবানা জানাজা পড়েন জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা।
এসব হত্যার প্রতিবাদে আজ শনিবার বগুড়ায় সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডেকেছে জামায়াত। হরতাল সামনে রেখে সব ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বগুড়ার পুলিশ সুপার মোজামেঞ্চল হক।
চার মামলা, আড়াই হাজার আসামি: পুলিশ জানায়, হরতাল চলাকালে তিনজন নিহত ও সহিংসতার ঘটনায় গতকাল শুক্রবার বগুড়া সদর থানায় চারটি মামলা হয়েছে। এ চারটি মামলায় মোট আসামি প্রায় আড়াই হাজার। এর মধ্যে দুটি মামলার বাদী পুলিশ। বৃহস্পতিবার বিকেলে শহরের সাতমাথায় পুলিশের ওপর হামলা, ভাঙচুর, ককটেল নিক্ষেপ, সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ একটি মামলা করে। তাতে জামায়াত-শিবিরের ২৫ নেতা-কর্মীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও এক হাজার ৪০০ জনকে আসামি করা হয়। সন্ধ্যায় জামিলনগরে পুলিশের ওপর হামলা, পলিটেকনিকের ছাত্র মামুনকে হত্যা, সরকারি কাজে বাধা, ভাঙচুর, ককটেল নিক্ষেপের ঘটনায় পুলিশের করা অপর মামলায় জামায়াত-শিবিরের ৩৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও এক হাজার জনকে আসামি করা হয়।
বাকি দুটি মামলার মধ্যে ছাত্রশিবিরের নেতা আবু রূহানিকে হত্যার ঘটনায় তাঁর ভগ্নিপতি মো. হারুনুর রশীদ বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আট-দশজনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। আর, নিহত ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানের স্ত্রী হালিমা আক্তার বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা আট-দশজনকে আসামি করে অপর মামলাটি করেন।
এ ছাড়া বৃহস্পতিবার সংঘর্ষের পর জামায়াত-শিবির সন্দেহে ২৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদেরকে পুলিশের করা দুটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে বলে থানা সূত্র জানিয়েছে।
‘পায়েস নিয়ে বসে আছি, ছল হামার আসে না’: নিহত মামুনের গ্রামের বাড়ি কালাই উপজেলা সদরের থানা পাড়া এলাকায়। সে বগুড়া শহরের সবুজবাগ এলাকার শাহ সুলতান নামের একটি ছাত্রাবাসে থেকে পড়াশোনা করত। তার বাবা আবদুল আখের আলী কালাই পৌর বাজারের সবজির ব্যবসা করেন।
গতকাল সকালে কালাইয়ের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মামুনের মা ওলেদা বেগম ছেলের পোশাক নিয়ে বিলাপ করতে করতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। ওলেদা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বুধবার রাত সর্বশ্যাষ মোবাইল ফোনে ছলডার সাথে কতা হলো, ‘‘মামুন কয়, মা বৃহস্পতিবার বাড়ি আসছি, তোমার হাতে পায়েস খাব।’’ পায়েস রান্না করে বসে আছি। ছল হামার (ছেলে আমার) আসে না, একন এ পায়েস হামার কে খাবে।’
বাবা আখের আলী বলেন, ‘ছেলেটার খুব স্বপ্ন ছিল, ইঞ্জিনিয়ার হয়ে সংসারে অভাব ঘোচাবে। এ জন্য পলিটেকনিকে ভর্তি হয়েছিল। পড়ার খরচ ঠিকমতো দিতে পারতাম না। বৃহস্পতিবার ওর বাড়ি আসার কথা ছিল। কিন্তু হাতে টাকা ছিল না। বাসভাড়ার টাকা নিতে বিকেলে জামিলনগরে ওর মামাতো ভাইয়ের কাছে যায়। ফেরার পথে পুলিশ-র‌্যাবের সঙ্গে শিবিরের বন্দুকযুদ্ধের মাঝখানে পড়ে গুলি লেগে মারা যায় ও।’
মামুনকে শিবিরের কর্মী দাবি প্রসঙ্গে আখের আলী বলেন, ‘আমার মরা সন্তানকে নিয়ে কেউ কেউ রাজনীতি শুরু করেছে। নিরীহ একটা ছেলেকে শিবির কর্মী বলা হচ্ছে।’ একই কথা বলেন কালাই থানা সদরে মামুনদের প্রতিবেশী ও পৌর কাউন্সিলর আমিনুল ইসলামও।
মিজানুরকে নিয়েও রাজনীতি: গতকাল জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে ব্যবসায়ী মিজানুর রহমানের লাশ বুঝে নেন তাঁর স্ত্রী হালিমা বেগম। মিজানুর কোনো দলই করতেন না বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘স্বার্থসিদ্ধির জন্য তারা (জামায়াত) আমার নিরীহ স্বামীকে নিয়ে নোংরা রাজনীতি করছে।’
মিজানুর কুমিল্লার তিতাস উপজেলার উত্তর মানিকনগর গ্রামের আবু কালামের ছেলে। তিন-চার বছর আগে বগুড়া শহরের সাবগ্রাম বাজারের পাশে একমাত্র ছেলে নিষাদের নামে পোলট্রি হ্যাচারির দোকান দেন মিজানুর। বৃহস্পতিবার বিদ্যুৎ বিল দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজের জন্য ৩০ হাজার টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হন তিনি।
স্ত্রী হালিমা বেগম বলেন, ‘ওই টেকাটায় তাঁর জন্য কাল হলো। গুন্ডারা তাক খুন করে ওই টেকা আর মোবাইল নিয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘জামায়াত বুঝি না, বিএনপি বুঝি না, আওয়ামী লীগ বুঝি না। হামার নিরপরাধ, নির্দোষ স্বামীটাকে ওরা কেন খুন করল, ওই গুন্ডাদের ফাঁসি চাই।’
দাবিতে অনড় জামায়াত: জেলা জামায়াতের নায়েবে আমির আলমগীর হোসাইন গতকালও প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, মিজানুর দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। জামায়াত করার অপরাধেই ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তাঁকে হত্যা করেছে। তাঁর স্ত্রী যা বলছেন, সেটা তাঁর নিজের কথা। তিনি আরও দাবি করেন, মামুন ছয় মাস ধরে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। শিবির করার অপরাধে পুলিশ তাঁকে গুলি করে হত্যা করেছে।
তবে বগুড়ার পুলিশ সুপার বলেন, নিহত মিজানুর একজন নিরীহ ব্যবসায়ী। মামুন সাধারণ ছাত্র। তাঁরা কেউ জামায়াত-শিবিরের কর্মী নন।

No comments

Powered by Blogger.