প্রজন্ম চত্বরে শপথের প্রতিটি দাবি পূরণে সব কিছুই করব- আবেগাপ্লুত কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রীর অভিনন্দন

 প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় প্রদানের ক্ষেত্রে দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা বিবেচনায় নেয়ার জন্য ট্রাইব্যুনালের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।
যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলন ও দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তিনি বলেন, বিচারের রায় দেবে ট্রাইব্যুনাল। আইন দেখেই চলবে। তবে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকে যেন বিবেচনায় নেয়া হয় সেটা আমাদের অনুরোধ থাকবে। আমরাও চাই যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক। আমার জীবন দিয়ে হলেও বাংলার মাটিতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবই।
রবিবার জাতীয় সংসদে পয়েন্ট অব অর্ডারে অনির্ধারিত বিতর্কের সর্বশেষ বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শাহবাগ প্রজন্ম চত্বরে আন্দোলনরত নতুন প্রজন্মের সন্তানদের অভিবাদন জানিয়ে বলেন, মহাসমাবেশে নতুন প্রজন্মরা যে শপথ নিয়েছে তার প্রতিটি বাক্যে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত, জাতীয় সংসদের পক্ষ থেকে আমরা পূর্ণ সমর্থন জানাই। শপথের প্রতিটি দাবি বাস্তবায়নে যা যা করার আমরা তাই করব। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের কোন দুর্বলতা থাকে অবশ্যই আমরা তা সংশোধন করব। কিন্তু যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যাতে সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণভাবে সমাপ্ত করা যায় সেই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তিনি দেশবাসীর প্রতি আহ্বানও জানান। তরুণ প্রজন্মের অভূতপূর্ব গণজাগরণে অবিভূত প্রধানমন্ত্রী আবেগজড়িত কণ্ঠে বলেন, নতুন প্রজন্মের যে অভূতপূর্ব প্রতিবাদ ও গণজাগরণ দেখেছি- তাতে আমি অবিভূত। এখন আমি স্বস্তি ও শান্তিতে মরতে পারব। নতুন প্রজন্মের সন্তানরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যেভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে- তা দেখে আমার স্বস্তি যে এতদিনের আমার আন্দোলন-সংগ্রাম ও পথচলা সার্থক হয়েছে। এখন আমার মৃত্যু হলেও শান্তি পাব। বাংলাদেশ সঠিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের মাটিতে কোন স্বাধীনতাবিরোধীদের ঠাঁই হবে না। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ে আর কেউ ছিনিমিনি খেলতে পারবে না।
আন্দোলনরতদের পক্ষ থেকে দেয়া স্মারকলিপির দাবির সঙ্গেও একাত্মতা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তরুণ প্রজন্ম স্পীকারের কাছে যে স্মারকলিপি দিয়েছে সেখানে থাকা সকল দাবির সঙ্গেও জাতীয় সংসদের প্রতিটি সংসদ সদস্য একমত। নতুন প্রজন্মের সন্তানরা গণজাগরণ সৃষ্টি করে বাংলাদেশের ঘুমন্ত মানুষকে যেভাবে জাগিয়ে তুলেছে, তাদের আশ্বস্ত করে বলতে চাই- বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবেই। এই নতুন প্রজন্মরাই আগামীতে দেশের নেতৃত্ব দেবে। এই নতুন প্রজন্মরাই বাংলাদেশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় গড়ে তুলবে।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, নির্বাচনের আগে আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ক্ষমতায় গেলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব। ক্ষমতায় এসেই আমরা সংসদে আইন পাস করি। মার্শাল অর্ডিন্যান্স জারি করে জেনারেল জিয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়েছিল, সেই অর্ডিন্যান্স সংশোধন করে ২০১০ সালে আমরা সংসদে আইন পাস করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু করি। আজ বিচারের রায় প্রদান শুরু হয়েছে।
শাহবাগের গণবিস্ফোরণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ সারাবিশ্বে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন না ঘটলে নতুন প্রজন্মরা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারত না। তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আজ অভূতপূর্ব গণজাগরণ সৃষ্টি করেছে। তা সারাদেশে আজ ছড়িয়ে পড়েছে। কোন দল বা গোষ্ঠী নয়, দলমত নির্বিশেষে সবাই আজ স্বাধীনতার চেতনায় জেগে উঠেছে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনর্প্রতিষ্ঠা করতে গত ৩০/৩৫ বছর ধরে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। অনেক ঘাত-প্রতিঘাত ও বার বার আমাকে হত্যার প্রচেষ্টার পরও পিছপা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস যেন দেশের প্রতিটি মানুষ জানতে পারে, স্বাধীনতার সুফল প্রতিটি মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছাতে আমার দীর্ঘ সংগ্রাম আজ সার্থক হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন আর শাহবাগ চত্বর বলে কিছু নেই, তরুণ প্রজন্ম চত্বর হয়ে গেছে। শাহবাগের নামের সঙ্গে পাকিস্তান পাকিস্তান গন্ধ আছে। আর শাহবাগ নামে সেখানে একটি হোটেল ছিল। সেই অনুযায়ী এলাকার নাম শাহবাগ হয়। সেখানে তরুণ প্রজন্মরা যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে তাই ওই এলাকার নাম তরুণ প্রজন্ম চত্বর হওয়া উচিত।
আন্দোলনরত নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনের পাশাপাশি পড়াশুনাসহ অন্যান্য সব কাজও চালিয়ে যেতে হবে। তোমরা আগামী দিনে দেশের নেতৃত্ব দেবে। পড়াশোনা করে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। তাই একটি সময় নির্দিষ্ট রেখে আন্দোলন অব্যাহত রাখ। তিনি বলেন, তরুণ সমাজ আজ জেগে না উঠলে সারাদেশের মানুষ এভাবে জেগে উঠত না। আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, একদিন বাবা-মা, তিন ভাই, দুই ভাইবৌসহ সবাইকে হারিয়েছি। বুক ভরা ব্যথা নিয়েও বাংলার জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমার একটাই লক্ষ্য, স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তুলব, স্বাধীনতার সুফল জনগণের ঘরে ঘরে পৌঁছে দেব। ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলব।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছিলেন। ওই সময় অনেক যুদ্ধাপরাধী কারাগারে বন্দী ছিল, অনেকেই পাকিস্তানসহ অনেক দেশে পালিয়ে গিয়েছিল। সংবিধান সংশোধন করে স্বাধীনতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি ও ভোটাধিকার বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পথ বন্ধ করে দিয়ে কারাগার থেকে মুক্তি দিয়ে, বিদেশে পালিয়ে থাকা যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে এনে নাগরিকত্ব দিয়ে রাজনীতিসহ সর্বত্র পুনর্বাসন করেন জেনারেল জিয়া। সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করে যুদ্ধাপরাধীদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও উপদেষ্টা করা হয়, লাখো শহীদের রক্ত¯œাত জাতীয় পতাকা তুলে দেয়া হয়। তখন পরাজিত শত্রুরাই ক্ষমতায়, আমরা যারা যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছি তারাই মনে হয় পরাজিত।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫-এর পর দেশে আসতে পারিনি। ’৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করতে গিয়ে বার বার বাধার সম্মুখীন হয়েছি। অনেকবার গুলি ও গ্রেনেড মেরে আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমাকে দমাতে পারেনি। তিনি বলেন, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফকে আমি বলেছিলাম যে, আমরা আপনাদের ক্ষমা করতে পারি কিন্তু ভুলতে পারব না। কেননা মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের ওপর তারা যে গণহত্যা, নির্যাতন ও মা-বোনদের ইজ্জত কেড়ে নিয়ে নিয়েছে তা কখনও ভোলার নয়। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই হচ্ছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদেরও খুঁজে খুঁজে বিচার করা হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে নতুন প্রজন্ম যেভাবে জেগে উঠেছে, এ বিচার হবেই। কোন শক্তিই এ বিচারকে বানচাল করতে পারবে না।

No comments

Powered by Blogger.