সংসদে মেনন সাকা মুখোমুখি

সংসদ রিপোর্টার॥ জাতীয় সংসদের সাবেক দুই স্পীকারের পুত্র ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর প্রাণবনত্ম বাকযুদ্ধ হয়েছে।
একে অপরকে যুক্তিতর্ক দিয়ে ধরাশায়ী করার চেষ্টা করলেও তাঁদের বক্তব্যে ছিল না কোন ব্যক্তি আক্রমণ, খিস্তি-খেউড় বা অসংসদীয় কোন ভাষা।
মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির আলোচিত-সমালোচিত নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করায় সর্বোচ্চ আদালতের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, সুপ্রীমকোর্টের কাছে আইন সভা (সংসদ) আজ আত্মসমর্পণ করেছে। সংসদের কোন আইন হাইকোর্ট বাতিল করতে পারে না। নানাভাবেই সর্বোচ্চ আদালত আইনসভার ওপর নগ্ন হেস্তক্ষেপ করছে। এভাবে চলতে পারে না। জবাবে রাশেদ খান মেনন পঞ্চম সংশোধনী বাতিলে হাইকোর্টের রায়কে ঐতিহাসিক উল্লেখ করে বলেন, দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে জিয়াউর রহমানের আনা পঞ্চম সংশোধনীর বিরোধিতা করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছিলেন। আজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে নিজামী-মুজাহিদসহ ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কায় পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের বিরোধিতা করছেন। তিনি অবিলম্বে সংসদে বিল এনে পঞ্চম সংশোধনীটি আইনে পরিণত করে '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। একইসঙ্গে পঞ্চম সংশোধনীর পাশাপাশি ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম সংশোধনীও বাতিলের দাবি জানান।
রাশেদ খান মেনন, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ছাড়াও মঙ্গলবার রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর আরও আলোচনা করেন আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরম্নল ইসলাম, খালেদ মাহমুদ চৌধুরী, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, মহিবুর রহমান মানিক, ইছাহাক হোসেন, শাহিদা তারেক দীপ্তি, পারভীন তালুকদার, আবদুল ওয়াদুদ, বিএনপির বরকতউলস্নাহ বুলু ও আশরাফ উদ্দিন নিজাম।
সাবেক দুই স্পীকারের পুত্রের জমজমাট বিতর্কের মাঝপথে স্পীকার এ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বলেন, রাশেদ খান মেননের পিতা আবদুল জব্বার খান এবং সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরী জাতীয় সংসদের স্পীকার ছিলেন। আমি এখন স্পীকারের আসনে। সাবেক দুই স্পীকারের পুত্রের বিতর্ক দেখে ভালই লাগছে।
আলোচনায় অংশ নিয়ে বিএনপির আলোচিত-সমালোচিত নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, জাতি আজ দু'টি মেরম্নতে ভাগ হয়ে গেছে। স্বাধীনতা আন্দোলনে শেখ মুজিবের অবিস্মরণীয় অবদান অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। ইতিহাসে তাঁর অবদান ছিল, বর্তমানে আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। তেমনি জিয়াউর রহমানের অবদান আগেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু একজনকে বড় করতে গিয়ে জিয়াকে খাটো করে দেখার প্রবণতা চলছে।
পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ৩১ বছর ধরে সংসদে আছি। দুর্ভাগ্য হচ্ছে আজ আইন প্রণয়নের ৰমতা চলে গেছে সুপ্রীমকোর্টে। জুডিশিয়ালের কাছে আত্মসমর্পণ শেখ মুজিবও হয়ত তাঁর কন্যার কাছে আশা করেনি। তেমনি সুপ্রীমকোর্টের কাছে আইনসভার আত্মসমর্পণও ব্যর্থতাই প্রমাণ করে। তিনি বলেন, আইনসভার ওপর সর্বোচ্চ আদালতের নগ্ন হসত্মৰেপ চলছে। কিন্তু সংসদই হচ্ছে সর্বোচ্চ আাদালত। এর ওপর কোন আদালত নেই। প্রশ্ন রেখে সাকা চৌধুরী বলেন, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এবং '৭০-এ আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে ধর্মনিরপেৰতা বলে কোন শব্দ ছিল না। প্রতিবেশী একটি দেশের চাপে হঠাৎ করেই ড. কামালরা এটা এনেছেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিবই দুর্নীতির চ্যাম্পিয়নশিপ আওয়ামী লীগের ওপর অর্পণ করে গেছেন। বিসমিলস্নাহকে শেখ মুজিবই স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, অভিযোগ করা হয়, জিয়ার কবরে নাকি লাশ নেই। '৭৫-এর ১৫ আগস্টে হত্যাকা-ে হিন্দুসত্মানের কর্তাব্যক্তিরা কীভাবে মোশতাকের সঙ্গে হেসে কথা বলেছেন, তা বোধ হয় প্রধানমন্ত্রী দেখেননি। খুনী বিএনপির মধ্যে খুঁজে লাভ নেই, নিজেদের মধ্যে খুঁজুন।
জবাবে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, জিয়াউর রহমানের পঞ্চম সংশোধনীর প্রতিবাদে দ্বিতীয় সংসদে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী শুধু বিরোধিতাই করেননি, আমার সঙ্গে ওয়াকআউটও করেছিলেন। কিন্তু আজ পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করায় উচ্চ আদালতের ওপর তিনি মহাৰ্যাপা। সুপ্রীমকোর্টের রায়কে ঐতিহাসিক উলেস্নখ করে বলেন, এই রায় গণতন্ত্রের জন্য মাইলফলক। তিনি বলেন, এখন সংসদের দায়িত্ব হচ্ছে পঞ্চম সংশোধনীকে আইনে পরিণত করে '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া।
উচ্চ আদালত সম্পর্কে সাকা চৌধুরীর বিষোদগারের কঠোর সমালোচনা করে তিনি বলেন, পঞ্চম সংশোধনী বাতিলে তাঁদের গাত্রদাহ জনগণ জানে। নিজামী-মুজাহিদদের পাশাপাশি সংসদে থাকা যুদ্ধাপরাধীরাও ব্যক্তিগতভাবে ৰতিগ্রসত্ম হবেন। তাই বিরোধিতা করছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের কেন ফাঁসি হলো এটাই তাঁদের দুঃখ। সেজন্য রায় ঘোষণার পর বিএনপি কোন প্রতিক্রিয়া জানায়নি। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের দলবদলের অতীত রেকর্ড উলেস্নখ করে বলেন, বিএনপির রাগ হচ্ছে এই পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র চরিত্র বদলে দিতে চেয়েছিল। সংবিধানকে বিএনপি বলাৎকার করেছিল, সাম্প্রদায়িক থেকে জঙ্গীবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। ১৯টি জঙ্গীবাদী গোষ্ঠী ও বিদেশী জঙ্গীরা দেশে অপতৎপরতা চালাচ্ছে। পঞ্চম সংশোধনী বাতিলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।
বিএনপির উদ্দেশে প্রশ্ন রেখে রাশেদ খান মেনন বলেন, কেন শুধু সুপ্রীমকোর্টকে দুষছেন? ২০০৫ সালে কোর্টের অবস্থা কী করেছিলেন? তিনি বলেন, সংসদের দায়িত্ব হচ্ছে পঞ্চম সংশোধনীকে আইনে পরিণত করে '৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া। সপ্তম ও অষ্টম সংশোধনীও বাতিল করতে হবে। সাকার জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর সৎসাহস ছিল বলেই ওই সময় দুর্নীতির কথা বলেছিলেন। কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট তা দেখাতে পারেনি। ওয়ান ইলেভেনের পর লুণ্ঠিত হাজার কোটি টাকা, লেক্সাস-হ্যামার গাড়ি ফেলে পালিয়েছেন। দুর্নীতির কারণে জোট সরকারের একজন প্রভাবশালী দেশ ছেড়ে বিদেশে পালিয়েছেন। তাঁরা দুর্নীতির কলঙ্কতিলক লেপে দিয়েছিল, বর্তমান মহাজোট সরকার সেই দুর্নীতির দুর্নাম থেকে দেশকে রৰা করেছেন। জামায়াত যোগ দেয়ায় বিএনপির বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী এখন ইসলামী জাতীয়তাবাদে পরিণত হয়েছে। রাশেদ খান মেননের বক্তব্যের সময় বিএনপির শাম্মি আখতার টিপ্পনি কাটলে সরকারী দলের তীব্র প্রতিবাদে চুপ হয়ে যান।
আইন প্রতিমন্ত্রী এ্যাডভোকেট কামরম্নল ইসলাম বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে দেশকে অস্থিতিশীল করার ষড়যন্ত্র চলছে। বর্তমান সরকার আদালত কিংবা কোন তদন্তে হস্তক্ষেপ করছে না। স্বাধীনভাবে চলছে। অপসংস্কৃতি পরিহার করে গঠনমূলক রাজনীতির পথে ফিরে আসার জন্য তিনি বিরোধী দলের প্রতি আহ্বান জানান।
আওয়ামী লীগের খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, একটি মহল একজন খুনী ও ঘাতককে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এককাতারে আনার চেষ্টা করছে। যাঁরা নিজেদের জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে ফেলে তাঁদের মুখে নাম পরিবর্তনের কথা মানায় না।
বিএনপির বরকতউল্লাহ বুলু জিয়াউর রহমানকে আধুনিক বাংলাদেশের স্থপতি হিসাবে দাবি করে বলেন, শহীদ জিয়া এদেশের শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন। জিয়ার জানাযায় ৪০ লাখ মানুষ অংশ নিয়েছিলেন। ইসলামের ১৪শ' বছরের ইতিহাসে কারও জানাযায় এত লোক হয়নি।
সাবেক উপমন্ত্রী ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেন, যারা আরেকটি ১৫ আগস্ট ঘটানোর হুমকি দেয়, তাদের দেশের জনগণ যেখানেই পাবে সেখানেই জবাব দেবে।
মাইনউদ্দিন বাদলের ব্যক্তিগত কৈফিয়ত ॥ সংসদের শেষ পর্যায়ে ২৭৪-এ ব্যক্তিগত কৈফিয়তে সাকা চৌধুরীর একটি অভিযোগের জবাব দিতে দাঁড়িয়ে মাইনউদ্দিন খান বাদল বলেন, জাসদ গঠন করে আমরা এক সময় বঙ্গবন্ধুর বিরোধিতা করেছি। বিরোধিতা করেছি, কিন্তু রাতের অন্ধকারে কারোর রগ কাটিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রশ্নে কখনও আপোস করিনি। তিনি বলেন, ২৬৩ জন থাকার পরও বাবাকে গালি দেয়ার পরও আমরা শুনি। এটাই গণতন্ত্রের নমুনা। কাগজ ছিঁড়ে ফেলেছেন, পাথরও ভেঙ্গে ফেলেছেন, ৩০ বছর পর আজও নামটি রয়েছে সর্বোচ্চ আসনে। তিনি হলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
বিএনপির ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন তাঁর নির্বাচনী এলাকায় চাঁদা না দেয়ায় মসজিদে তালা লাগানো হয়েছে। বিষয়টি পয়েন্ট অব অর্ডার না হওয়ায় ফোর বন্ধ করে দিয়ে স্পীকার সংসদের অধিবেশন আজ বুধবার বিকেল ৩টা পর্যনত্ম মুলতবি ঘোষণা করেন।

No comments

Powered by Blogger.