খুলনার হাদিস পার্ক ও শহীদ মিনার

ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনে একটি মাইল ফলক। বাঙালী জাতির সাহসী ঐতিহ্য। বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য এদেশের ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন।
বায়ান্নর ভাষা শহীদদের স্মরণে দেশের সর্বত্র গড়ে তোলা হয় শহীদ মিনার। খুলনা নগর ভবনের সামনে অবস্থিত পার্কেও তৈরি করা হয় একটি মিনার। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মৃতির স্মরণে এটি নির্মিত হলেও খুলনার এই পার্ক ও শহীদ মিনারটি এখন সকল রাজনৈতিক, সামজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের বেলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। খুলনার কেন্দ্রীয় পার্ক হিসেবে বিবেচিত ‘শহীদ হাদিস পার্ক’। এই পার্কের এক কোণে অবস্থিত জেলার ‘কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার’। ভাষা আন্দোলনের চেতনার মতোই এ মিনারটি বাঙালী জাতির স্বাধিকার, স্বাধীনতা ও স্বকীয় অস্তিস্তের প্রতিভূ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহর থেকে খুলনার এই শহীদ মিনারকে ঘিরে সর্বস্তরের মানুষের ঢল নামে। বাঁধ ভাঙ্গা হাজার হাজার মানুষের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে এই শহীদ মিনারের পাদদেশে, শহীদ হাদিস পার্কে। সর্বস্তরের মানুষ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। বিভিন্ন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা মুষ্টিবদ্ধ হাত উঁচু করে আন্দোলনের শপথ গ্রহণ করেন এখান থেকেই। শহীদ হাদিস পার্ক ও শহীদ মিনার অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত হয়ে আছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে মহান মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সকল আন্দোলনের পীঠস্থান ছিল খুলনার এই পার্কটি। এখনও এই পার্ক ও শহীদ মিনারকে ঘিরে নানা আন্দোলন-সংগ্রাম করা হয়। একাধিক সূত্র মতে, ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি খুলনায় গণআন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হাদিসের স্মরণে কেন্দ্রীয় এ পার্কটির নাম রাখা হয় ‘শহীদ হাদিস পার্ক’। ওই দিন বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার দাবিতে একটি বিক্ষোভ মিছিল হাজী মহসিন রোডস্থ পৌর চেয়ারম্যান ভবনের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে দোকান কর্মচারী হাদিস, সুতা কলের শ্রমিক আলতাফ ও খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী স্কুলছাত্র প্রদীপ নিহত হন। হাদিসের জানাজা খুলনার এই কেন্দ্রীয় পার্কে অনুষ্ঠিত হয় এবং সেদিন পার্কটির নাম পরিবর্তন করে শহীদ হাদিস পার্ক করা হয়। এর আগে খুলনার ঐতিহাসিক এ পার্কটির নাম ছিল পর্যায়ক্রমে ‘মিউনিসিপ্যাল পার্ক’, ‘গান্ধী পার্ক’, ‘শহীদ পার্ক’, ‘জিন্নাহ পার্ক’ ও ‘মিউনিসিপ্যাল পার্ক’। রাজনৈতিক কারণে বার বার নাম পরিবর্তন করা হয় বলে সূত্র জানায়। খুলনার ঐতিহাসিক শহীদ হাদিস পার্কে নির্মিত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটি খুলনা পৌরসভার একটি বিশেষ অবদান। এ মিনারটি তৈরির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয় ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে। তৎকালীন পৌর প্রশাসক কাজী মোঃ মনজুর-এ-মওলা শহীদ মিনার নির্মাণকল্পে শহরের বিশিষ্ট গণ্যমান্য ব্যক্তি, শিক্ষাবিদ, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, ছাত্রসহ বিভিন্ন স্তরের সুধীজনদেন নিয়ে চেয়ারম্যানের কক্ষে সভা করেন। ওই সভায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে অনুযায়ী খুলনার বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক কর্মী ও কলেজ শিক্ষক খালেদ রশীদের (যিনি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অনেকের কাছে ‘গুরু’ বলে পরিচিত ছিলেন) প্রস্তাবক্রমে পার্কের দক্ষিণ দিকে উত্তরমুখী করে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়। ১৯৭০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এর নকশা তৈরি করেন প্রয়াত বিদ্যুৎ কান্তি সরকার। তিনটি স্তরবিশিষ্ট শহীদ মিনারটি ১৯৭০ সালের শেষ দিকে পৌরসভা, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মিলিত উদ্যোগে তৈরি করা হয়। ১৯৭১ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নবনির্মিত এই শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য দিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সংগ্রামী জনতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় এ শহীদ মিনার। শহরময় বিক্ষোভ করে সকল মিছিল ফিরে আসে এই শহীদ মিনারে। এই মিনারকে ঘিরে মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলনও বেগবান হতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের কাছে শহীদ মিনার আতঙ্ক হয়ে দাঁড়ায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু পর ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরা খুলনার এ শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে ফেলে। ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলে ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি খুলনার মানুষ ভগ্ন শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে একুশে উদযাপন করে। ১৯৭৪ সালে খুলনা পৌরসভার নির্বাচিত চেয়ারম্যান গাজী শহীদুল্লাহ শহীদ হাদিস পার্কে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পুনঃনির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর জন্য পৌরসভা ১ লাখ ১৩ হাজার টাকা বরাদ্দ দেয়। ১৯৭৫ সালের শেষ দিকে এই শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৭৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করা হয়। ২০ ফেব্রুয়ারি দিনগত রাত ১২টা ১ মিনিটে পুষ্পমাল্য অর্পণ করে পৌর চেয়ারম্যান গাজী শহীদুল্লাহ নবনির্মিত শহীদ মিনারটি উদ্বোধন করেন। এ শহীদ মিনারটি এখনও খুলনার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। তবে খুলনা সিটি কর্পোরেশন একটি প্রকল্পের আওতায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের আদলে নতুন করে শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু করেছে। খুলনা সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, ৮ কোটি ৪১ লাখ ২৬ হাজার টাকা ব্যয় সাপেক্ষে খুলনার ঐতিহ্যবাহী শহীদ হাদিস পার্ক, শহীদ মিনার ও তৎসংলগ্ন পুকুর উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলছে। এ প্রকল্পের আওতায় শহীদ হাদিস পার্কের পূর্ব দিকে শহীদ মিনার পুনঃনির্মাণ করা, পুকুরের চারপাশে ফুটপাত নির্মাণ, পার্কে ফোয়ারা তৈরি, বাউন্ডারি ওয়াল নির্মাণ পাবলিক টয়লেট ও সিকিউরিটি সেড নির্মাণ এ সব কাজ চলছে। চলতি অর্থবছরে প্রকল্পের কাজ শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে।  Ñঅমল সাহা, খুলনা

No comments

Powered by Blogger.