পবিত্র ঈদ-ই মিলাদুন্নবী (সঃ) একটি বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ দিবস সুফি by মুহম্মদ আবদুল হামিদ

ঈদ অর্থ-খুশি। মিলাদুন্নবী অর্থ হযরত রাসুল (স)-এর জন্ম। আর ঈদ-ই মিলাদুন্নবী অর্থ হচ্ছে_হযরত রাসুল (স)-এর জন্মদিনের খুশি। অফুরনত্ম রহমত ও বরকতপূর্ণ এ দিবসটি আমাদের মাঝে প্রতিবছর ফিরে আসে।
এ দিনে চির শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য রহমতের আঁধাঁর হিসেবে আল্লাহ পাকের প্রিয়তম বন্ধু হযরত মুহাম্মদ (স) পৃথিবীতে আগমন করেন। বিশিষ্ট সাহাবী হযরত আবু হোরায়রা (রা) হতে বর্ণিত আছে, হযরত রাসুল (স) বলেছেন, 'আমি আদম সন্তানের প্রত্যেক যুগের পর যুগ স্থানান্তরিত হয়ে এসেছি। অবশেষে এ যুগে জন্মগ্রহণ করি, যে যুগে আমি বর্তমানে আছি' (বোখারী-১৬৫৮ এবং মেশকাত-৫৪৯৩ নম্বর হাদিস)। মহান আল্লাহ তায়ালার সর্বপ্রিয় বন্ধু হযরত মুহাম্মদ (স)-এর পৃথিবীতে আগমনের স্মৃতি বিজড়িত শুভ জন্ম দিনটি শুধু মুসলিম জাতির জন্য নয়, সমগ্র মানব জাতির জন্য রহমত ও বরকতে পরিপূর্ণ।
মহান আল্লাহ পাক আপন সত্তাকে প্রকাশ করার জন্য প্রথমে 'নূরে মোহাম্মদী' সৃষ্টি করেন। তাঁর নূরে সমগ্র সৃষ্টি জগত সৃজন। আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দ শ' বছর পূর্বে হিজরি পূর্ব ৫৩ সালের ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (স)-এর দিনে সেই নূরে মোহাম্মদীর এ জগতে প্রকাশ ঘটে। হযরত আদম (আ) থেকে শুরম্ন করে যত নবী রাসুল জগতে আগমন করেছেন তাঁরা প্রত্যেকেই হযরত রাসুল (স)-এর আগমনী বার্তা প্রচার ও পৃথিবীতে তাঁর আগমনের ত্রে প্রস্তুত করে গিয়েছেন। হরযত রাসুল (স)-এর উচ্চ মর্যাদা ঘোষণা করে পবিত্র কোরআনে আলস্নাহ বলেন, "(হে মুহাম্মদ)! আমি আপনাকে সৃষ্টি জগতের রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি" (সূরা আম্বিয়া-১০৭)। হযরত রাসুল (সঃ) নিজের সম্পর্কে বলেন, আলস্নাহ পাক সর্ব প্রথম আমার নূর সৃষ্টি করেছেন। আমি আলস্নাহর নূর হতে এবং সকল বস্তু আমার নূর হতে সৃষ্ট। হাদিসে কুদসীতে আলস্নাহ বলেন, 'হে মুহাম্মদ! আমি আপনাকে সৃষ্টি না করলে কোন কিছুই সৃষ্টি করতাম না' (সিররম্নল আসরার)। প্রিয় নবীজীর মর্যাদা প্রকাশ করে আলস্নাহপাক আরও বলেন, 'নিশ্চয়ই আমি আপনাকে সাীদাতা, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী হিসেবে প্রেরণ করেছি এবং আলস্নাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহ্বনকারী রূপে ও উজ্জ্বল (জ্বলনত্ম) প্রদীপ রূপে' (সূরা আহযাব-আয়াত ৪৫-৪৬)। পবিত্র কোরআনে আরও এরশাদ হয়েছে, 'নিশ্চয়ই আলস্নাহ ও তাঁর ফেরেসত্মাগণ নবীর ওপর দরূদ পাঠ করেন। সুতরাং হে ঈমানদারগণ, তোমরাও তাঁর উপর দরূদ ও শ্রদ্ধার সঙ্গে সালাম পেশ কর' (সূরা আহযাব-৫৬)। নিজের সম্পর্কে হযরত রাসুল (স) বলেন, আমাকে ব্যক্তিত্বের প্রভাব দিয়ে সাহায্য করা হয়েছে। এক রাতে আমি যখন নিদ্রায় ছিলাম এ সময় আমার কাছে পৃথিবীর যাবতীয় ধন-সম্পদের চাবিসমূহ আনা হয় এবং আমার হাতে দেয়া হয়' (মেশকাত শরীফ, ৫৫০-১১ নং হাদিস)। আলস্নাহ পাক তাঁর হাবীবকে এত ভালবাসেন যে, সব সময় তাঁকে চোখে চোখে রাখেন। পবিত্র কোরআনে আলস্নাহ বলেন, 'হে মুহাম্মদ! আপনি আমার চোখের সামনেই রয়েছেন' (সুরা তুর-৪৮)। পবিত্র কোরআন ও হাদিস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আলস্নাহ এবং হযরত রাসুল (স) একই মুদ্রার এপিট-ওপিট। যেমন আলস্নাহ বলেন, 'তোমরা আলস্নাহ এবং রাসুলের আনুগত্য কর, (সূরা আলে ইমরান-১৩২)। যে রাসুলের আনুগত্য করলো সে তো আলস্নাহরই আনুগত্য করলো" (সূরা নিসা-৮০)। আলস্নাহ পাক আরও বলেন, "(হে মুহাম্মদ!) আপনি বলুন যদি তোমরা আলস্নাহকে ভালবাস তবে আমাকে অনুসরণ কর, তাহলে আলস্নাহ তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপসমূহ মা করে দেবেন (সূরা আলে ইমরান-৩১)। হযরত রাসুল (স) তাঁর নিজের দিকে ল্য করে বলতেন, 'আমি তোমাদের মতই মানুষ। তিনি তাঁর বাতেনী দিক ল্য করে বলতেন, 'আমি তোমাদের মতো নই, আমি আমার প্রভুর সাথে রাত্রি যাপন করি, তিনি আমাকে খাওয়ান ও পরান' (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)।
হযরত রাসুল (স) সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য রহমতস্বরূপ। তিনি সমগ্র মানব মণ্ডলীর মুক্তির একমাত্র উসিলা। তাই সমগ্র মানব জাতির জন্য তাঁর শুভ জন্ম দিবসটি আলস্নাহ পাকের দেয়া এক বিশেষ নিয়ামত প্রাপ্তির দিন। এদিনে আনন্দ প্রকাশের জন্য আলস্নাহ বলেন, (হে মুহাম্মদ) আপনি বলুন, আলস্নাহর এ অনুগ্রহ ও তাঁর দায়ার প্রতি তাদের (মানুষের) আনন্দ প্রকাশ করা উচিত। তা তাদের ধন-দৌলত অপো শ্রেয়' (সূরা ইউনুস-৫৮)। পবিত্র হাদিস শরীফে উলেস্নখ আছে, হযরত রাসুল (স) বলেন, 'মুমেন ব্যক্তির দিল (ক্বালব) আলস্নাহর আরশ।' হাদিসে আরও উলেস্নখ আছে, 'মুমেন ব্যক্তির নামাজ মেরাজ স্বরূপ।' এতে প্রমাণিত হয়, মুমেন ব্যক্তির মর্যাদা অতি উর্ধে। এই দুর্লভ মর্যাদা লাভের অন্যতম উপায় হচ্ছে, হযরত রাসুূল (সাঃ)-কে জগতের সবকিছুর উর্ধে ভালবাসা। হযরত মুহাম্মদ (স) বলেন, 'যে ব্যক্তি আমাকে তার স্ত্রী-পুত্র, ধনদৌলত ও আপনজন অপো অধিক ভালবাসতে না পারবে, সে কখনও মুমেন হতে পারবে না' (বোখারী ও মুসলিম শরীফ)।
মুসলিম জাতি বছরে আওরা দু'টি (ঈদ) ধর্মানুষ্ঠান পালন করে থাকে। এর একটি ঈদ-উল-আজহা বা কোরবানির ঈদ এবং অপরটি ঈদ-উল-ফিতর বা রমজানের রোজা শেষের উৎসব। কোরবানির ঈদ হচ্ছে, সুন্নতে ইব্রাহীম। হযরত ইব্রাহীম (আ) আলস্নাহর নির্দেশে কোরবানি করার জন্য পুত্রের গলে ছুরি চালিয়েছিলেন। মহান আলস্নাহ তাঁর এ কাজে খুশি হয়ে পিতা-পুত্র উভয়কে বন্ধু বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। সে আনন্দে হযরত রাসুল (স) হযরত ইব্রাহীম (আ) -এর বংশধর হিসেবে কোরবানির ঈদ পান করতেন। উন্মতে মোহাম্মদী হিসেবে আমাদের জন্যও কোরবানির বিধান দেয়া হয়েছে। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর আমরা রোজা শেষে ঈদু-উল-ফিতর খুশি উদযাপন করে থাকি। এ দু'টি ঈদের বিধান পেয়েছি আমরা হয়রত রাসুল (স)-এর মাধ্যমে। যাঁর মাধ্যমে আমরা বর্ণিত দু'টি ঈদের বিধান পেয়েছি, যাঁর নূরে সৃষ্ট জগৎ সৃষ্টি, যাঁর সৃষ্টি করা না হলে কোন কিছুই সৃষ্টি করা হতো না, যিনি রাহমাতুলস্নীল আলামীন, তাঁর শুভ জন্ম দিবসটি মহাআনন্দ আর মহাখুশির সঙ্গে পালন করা আমাদেরও উচিত নয়কি?
দু'জাহানের বাদশা হযরত মুহাম্মদ (স) সমগ্র সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত ও বরকতের আধার। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার সঙ্গে দরূদ ও সালাম পেশ করলে সংসারের অভাব দূর হয়, বিপদাপদ হতে মুক্তি লাভ করা যায়, রিজিক বৃদ্ধি পায়। তাঁকে ভালবাসার মাধ্যমে মুমেন হওয়া যায়। রহমত লাভের জন্য একমাত্র তাঁরই উসিলা ধরতে হয়। তাঁর সুপারিশ ছাড়া পরকালে কারও মুক্তি লাভ করা সম্ভব নয়। তাই নবীজি (স)-এর শুভ জন্মদিবসটি অপর দু'টি ঈদের চেয়ে খুশির সঙ্গে পালনের মাধ্যমে তাঁর রহমত লাভ ও আলস্নাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জন সম্ভব হবে। যার প্রতি আলস্নাহ ও তাঁর বন্ধু খুশি হবেন তার কোন ভয় ও দুঃখিত হওয়ার কোন কারণ নেই। তাই আসুন সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে আমরা মহাখুশির সঙ্গে হযরত রাসুল (স)-এর শুভ জন্ম তথা পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (স) দিবসটি পালন করি। অন্য নবী-রাসুলগণের অনুসারীরা যদি তাদের নবী-রাসুলের জন্মদিবস মহা ধুমধাম ও আনন্দের সঙ্গে পালন করতে পারে, উন্মতে মোহাম্মদী হিসেবে আসুন আমরা কেন আমাদের নবী করীম (স)-এর শুভ জন্মদিবসটি মহাখুশির সঙ্গে পালন করে নিজেদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন করার চেষ্টা করতে পারব না? আলস্নাহ দয়া করে আমাদের তাঁর বন্ধুর শুভ জন্মদিনটি পালনের মাধ্যমে অশেষ ফয়েজ ও রহমত দান করম্নন।

No comments

Powered by Blogger.