ব্যাপক সাফল্য সত্ত্বেও কিছু ঘটনায় বিব্রত সরকার ॥ তথ্যমন্ত্রী- তবে এসব পাশ না কাটিয়ে মোকাবেলার চেষ্টা করা হয়েছে ॥ সংবাদ সম্মেলন

 মহাজোট সরকার চার বছরে ব্যাপক সফলতা অর্জন করলেও ছাত্রলীগের ‘উচ্ছৃঙ্খল’ কর্মকা- সরকারকে বিব্রত করেছে। তবে সরকার কোন দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করেনি।
পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে মন্ত্রী সচিবকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। দুর্নীতির প্রমাণ পেলে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। মঙ্গলবার তথ্য অধিদফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু এ কথা বলেন। তিনি বলেন, বিগত চার বছরে মহাজোট সরকারের ব্যাপক সফলতা থাকলেও এ আমলে কিছু অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। সরকার তা আমলে নিয়ে ব্যবস্থা নিয়েছে এবং নিচ্ছে। কিন্তু বিগত চারদলীয় জোট সন্ত্রাসকে লালন করেছে।
এক প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগ নামধারী কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল সন্ত্রাসীর তা-ব অব্যশ্যই গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে বিব্রত করে। আর পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে আমরা বিব্রত। তবে পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠার পর পরই সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিয়েছে। পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পর পদ্মা সেতুর জন্য ১২০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এরপর সরকারের নানামুখী তৎপরতায় তারা প্রকল্পে ফিরলেও দুর্নীতির ওই অভিযোগ নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের গতিধারা পর্যবেক্ষণ করেই অর্থায়নের বিষয়টি চূড়ান্ত করবে বলে জানিয়েছে তারা।
এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান তুলে ধরে তিনি বলেন, সচিব থেকে শুরু করে মন্ত্রী পর্যন্ত তাদের পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। তদন্ত চলছে, আমরা দেশী-বিদেশী সবার সহযোগিতায় তদন্ত কাজের অগ্রগতির ভিত্তিতে ধাপে ধাপে পদক্ষেপ নিচ্ছি। ক্ষমতাসীন মহাজোট সরকারের চার বছরে বিভিন্ন খাতের অগ্রগতি এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সঙ্গে তুলনামূলক একটি চিত্র তুলে ধরেন তিনি।
তিনি বলেন, যে কোন প্রশাসনের ভেতরে দুর্নীতির ঘটনা প্রশাসনকে বিব্রত করে। যে কোন বিশৃঙ্খলা রাজনীতিকেও বিব্রত করে। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গত চার বছরে বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হামলা, সংঘর্ষ, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও জবরদখলের মতো কর্মকা-ে জড়ানোর অভিযোগ ওঠে।
বেশ কয়েকবার নিজেদের মধ্যেও সংঘর্ষে জড়ায় আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সহযোগী সংগঠন। সরকার এসব ‘বিব্রতকর’ ঘটনা পাশ না কাটিয়ে মোকাবেলার চেষ্টা করেছে।
সোমবার সারাদেশে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগী সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের হামলা-ভাংচুর প্রসঙ্গে ইনু বলেন, যে কোন অতর্কিত হামলা মোকাবেলা করা কঠিন। তবে গোয়েন্দা তথ্য থাকার পরেও কীভাবে অতর্কিতে হামলা হতে পারে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। জামায়াত-শিবিরের ওই সন্ত্রাসী ঘটনায় প্রশাসন ও গোয়েন্দাদের ব্যর্থতা আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
সোমবার ঢাকাসহ দেশের কয়েকটি জেলায় জামায়াত-শিবির কর্মীদের হামলায় অন্তত ৩১ পুলিশ সদস্য আহত হয়। ঢাকায় পাঁচটি গাড়িতে আগুন দেয়ার পাশাপাশি দুই শতাধিক গাড়ি ভাংচুর করে শিবির কর্মীরা।
সংবাদ সম্মেলনে ইনু বলেন, এই হামলার চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে। এটা গোয়েন্দা বা প্রশাসনিক ব্যর্থতা কিনা তা শীঘ্রই জানানো হবে। পুলিশের কোন ব্যর্থতা থাকলে তাও খতিয়ে দেখা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সহনশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবেলার চেষ্টা করছে। তবে তার মানে এই নয় যে, অতর্কিতে হামলা বা চোরাগোপ্তা হামলা মোকাবেলার যোগ্যতা সরকারের নেই।
পুলিশের উপর হামলা ও যানবাহন ভাংচুরের কঠোর সমালোচনা করে হাসানুল হক ইনু বলেন, অতর্কিত সন্ত্রাসী হামলা এটাই প্রমাণ করে, জামায়াত-শিবির শুধু যুদ্ধাপরাধীদের দোসরই নয়, তারা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।
জামায়াত-শিবিরের তা-ব নিয়ে অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য মন্ত্রীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতার প্রকাশ কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তথ্যমন্ত্রী বলেন, সরকারের ভেতরে এক মন্ত্রীর সঙ্গে আরেক মন্ত্রীর বক্তব্যে পার্থক্য থাকলে সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পায় না। সমন্বয়হীনতা প্রকাশ পায় নীতিগত ব্যাপারে যদি পাল্টাপাল্টি অবস্থান গ্রহণ করা হয়।
তথ্যমন্ত্রী বলেন, সাগর-রুনী হত্যাকা- ছাড়া প্রতিটি ঘটনাতেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুততার সঙ্গে অপরাধীদের আইনের আওতায় এনেছে। তবে বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী গুমের কোন সুরাহা না হওয়ার বিষয়টিও স্বীকার করেন তিনি।
গত ৯ ডিসেম্বর বিরোধী দলের অবরোধের সময় পুরনো ঢাকায় ছাত্রলীগ কর্মীদের হামলায় বিশ্বজিৎ দাস নিহত হওয়ার ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেন তথ্যমন্ত্রী। তবে গণমাধ্যমের সূত্র ধরে ‘প্রকৃত’ অপরাধীদের গ্রেফতার করা গেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, অপরাধ করলে কাউকে ছাড় দিচ্ছে না এবং দেবে না সরকার। এটা ইতিবাচক দিক। যেখানে অপরাধীদের মাফ করে দেয়ার, আড়াল করার সংস্কৃতি চালু ছিল, সেখানে আমরা এই আমলে চেষ্টা চালাচ্ছি সবাইকে আইনে আওতায় আনার। আমরা সামরিক স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের দিকে যাত্রা করেছি।
যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে তথ্যমন্ত্রী বলেন, বিচার করার দায়িত্ব আদালতের, সরকারের নয়। তবে রায় কার্যকর করার দায়িত্ব সরকারের। আদালত স্বাধীনভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শেষ করবে। এর সঙ্গে সরকারের মেয়াদের কোন সম্পর্ক নেই।
লিখিত বক্তব্যে তথ্যমন্ত্রী বলেন, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে দেশে আইনের শাসন ছিল অনুপস্থিত। ২০০১ সালে ক্ষমতা আরোহনের পর পরই শুরু হয় বিরোধী রাজনৈতিক দলের কর্মী, সংখ্যালঘু ও সাধারণ মানুষের উপর নিপীড়ন ও নির্যাতন। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে হতাহত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিরোধী দলের প্রায় ২১ হাজার নেতাকর্মী। অসংখ্য নারী হয় ধর্ষিত। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানীদের ন্যায় পৈশাচিকতায় লিপ্ত হয়ে ওঠে বিএনপি-জামায়াত জোট। নারী ও শিশুসহ সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী কেউই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায়নি। সে সময়ে দেশে-বিদেশে নির্বাচন পরবর্তী নির্যাতনের বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় ওঠে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার পূর্ণিমা রানী ধর্ষণের ঘটনাটি এখনও মানুষের মন থেকে মুছে যায়নি। সরকারী মদদে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার লক্ষ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে নারী নেত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন মারা যান। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সারাদেশে একযোগে ৬৩ জেলায় বোমা হামলা চালিয়ে জঙ্গীবাদীরা তাদের উত্থান জানান দেয়। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় উত্তরাঞ্চলে আবির্ভাব ঘটে শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের মতো জঙ্গীর। গাজীপুরে আইনজীবীদের কক্ষে, ময়মনসিংহের সিনেমা হলে, গোপালগঞ্জে গীর্জায়, কোটালিপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে, সিলেটে হযরত শাহ জালাল (রা) মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনারকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড হামলাসহ অসংখ্য জঙ্গী হামলা চালানো হয়। চট্টগ্রাম বন্দরে খালাসের সময় ধরা পড়ে ১০ ট্রাক অস্ত্র যা জঙ্গী কার্যক্রমে ব্যবহারের জন্য আনা হয়। সে সময় অপারেশন ক্লিনহার্টের নামে বিরোধী দলের নেতাকর্মী ও সাধারণ জনগণের উপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। এ অভিযান পরিচালনাকারীদের দেয়া হয় দায়মুক্তি যেমনটি বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ক্ষেত্রেও দেয়া হয়েছিল। এতে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে জনগণের জীবন হয়ে পড়ে নিরাপত্তাহীন। বাংলাদেশ পরিণত হয় আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের নতুন টার্গেটে। সর্বত্র ভেঙ্গে পড়ে আইনের শাসন। বাংলাদেশ চিহ্নিত হয় অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে।
জোট সরকারের আমলে নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার সাধারণ মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের যাতে বিস্ফোরণ না ঘটে এবং কেউ যাতে আইন নিজের হাতে তুলে না নেয় সে কারণে নির্বাচনের ফল ঘোষণার পরদিনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিজয় মিছিল করা থেকে বিরত থাকার জন্য সাধারণ জনগণ ও দলের নেতা কর্মীদের অনুরোধ করেন। ফলে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলের মতো নির্বাচনপরবর্তী কোন সহিংসতা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেনি।
বর্তমান সরকার আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সকল প্রকার ‘ইনডেমিনিটি এবং ইমুইউনিটি’র বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। মূল সংবিধানে প্রত্যাবর্তনে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বর্তমান মহাজোট সরকারের আমলে ৪ বছরে জঙ্গীবাদ কঠোর হস্তে নির্মূল করা হয়েছে। অপরাধের প্রতিটি ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের যথাযথ পদক্ষেপের ফলে দেশে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.