রাজনীতি-সংস্কৃতি-সেক্যুলার রাজনীতিতে উত্তরণের চ্যালেঞ্জে জয়ী হতেই হবে by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
ষাটের দশকের শুরুতেই শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে দীর্ঘদিনের জন্য শূন্যতা সৃষ্টি হবে বলে যে শঙ্কা ছিল, শেখ মুজিবুর রহমানের আকস্মিক অভ্যুদয়ে তা ভুল প্রমাণ হয়।
তার এ উত্থানের পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বহুমুখী আন্দোলন, যার পেছনে বামপন্থি শক্তির যথেষ্ট অবদান ছিল। তিনি দেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে সফল হন
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের নেতৃত্ব ছিল ইতিবাচক ও অনন্য প্রেরণাদায়ী। স্বাধীন দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধাপে ধাপে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। একদল আস্থাভাজন সহকর্মী ছিল তার, যারা কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এম কামরুজ্জামান প্রমুখের নাম। কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়েও ছিলেন একদল পরীক্ষিত নেতা ও কর্মী। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এমন একদল নিবেদিতপ্রাণ তরুণও স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়সংকল্প।
এ সময়ে আমরা জাতীয় রাজনীতিতে আরও একদল উদ্যমী ও সাহসী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর উপস্থিতি লক্ষ্য করি, যাদের অভিহিত করা হতো বামপন্থি ও কমিউনিস্ট হিসেবে। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মণি সিংহ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ প্রমুখের নাম। তারা জাতীয় ইস্যুগুলোর পাশাপাশি শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের দাবি সামনে নিয়ে আসতে থাকেন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা ক্রমে শক্তিশালী হয় এবং এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ পরিণত হয় মুখ্য শক্তিতে। সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের দল হয়ে ওঠে তারা। এ সময়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনও শক্তিশালী হতে থাকে এবং জাতীয় জাগরণে তা অনন্য ভূমিকা রাখে। তবে এ অঙ্গনে সামনের সারিতে আমরা দেখতে পাই মূলত বামপন্থিদের। আওয়ামী লীগ ওই সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেনি, এখনও নয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রয়োজন তারা উপলব্ধি করেনি, সেটা বলা যাবে না। তবে এ ক্ষেত্রে বামপন্থি শক্তির ওপর নির্ভরতা বরাবরই লক্ষ্য করা গেছে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরদার হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন, যা আপামর জনসাধারণ গ্রহণ করে নেয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ভ্রূকুটি এবং নির্যাতন-নিপীড়ন উপেক্ষা করে তিনি এবং তার দল এ আন্দোলনকে ক্রমে জোরদার করায় সফল হন। তিনি পরিণত হন বাঙালি জাতির প্রধান নেতায়। ছয় দফার এ আন্দোলনের পাশাপাশি আমরা লক্ষ্য করি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও জনগণকে সচেতন করে তোলার বহুমুখী প্রয়াস। বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ পালন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে সাড়ম্বর আয়োজন এবং বেতার-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ব্যাপক সক্রিয়তা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নতুন জোয়ার সৃষ্টি করে। কবিগুরুর আমার সোনার বাংলা... গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া হতে থাকে। ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্র সংগঠনগুলোর অনুষ্ঠানে গণসঙ্গীত পরিবেশন করতে থাকেন একদল শিল্পী। এ কর্মকাণ্ডেও সামনের সারিতে ছিলেন বামপন্থি ধ্যানধারণা ও আদর্শে বিশ্বাসী শিল্পীরা। তাদের মধ্যে আমরা কবিয়াল রমেশ শীল, আলতাফ মাহমুদ প্রমুখের নাম উল্লেখ করতে পারি। ১৯৫৪ সালের যুক্ত নির্বাচনে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন রাজনৈতিক নেতা এবং জনগণকে তারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে তোলেন। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট গঠনের ব্যাপারে বামপন্থিদের উদ্যোগ ছিল এবং এ জন্য তারা স্বার্থত্যাগেও পিছপা হয়নি। ষাটের দশকে বামপন্থিদের মধ্যে বিভক্তি লক্ষ্য করা যায়। তবে তাদের মধ্যে মস্কোপন্থি হিসেবে অভিহিত অংশ স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ওই সময়ে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং অগ্রসর ছাত্রসমাজের কাছে তারা এ কর্মসূচি গ্রহণযোগ্য করে তোলায় ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৭১ সালে। এ আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেকগুলো আন্দোলনের পরিণতি। ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরণের নামে উর্দু-ফার্সি শব্দে ভর্তি করার অপচেষ্টা রুখে দেওয়া, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতি রক্ষার জন্য ব্যাপক সক্রিয়তা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ_ এ ধরনের অনেক উদাহরণ আমরা দিতে পারি। আমার মনে আছে, শামসুর রাহমান তার এক কবিতায় 'ঈশ্বর' শব্দ ব্যবহার করায় তথাকথিত ইসলামী শক্তির প্রবল রোষের সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এতে দমে যাননি। এসব আন্দোলনের মূল চরিত্র ছিল অসাম্প্রদায়িক। রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে তা একাকার হয়ে যায় এবং তা মিশে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মোহনায়। এ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল সুগঠিত। এর গণভিত্তি এতই বিস্তৃত ছিল যে, শাসকগোষ্ঠী শত চেষ্টা করেও জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারেনি। একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের বিশেষ নজর ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতি। তারা বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে; স্পষ্টতই যার লক্ষ্য ছিল এ অঙ্গনে শূন্যতা সৃষ্টি করা। জাতীয় জীবনে এর প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক বোঝা যায়নি। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আমরা দেখতে পাই সাম্প্রদায়িক শক্তির সহযোগী হিসেবে তথাকথিত বামপন্থি (চীনপন্থি) রাজনৈতিক শক্তির সক্রিয়তা। তারা ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সম্মেলন উপলক্ষে যশোরে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষ পালন উপলক্ষে ছায়ানট আয়োজিত অনুষ্ঠানে বোমা হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, বরং এর পেছনে কাজ করেছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। বাঙালির সাংস্কৃতিক শক্তি এ অপশক্তি যথার্থই উপলব্ধি করে এবং এভাবে বলপ্রয়োগে তা ছিন্ন করতে চেয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ একা এ শক্তিকে প্রতিরোধ করতে পারছে না। তারা এ কাজের গুরুত্ব উপলব্ধিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তদুপরি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের ছাত্র ও যুব শক্তির মধ্যেও ভাঙন ধরে। এর প্রতিক্রিয়াও আমরা সমাজে নানাভাবে দেখতে পাই। বলা যায়, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রভাবশালী থাকলেও একাত্তরের বিরোধীরা সামাজিক অঙ্গনে শক্তিশালী হতে থাকে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি দুর্বল হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায় না_ এটা তত্ত্বের কথা। আমরা বাস্তবে এর প্রমাণ পাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঘটনায়। এ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। দেশের কর্তৃত্ব চলে যায় সাম্প্রদায়িক ও একাত্তরের পরাজিত শক্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়া সামরিক শক্তির জোটের হাতে। তারা সাম্প্রদায়িক এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদবিরোধী সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট শক্তিশালী করে তোলে এবং এ কাজে মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের পূর্ণ সহায়তা পায়। পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি, চীনপন্থি বামরা আইয়ুব খানের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। স্বাধীনতার পরও দেখা যায়, সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের জন্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভিত গড়ে তোলায় তাদের সক্রিয়তা।
আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপজুড়ে বাম শিবিরের বিপর্যয় ঘটে। এর প্রভাবে বাংলাদেশেও বামপন্থি আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে সাম্প্রদায়িক শক্তি। তবে এটাও স্মরণ রাখা দরকার যে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বামধারার রাজনীতির সার্বিক গণভিত্তির শিকড় মজবুত থাকায় সাম্প্রদায়িক ও তথাকথিত বাম শক্তির মিলিত চেষ্টা সব ক্ষেত্রে সফল হয় না। এক পর্যায়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি তার দুর্বলতা কাটাতে শুরু করে। এর ধারায় আওয়ামী লীগ ফের রাজনৈতিক অঙ্গনের পুরোভাগে চলে আসতে সক্ষম হয়। ইতিহাসের অনুরাগী ছাত্ররা সহজেই বুঝতে পারবেন, এর মূলে রয়েছে সেক্যুলার রাজনীতির গুণ। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, বঙ্গবন্ধুর আমলের তুলনায় আমাদের দেশে বামপন্থি রাজনীতি বহুধাবিভক্ত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সমর্থনের ভিতও দারুণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কারণে তারা আগের মতো আওয়ামী লীগের জন্য সহায়তা জোগাতে পারছে না। সরলভাবে বলা যায়, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যে ইন্টেলেকচুয়াল ঘাটতি তার অন্যতম কারণ এটাই। ঐতিহাসিকভাবেই দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বের অবস্থান আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারেনি। এ দায়িত্ব পালন করেছে বামপন্থি শক্তি এবং তা কাজ করেছে আওয়ামী লীগের রাডার হিসেবে। এখন এ পরিপূরক শক্তির যথাযথ সহায়তা না পাওয়ায় নানা বিভ্রান্তি ও পদস্খলন আমরা লক্ষ্য করছি। অনেকের বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ এখন মুসলিম আওয়ামী লীগে রূপ নিতে চলেছে। তারা মুখে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলছে, কিন্তু বাস্তবে চলছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে আপস করে। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগে তার নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করতে পারেননি। এ জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সার্বিক পরিস্থিতি যে অনেকাংশে দায়ী, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বিপর্যয়ে পড়ার পর বিশ্বব্যাপী দক্ষিণপন্থার শক্তি বেড়েছে। এর প্রভাবে অনেক দেশে বাম-মধ্যপন্থার অনুসারী দলকে দক্ষিণপন্থার প্রতি ঝুঁকে পড়তে দেখা গেছে। বাংলাদেশেও আমরা তা লক্ষ্য করি। বিশেষভাবে সবচেয়ে বড় ও গণভিত্তিসম্পন্ন দল আওয়ামী লীগেই তা বেশি করে লক্ষ্য করা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দীর্ঘ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করতে বহুলাংশে সফল হয়েছিলেন। নিজের দলকেও তিনি এর উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রয়াস পান। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষ করে সামরিক শাসনামলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। এখনও তার জের চলছে। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথে দেশকে ফিরিয়ে আনার জন্য সুপ্রিম কোর্ট যে সুযোগ করে দিয়েছেন তা কাজে লাগাতে চলছে টালবাহানা। আইনমন্ত্রী এমন হাস্যকর উক্তিও করেছেন যে, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রেখেও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্ভব। এ তো সোনার পাথরবাটি!
আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ফিরে না গেলে তার পক্ষে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সেক্যুলার বাংলাদেশ গড়ে তোলা কঠিন হবে। দেশের অর্থনীতিতে এখন অরাজকতা বিরাজ করছে। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর চিত্র_ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বশূন্যতা। সমাজের অভ্যন্তরে প্রগতিশীল সংস্কৃতির চাপ না থাকায় ফতোয়াবাজ ও উগ্র মৌলবাদ সমাজে কর্তৃত্ব বিস্তারের প্রয়াস পাচ্ছে। আইন করেও তা প্রতিহত করা যাচ্ছে না। কিন্তু এর মধ্যেও স্বাধীনতার ৪০তম বছরে সম্ভাবনাময় প্রবণতা হচ্ছে, সমাজের প্রগতিশীল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিগুলো মিলিত হতে চেষ্টা করছে। সহিংস মৌলবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণের জন্য কাজ করছে। আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত এ উদ্যোগ কাজে লাগাতে পারছে না, যেমনটি তারা করেছিল ১৯৫২ সালে। ষাটের দশকেও আমরা এটা দেখেছি। অথচ তাদের মধ্যে এখনও দ্বিধা ও দোদুল্যমানতা কাজ করছে। আমরা দেখেছি, পঞ্চাশের দশকে বামদের প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাতেই ষাটের দশকে নতুন আওয়ামী লীগ গড়ে ওঠে এবং বঙ্গবন্ধু তার নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি দলে এবং দেশের মধ্যেও সেক্যুলার চরিত্র নিয়ে আসতে সক্ষম হন। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি এ ধারায় চলতে ব্যর্থ হয় তাহলে আমাদের যত হতাশার কারণই হোক না কেন, অসাম্প্রদায়িক সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠবেই। এখন এ সম্ভাবনা দেখা না গেলেও অদূর ভবিষ্যতে তা দেখা যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। ষাটের দশকের শুরুতেই শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে দীর্ঘদিনের জন্য শূন্যতা সৃষ্টি হবে বলে যে শঙ্কা ছিল, শেখ মুজিবুর রহমানের আকস্মিক অভ্যুদয়ে তা ভুল প্রমাণ হয়। তার এ উত্থানের পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বহুমুখী আন্দোলন, যার পেছনে বামপন্থি শক্তির যথেষ্ট অবদান ছিল। তিনি দেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে সফল হন। স্বাধীনতা অর্জনের চার দশকে এসে এখন আমাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং তাতে জয়ী হতে হলে শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলন অপরিহার্য। এ আন্দোলনে জয়ী হওয়ার অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে, অসাম্প্রদায়িক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির সঙ্গে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির মেলবন্ধন। এ প্রত্যাশা পূরণ করতেই হবে।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : সাংবাদিক
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের নেতৃত্ব ছিল ইতিবাচক ও অনন্য প্রেরণাদায়ী। স্বাধীন দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধাপে ধাপে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন। একদল আস্থাভাজন সহকর্মী ছিল তার, যারা কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ সময়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এম কামরুজ্জামান প্রমুখের নাম। কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়েও ছিলেন একদল পরীক্ষিত নেতা ও কর্মী। ষাটের দশকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন, এমন একদল নিবেদিতপ্রাণ তরুণও স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়সংকল্প।
এ সময়ে আমরা জাতীয় রাজনীতিতে আরও একদল উদ্যমী ও সাহসী রাজনৈতিক নেতাকর্মীর উপস্থিতি লক্ষ্য করি, যাদের অভিহিত করা হতো বামপন্থি ও কমিউনিস্ট হিসেবে। তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মণি সিংহ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ প্রমুখের নাম। তারা জাতীয় ইস্যুগুলোর পাশাপাশি শ্রমজীবী-মেহনতি মানুষের দাবি সামনে নিয়ে আসতে থাকেন।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারা ক্রমে শক্তিশালী হয় এবং এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ পরিণত হয় মুখ্য শক্তিতে। সব শ্রেণী ও পেশার মানুষের দল হয়ে ওঠে তারা। এ সময়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনও শক্তিশালী হতে থাকে এবং জাতীয় জাগরণে তা অনন্য ভূমিকা রাখে। তবে এ অঙ্গনে সামনের সারিতে আমরা দেখতে পাই মূলত বামপন্থিদের। আওয়ামী লীগ ওই সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারেনি, এখনও নয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার প্রয়োজন তারা উপলব্ধি করেনি, সেটা বলা যাবে না। তবে এ ক্ষেত্রে বামপন্থি শক্তির ওপর নির্ভরতা বরাবরই লক্ষ্য করা গেছে। ষাটের দশকের মাঝামাঝি পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি জোরদার হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি পেশ করেন, যা আপামর জনসাধারণ গ্রহণ করে নেয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর ভ্রূকুটি এবং নির্যাতন-নিপীড়ন উপেক্ষা করে তিনি এবং তার দল এ আন্দোলনকে ক্রমে জোরদার করায় সফল হন। তিনি পরিণত হন বাঙালি জাতির প্রধান নেতায়। ছয় দফার এ আন্দোলনের পাশাপাশি আমরা লক্ষ্য করি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেও জনগণকে সচেতন করে তোলার বহুমুখী প্রয়াস। বাংলা নববর্ষ পহেলা বৈশাখ পালন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনে সাড়ম্বর আয়োজন এবং বেতার-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে ব্যাপক সক্রিয়তা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নতুন জোয়ার সৃষ্টি করে। কবিগুরুর আমার সোনার বাংলা... গানটি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাওয়া হতে থাকে। ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্র সংগঠনগুলোর অনুষ্ঠানে গণসঙ্গীত পরিবেশন করতে থাকেন একদল শিল্পী। এ কর্মকাণ্ডেও সামনের সারিতে ছিলেন বামপন্থি ধ্যানধারণা ও আদর্শে বিশ্বাসী শিল্পীরা। তাদের মধ্যে আমরা কবিয়াল রমেশ শীল, আলতাফ মাহমুদ প্রমুখের নাম উল্লেখ করতে পারি। ১৯৫৪ সালের যুক্ত নির্বাচনে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন রাজনৈতিক নেতা এবং জনগণকে তারা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত করে তোলেন। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট গঠনের ব্যাপারে বামপন্থিদের উদ্যোগ ছিল এবং এ জন্য তারা স্বার্থত্যাগেও পিছপা হয়নি। ষাটের দশকে বামপন্থিদের মধ্যে বিভক্তি লক্ষ্য করা যায়। তবে তাদের মধ্যে মস্কোপন্থি হিসেবে অভিহিত অংশ স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে। তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়ন ওই সময়ে যথেষ্ট শক্তিশালী ছিল এবং অগ্রসর ছাত্রসমাজের কাছে তারা এ কর্মসূচি গ্রহণযোগ্য করে তোলায় ভূমিকা রাখে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ লাভ করে ১৯৭১ সালে। এ আন্দোলন ছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অনেকগুলো আন্দোলনের পরিণতি। ভাষা আন্দোলন, বাংলা ভাষাকে ইসলামীকরণের নামে উর্দু-ফার্সি শব্দে ভর্তি করার অপচেষ্টা রুখে দেওয়া, রবীন্দ্রসঙ্গীত ও নজরুলগীতি রক্ষার জন্য ব্যাপক সক্রিয়তা, অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশ_ এ ধরনের অনেক উদাহরণ আমরা দিতে পারি। আমার মনে আছে, শামসুর রাহমান তার এক কবিতায় 'ঈশ্বর' শব্দ ব্যবহার করায় তথাকথিত ইসলামী শক্তির প্রবল রোষের সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এতে দমে যাননি। এসব আন্দোলনের মূল চরিত্র ছিল অসাম্প্রদায়িক। রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে তা একাকার হয়ে যায় এবং তা মিশে যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মোহনায়। এ সাংস্কৃতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব ছিল সুগঠিত। এর গণভিত্তি এতই বিস্তৃত ছিল যে, শাসকগোষ্ঠী শত চেষ্টা করেও জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারেনি। একাত্তরে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী এবং তাদের এদেশীয় সহযোগীদের বিশেষ নজর ছিল সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতি। তারা বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে; স্পষ্টতই যার লক্ষ্য ছিল এ অঙ্গনে শূন্যতা সৃষ্টি করা। জাতীয় জীবনে এর প্রতিক্রিয়া তাৎক্ষণিক বোঝা যায়নি। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে আমরা দেখতে পাই সাম্প্রদায়িক শক্তির সহযোগী হিসেবে তথাকথিত বামপন্থি (চীনপন্থি) রাজনৈতিক শক্তির সক্রিয়তা। তারা ক্রমে শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সম্মেলন উপলক্ষে যশোরে আয়োজিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষ পালন উপলক্ষে ছায়ানট আয়োজিত অনুষ্ঠানে বোমা হামলা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না, বরং এর পেছনে কাজ করেছে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা। বাঙালির সাংস্কৃতিক শক্তি এ অপশক্তি যথার্থই উপলব্ধি করে এবং এভাবে বলপ্রয়োগে তা ছিন্ন করতে চেয়েছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ একা এ শক্তিকে প্রতিরোধ করতে পারছে না। তারা এ কাজের গুরুত্ব উপলব্ধিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তদুপরি স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের ছাত্র ও যুব শক্তির মধ্যেও ভাঙন ধরে। এর প্রতিক্রিয়াও আমরা সমাজে নানাভাবে দেখতে পাই। বলা যায়, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রভাবশালী থাকলেও একাত্তরের বিরোধীরা সামাজিক অঙ্গনে শক্তিশালী হতে থাকে। সামাজিক-সাংস্কৃতিক শক্তি দুর্বল হলে রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রভাব বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায় না_ এটা তত্ত্বের কথা। আমরা বাস্তবে এর প্রমাণ পাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঘটনায়। এ নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের পর রাজনৈতিক শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। দেশের কর্তৃত্ব চলে যায় সাম্প্রদায়িক ও একাত্তরের পরাজিত শক্তির সঙ্গে যুক্ত হওয়া সামরিক শক্তির জোটের হাতে। তারা সাম্প্রদায়িক এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদবিরোধী সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট শক্তিশালী করে তোলে এবং এ কাজে মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রোডলারের পূর্ণ সহায়তা পায়। পাকিস্তান আমলে আমরা দেখেছি, চীনপন্থি বামরা আইয়ুব খানের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল। স্বাধীনতার পরও দেখা যায়, সেনাশাসক জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের জন্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভিত গড়ে তোলায় তাদের সক্রিয়তা।
আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব ইউরোপজুড়ে বাম শিবিরের বিপর্যয় ঘটে। এর প্রভাবে বাংলাদেশেও বামপন্থি আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ে এবং এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে সাম্প্রদায়িক শক্তি। তবে এটাও স্মরণ রাখা দরকার যে, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বামধারার রাজনীতির সার্বিক গণভিত্তির শিকড় মজবুত থাকায় সাম্প্রদায়িক ও তথাকথিত বাম শক্তির মিলিত চেষ্টা সব ক্ষেত্রে সফল হয় না। এক পর্যায়ে অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক শক্তি তার দুর্বলতা কাটাতে শুরু করে। এর ধারায় আওয়ামী লীগ ফের রাজনৈতিক অঙ্গনের পুরোভাগে চলে আসতে সক্ষম হয়। ইতিহাসের অনুরাগী ছাত্ররা সহজেই বুঝতে পারবেন, এর মূলে রয়েছে সেক্যুলার রাজনীতির গুণ। তবে এটাও মনে রাখা দরকার, বঙ্গবন্ধুর আমলের তুলনায় আমাদের দেশে বামপন্থি রাজনীতি বহুধাবিভক্ত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ায় তাদের আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সমর্থনের ভিতও দারুণভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ কারণে তারা আগের মতো আওয়ামী লীগের জন্য সহায়তা জোগাতে পারছে না। সরলভাবে বলা যায়, আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যে ইন্টেলেকচুয়াল ঘাটতি তার অন্যতম কারণ এটাই। ঐতিহাসিকভাবেই দেশের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নেতৃত্বের অবস্থান আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারেনি। এ দায়িত্ব পালন করেছে বামপন্থি শক্তি এবং তা কাজ করেছে আওয়ামী লীগের রাডার হিসেবে। এখন এ পরিপূরক শক্তির যথাযথ সহায়তা না পাওয়ায় নানা বিভ্রান্তি ও পদস্খলন আমরা লক্ষ্য করছি। অনেকের বিবেচনায় বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ এখন মুসলিম আওয়ামী লীগে রূপ নিতে চলেছে। তারা মুখে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলছে, কিন্তু বাস্তবে চলছে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও সংস্কৃতির সঙ্গে আপস করে। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগে তার নেতৃত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারলেও এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক দিকনির্দেশনার ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করতে পারেননি। এ জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সার্বিক পরিস্থিতি যে অনেকাংশে দায়ী, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। আশির দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব বিপর্যয়ে পড়ার পর বিশ্বব্যাপী দক্ষিণপন্থার শক্তি বেড়েছে। এর প্রভাবে অনেক দেশে বাম-মধ্যপন্থার অনুসারী দলকে দক্ষিণপন্থার প্রতি ঝুঁকে পড়তে দেখা গেছে। বাংলাদেশেও আমরা তা লক্ষ্য করি। বিশেষভাবে সবচেয়ে বড় ও গণভিত্তিসম্পন্ন দল আওয়ামী লীগেই তা বেশি করে লক্ষ্য করা যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার দীর্ঘ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা বাংলাদেশের রাজনীতিকে সাম্প্রদায়িকতামুক্ত করতে বহুলাংশে সফল হয়েছিলেন। নিজের দলকেও তিনি এর উপযোগী করে গড়ে তোলার প্রয়াস পান। কিন্তু পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ, বিশেষ করে সামরিক শাসনামলে পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। এখনও তার জের চলছে। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথে দেশকে ফিরিয়ে আনার জন্য সুপ্রিম কোর্ট যে সুযোগ করে দিয়েছেন তা কাজে লাগাতে চলছে টালবাহানা। আইনমন্ত্রী এমন হাস্যকর উক্তিও করেছেন যে, সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম রেখেও ধর্মনিরপেক্ষতা সম্ভব। এ তো সোনার পাথরবাটি!
আমি মনে করি, আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ফিরে না গেলে তার পক্ষে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং সেক্যুলার বাংলাদেশ গড়ে তোলা কঠিন হবে। দেশের অর্থনীতিতে এখন অরাজকতা বিরাজ করছে। এর চেয়েও ভয়ঙ্কর চিত্র_ সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নেতৃত্বশূন্যতা। সমাজের অভ্যন্তরে প্রগতিশীল সংস্কৃতির চাপ না থাকায় ফতোয়াবাজ ও উগ্র মৌলবাদ সমাজে কর্তৃত্ব বিস্তারের প্রয়াস পাচ্ছে। আইন করেও তা প্রতিহত করা যাচ্ছে না। কিন্তু এর মধ্যেও স্বাধীনতার ৪০তম বছরে সম্ভাবনাময় প্রবণতা হচ্ছে, সমাজের প্রগতিশীল সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তিগুলো মিলিত হতে চেষ্টা করছে। সহিংস মৌলবাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণের জন্য কাজ করছে। আওয়ামী লীগ এখন পর্যন্ত এ উদ্যোগ কাজে লাগাতে পারছে না, যেমনটি তারা করেছিল ১৯৫২ সালে। ষাটের দশকেও আমরা এটা দেখেছি। অথচ তাদের মধ্যে এখনও দ্বিধা ও দোদুল্যমানতা কাজ করছে। আমরা দেখেছি, পঞ্চাশের দশকে বামদের প্রগতিশীল সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারাতেই ষাটের দশকে নতুন আওয়ামী লীগ গড়ে ওঠে এবং বঙ্গবন্ধু তার নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন। তিনি দলে এবং দেশের মধ্যেও সেক্যুলার চরিত্র নিয়ে আসতে সক্ষম হন। বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যদি এ ধারায় চলতে ব্যর্থ হয় তাহলে আমাদের যত হতাশার কারণই হোক না কেন, অসাম্প্রদায়িক সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন পুনর্নির্মাণের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠবেই। এখন এ সম্ভাবনা দেখা না গেলেও অদূর ভবিষ্যতে তা দেখা যাবে বলেই আমার বিশ্বাস। ষাটের দশকের শুরুতেই শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বে দীর্ঘদিনের জন্য শূন্যতা সৃষ্টি হবে বলে যে শঙ্কা ছিল, শেখ মুজিবুর রহমানের আকস্মিক অভ্যুদয়ে তা ভুল প্রমাণ হয়। তার এ উত্থানের পটভূমি হিসেবে কাজ করেছে সামাজিক-সাংস্কৃতিক বহুমুখী আন্দোলন, যার পেছনে বামপন্থি শক্তির যথেষ্ট অবদান ছিল। তিনি দেশে অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে সফল হন। স্বাধীনতা অর্জনের চার দশকে এসে এখন আমাদের সামনে প্রধান চ্যালেঞ্জ হচ্ছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং তাতে জয়ী হতে হলে শক্তিশালী রাজনৈতিক আন্দোলন অপরিহার্য। এ আন্দোলনে জয়ী হওয়ার অপরিহার্য শর্ত হচ্ছে, অসাম্প্রদায়িক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক শক্তির সঙ্গে প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তির মেলবন্ধন। এ প্রত্যাশা পূরণ করতেই হবে।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী : সাংবাদিক
No comments