লোভের আগুনে মিনি-মাগনা জীবনগুলো by ফারুক ওয়াসিফ

বাতাসে পোড়া মাংসের গন্ধ। লাভের কাবাব হয়ে গেছে ১১১টি তরতাজা প্রাণ। উদ্ধারকাজ সমাপ্ত করে চলে গেছে ফায়ার সার্ভিস। শোকবাণী, ক্ষতিপূরণের প্রতিশ্রুতি ইত্যাদিও ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু পুড়ে অঙ্গার হয়ে চেনার অতীত দেহগুলো চিনিয়ে দেবে কে? মানুষ শরীরী জীব।
জীবিত মা-বাবা-ভাই-বোন-স্বজনেরা মৃত মা-বাবা-ভাই-বোন-স্বজনের পোড়া শরীরটা অন্তত পেতে চায়। শেষবার বুকে জড়িয়ে ধরার জন্য, বুকচাপা হুতাশন উজাড় করে কাঁদবার জন্য। পুড়ে কালো হওয়া কিছু শরীর অবশ্য আছে সেই ভবনে। কিন্তু আগুনে পুড়ে গেছে তাঁদের নাম-পরিচয়-চেহারা। কে কার বুকের ধন, কে চিনিয়ে দেবে? কে?
একটি একটি লাশ বের হয়, আর ওই কারখানারই শ্রমিক আনোয়ার প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে খোঁজেন স্ত্রী রেহানার মুখ। দুজনই একসঙ্গে রংপুরের মিঠাপুকুর থেকে এসেছিলেন ভাগ্য ফেরাতে। একসঙ্গেই কাজ করতেন। ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে গেছেন, ভাগ্যক্রমে স্ত্রী পুড়ে গেছেন। এখন পোড়া লাশগুলোর মধ্য থেকে স্ত্রীকে আলাদা করতে পারছেন না, এটাও ভাগ্যের ক্রম। এই ক্রম বা ধারাবাহিকতায় আমাদের অনেকেরই গায়ে উঠেছে রেহানাদের বানানো পোশাক। সস্তায় কেনা যায়, পরেও আরাম। রেহানারা পুড়ে গেলেও গায়ের পোশাকগুলো পোড়েনি, ত্বকে জ্বালা ধরেনি। গত লন্ডন অলিম্পিকে আমাদের মেয়েদের হাতে বানানো পোশাক পরে খেলতে নেমেছিলেন কয়েকটি দেশের খেলোয়াড়েরা। রেহানারা পুড়ে গেলে তাঁদেরও কোনো অসুবিধা হবে না। শত শত রেহানা পুড়ে মরলে এই পোড়া দেশে কারোরই কোনো অসুবিধা হয় না। কারও বিচার হয় না। সবই ভাগ্য যদি, তাহলে কারও ভাগ্যে এত স্বর্গীয় সুখ আর দায়মুক্তি, আর কারও ভাগ্য এত নারকীয় কোন বিচারে? মানুষের জীবন একটাই। সেই জীবন এমনই বিরল, একবার গেলে ফিরিয়ে দেয় এমন সাধ্য কারও নেই। তার পরও কেন কারও জীবন অন্যের লোভের অনলে খড়-কুটোর মতো এমন অবলীলায় পুড়ে যায়? মানুষের জীবন এত সস্তা পাওয়া যায় কোন বাজারে? কিসের বাজার সেটা?
তার নাম শ্রমবাজার। বাংলাদেশে সেই বাজার অতীব সস্তা। সস্তা বলেই বিদেশি ক্রেতারা আসেন, সস্তা শ্রমের কারখানা গড়েন। দেড়-দুই কেজি চালের দামের থেকেও সস্তায় এখানে দিনকাবারি হিসেবে শ্রম কেনা যায়। আমাদের বিপুল জনসংখ্যা যেন শ্রমের আড়ত। সেই আড়তের ঠিকাদার আছেন, ব্যবস্থাপক আছেন, প্রশাসক আছেন। তাঁরা সস্তায় শ্রম বেচে দেশের ‘উন্নতি’র ব্যবস্থা করেন। সেই উন্নতির জ্বালানি জোগাতে গ্রামের গরিব নারী-পুরুষেরা দল বেঁধে আসেন সেই বাজারে। জীবনে যেমন, মরণেও তেমনই সস্তা এঁরা। কারখানার ছাদ ধসে কিংবা আগুনের পর আগুনে পুড়ে তাঁরা মারা যান। দয়াপরবশ হয়ে সরকার বা পোশাকশিল্পের মালিকেরা জনপ্রতি জীবনের মূল্য ৫০ হাজার, কি এক লাখ টাকা নির্ধারণ করে দেন। আদিম পরিবেশে কোনো প্রাণীকে ক্ষুধা মেটানোর জন্য যতটা পরিশ্রম করতে হয়, আমাদের পোশাকশ্রমিককে কাজ করতে হয় তার থেকে বেশি। দিনে প্রায় ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা! তাঁদের জীবন তাই মানবিক নয়, প্রাণবিক। যাঁরা মানুষের জীবন পাননি, তাঁরা মানুষের মতো মরণ পাবেন কীভাবে?
জীবনের মতো, শ্রমের মতো আমাদের শ্রমিকদের মৃত্যুও অতীব সস্তা। শ্রমবাজার তাই লাশেরও বাজার। আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এভাবে বিশ্বায়িত দুনিয়ার শ্রমদাসের ভাগ্য পেয়েছে। আসুন, দেখুন, নিয়ে যান জীবিত বা মৃত।
এক হিসাবে দেখা গেছে, ২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আগুনে পুড়ে জীবন হারিয়েছে ৪১৪ জন। গত মে মাসে গাজীপুরে এক পোশাক কারখানায় পুড়ে মারা গেছেন ২১ জন শ্রমিক। বছরে এক থেকে দেড় শ জন পোশাকশ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যান। দেশের মতো বিদেশেও তাঁরা এভাবেই মরেন। ২০০৯ সালেই বিদেশ থেকে এসেছিল প্রায় আড়াই হাজার প্রবাসী শ্রমিকের লাশ। তার পরও সব মৃত্যু নয় সমান, আগুন নরকের প্রতীক। নরকের আগুনের ভয়ই মানুষের সর্বোচ্চ ভয়। এ কোন নরক বানিয়ে নিরাপদে ঘুমাচ্ছেন দেশের চালকেরা? কোনো মাথাব্যথা নেই?
মাছের মায়ের নাকি পুত্রশোক নেই। বাংলা মায়ের বেশুমার সন্তান। তার থেকে কয়েক শ আগুনে পুড়ে, কয়েক শ ভবন বা ফ্লাইওভার ধসে, কয়েক শ নদীতে ডুবে, কয়েক শ সড়ক দুর্ঘটনায়, কয়েক শ জাকাত নিতে গিয়ে পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে বা ফ্লাইওভার ধসে মারা গেলে কার কী বা যায় আসে! আর পুত্রশোকের থেকে নিশ্চয় কন্যার শোক অনেক কম! বাংলার ভাওয়াইয়া গানের নারীরা, ভাটিয়ালি গানের পল্লি¬বালারা, জসীমউদ্দীনের সোনাই বন্ধুরাই তো আজকের নারী পোশাকশ্রমিক। এঁদের শ্রমের মতো এঁদের জীবনও জাতীয় উন্নতির জ্বালানি। জ্বালানি তো জ্বলবেই, তাই না? বাংলা মায়ের তাতে শোক হবে কেন? কিন্তু আজ আমরা বাংলা মায়ের চোখে পানি দেখতে চাই। একটু কান্না, একটু অপরাধবোধ, একটু দায়িত্ববোধ ছাড়া মানুষ মানুষ থাকতে পারে না।
আমরা যাঁরা মরে যাইনি আজও, এ রকম কোটি কোটি বাঙালি আজ শোকার্ত। আমরা আমাদের সম্ভাব্য মৃত্যুর মহড়া দেখে শঙ্কিত। আমরা ভীত এই শুনে যে আগুন লাগা তাজরীন ফ্যাশনের এক নারী কর্মী বলেছেন, ‘আমাগো বাহির হইতে দ্যায় নাই।’ এর তদন্ত অবশ্যই হতে হবে। কারখানাটির শ্রমিকদের নিয়োগপত্র ছিল কি না, না থাকার সুবিধা নিয়ে লাশের সংখ্যা নিয়ে কারচুপি কেউ করছে কি না—দেখা দরকার তা-ও। শ্রম, ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যবস্থাপক রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে জবাবদিহি করতে হবে সরকারকেও। কোনো দায়সারা প্রেসনোট আমরা চাই না। আমরা চাই জনগণের জানমালের রক্ষার শপথ নিয়ে সেই শপথ বারবার ভাঙার জবাব। শিল্পী কফিল আহমেদের এই গানটাই আমাদের সব কথা বলে দিয়েছে:
‘আমাকে তালাবদ্ধ রেখে,
আমাকে আগুনে পুড়িয়ে মেরে,
প্রেসনোট, শুধু প্রেসনোট
আমি চাই না, আমি চাই না,
বদ্ধ দমবদ্ধ ঘরে
আমার এ আটক মানি না।
কারখানা যেন বন্দিশিবির
জীবন কেন এতটা স্থবির।
মানি না, আমি মানি না।’

No comments

Powered by Blogger.