অরণ্যে রোদন- কী যে ভালো আমার লাগলো! by আনিসুল হক

‘কী যে ভালো আমার লাগলো আজ এই সকালবেলায় কেমন করে বলি। কী নির্মল নীল এই আকাশ, কী অসহ্য সুন্দর।’ লিখেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু, এমনি এক হেমন্তে, সেই কত যুগ আগে, চিল্কা হ্রদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে। আর আমার আজকের সকালটিতে কী যে ভালো লাগছে, কেমন করে বলি।
আবহাওয়া সত্যি সুন্দর, শিশিরকণা ঝরে পড়া শিউলির বোঁটায়, আলোয় ঝলমল করছে চারদিক। কিন্তু সেও তো বাহ্য! অন্তরের জানালায় রোদ উঁকি দিচ্ছে। এমন তীব্র ভালো লাগার মুহূর্তে চোখে অকারণে জল চলে আসে। একটা বাক্য বারবার করে নিজেকে বলি, ‘আজ বড় মানুষ না, আমাদের ভালো মানুষ দরকার।’ এই সোনার হরফে লিখে রাখার মতো উক্তিটি যিনি করেছেন, তাঁর নাম আছমা খাতুন। তিনি পরিচ্ছন্নতাকর্মী। কিশোরগঞ্জের করিমপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ঝাড়ুদারের কাজে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৯১ সালে। নিজের মমতাভরা হূদয় তাঁর কাজের পরিধি আপনিই বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি নবজাতকের শুশ্রূষা করেন। ১৭ হাজার নবজাতকের পরিচর্যা করেছেন। ‘নিজের জীবন আর কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলি, দিন দিন আমাদের আন্তরিকতা কমে যাচ্ছে। সবাই যান্ত্রিক হয়ে যাচ্ছি। সবাই অর্থের পেছনে দৌড়াই। আগের চিকিৎসকেরা আগে রোগীকেই সুস্থ করতেন। পরে প্রাপ্য নিতেন। এখন টাকাই আগে। আমার মনে হয়, আজ বড় মানুষ না, ভালো মানুষের বড় দরকার।’ আছমা খাতুনের এই কথা আমার বুকের গভীরে নাড়া দেয়। উপলব্ধির কোন স্তরে উন্নীত হলে একজন শ্রমজীবী নারী এই রকমের একটা কথা বলতে পারেন।
না, আছমা খাতুন, আপনার কথা পুরোটা ঠিক নয়। সবাই অর্থের পেছনে দৌড়ায় না। কাজের পেছনে ছোটে, অনেকেই আছেন, অকাজের পেছনেও ছোটেন, নিজের খেয়ে নিজের পরে, পরের ভালোর জন্য প্রাণপাত করেন। এই দেশে এই সমাজে তেমন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।
আছমা খাতুনের লেখাটি প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যার দ্বিতীয় পর্ব ‘বাংলাদেশের হূদয় হতে’-তে প্রকাশিত হয়েছে ২৪ নভেম্বর ২০১২। ওই সংখ্যাতেই তো আমরা পড়লাম পলান সরকারের কথা, রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় তিনি বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বই বিতরণ করতেন, এখন পরিণত হয়েছেন বইপড়া আন্দোলনের প্রতীকপুরুষে। পড়লাম দিনমজুরের সন্তান আরজিনা খাতুনের কথা, যিনি ৩০০ নারীকে নিয়ে পল্লিসমাজ নামের সমিতি গড়েছেন, নিজেদের ভাগ্য বদলানোর কাজ করছেন, নারীর পাশে নারীকেই দাঁড়াতে হবে বলে ডাক দিচ্ছেন। নক্ষত্রের মতো আরও কত নাম নেওয়া যাবে ওই সংখ্যাটা থেকে, বৃক্ষবন্ধু কার্তিক পরামানিক, চায়ের দোকানদার আবদুল খালেক, যিনি স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি দান করেছেন, এখনো ওই স্কুলের পাশে চা বিক্রি করেন, টিভি মেকানিক থেকে সৌরশক্তিচালিত আইপিএসের প্রবর্তক আবদুর রহিম, বাল্যবিবাহবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা শিবুপদ বিশ্বাস, সুগন্ধি চালের সংগ্রাহক আবদুল বাছিত সেলিম, শ্রেষ্ঠ বিদ্যালয়ের পুরস্কারপ্রাপ্ত শিক্ষক বিজয় কুমার, বিষমুক্ত কৃষির প্রচারক গিরিশ চন্দ্র রায়, গাছদাদা আজিজুল হক, গ্রামে খেলোয়াড় তৈরির কারিগর মো. বাদশারুল ইসলাম, বয়স্ক শিক্ষা বিস্তারের প্রয়াসী আকবর আলী, গরিব শিক্ষার্থীদের বন্ধু পাঠশালার নির্মাতা মো. আবু রায়হান, ক্রিকেট ব্যাট তৈরি করে অভাব দূর করতে পারা নিলুফার ইয়াসমিন, পাঠশালা প্রতিষ্ঠাতা সুবীর বিশ্বাস, সুন্দরগঞ্জের অনন্য স্কুল অনন্যসাধারণ শিক্ষক নুরুল আলম, চলনবিল হাসপাতালের ডা. খলিলুর রহমান, কানাই মাস্টার কানাই চন্দ্র দাস, কিংবা কারুশিল্পী আনোয়ার হোসেন, আদিবাসী বস্ত্রের প্রসারী মঞ্জুলিকা চাকমা, ভাওয়াইয়া গানের হারুন অর রশীদ, আইসক্রিমের কাঠির কারিগর প্রদীপ সরকার প্রমুখের কথা। এঁরা সবাই গ্রামে থাকেন, অনেকেই বিরূপ অর্থনৈতিক পটভূমিতে কাজ করেছেন, কিন্তু সবাই নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন। সৃজনশীলতা, পরিশ্রম, সাধনা আর মানবকল্যাণের লক্ষ্য তাঁদের একেকজন নায়কে পরিণত করেছে, আমরা যাঁদের বলে আসছি বিশাল বাংলার নেপথ্যের নায়কেরা। এঁরা ভালো মানুষ হয়েছেন আগে, কাজেই এঁরাই আমাদের প্রকৃত বড় মানুষ।
প্রথম আলো তার প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যার দ্বিতীয় পর্বে সত্যি সত্যি বাংলাদেশের হূদয় হতে অপরূপ রূপে বের হয়ে আসা বড় মানুষ আর ভালো মানুষদের কথা বলে আমাদের আত্মবিশ্বাসকে সুদৃঢ় করেছে। আজকে, হেমন্তের এই সকালে সবুজ গাছের পাতায় পাতায় আলোর যে ঝিলিক, তা-ই যেন ঠিকরে পড়ছে প্রথম আলোর পাতায় পাতায়। বাংলার এই নিজস্ব নায়কদের পাশাপাশি এই সংখ্যাতেই আমরা পড়লাম সেই সব বিদেশি বন্ধুর কথা, যাঁরা বাংলাদেশে এসেছিলেন কোনো না কোনো কার্যোপদেশে, তারপর বাংলার মানুষের প্রতি ভালোবাসা তাদের কী এক মায়ার বন্ধনে আটকে ফেলেছে, তাঁরা বাংলার মানুষের সেবার কাজ করে চলেছেন। এঁদেরই একজন জুলিয়ান ফ্রান্সিস, যিনি বাংলাদেশে এসেছিলেন সেই ১৯৭২ সালের জানুয়ারিতে, যিনি ওই সময় অক্সফামকে চিঠি লিখেছিলেন, বলেছিলেন, বিশ্বসম্প্রদায় যথেষ্ট পরিমাণে খাদ্য সাহায্য না দিলে এবং অবকাঠামো দ্রুত মেরামত করা না হলে বাংলাদেশ একটা রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে নাও পারে। সেই জুলিয়ান ফ্রান্সিস আজ লিখছেন, ‘আমার জন্য খুবই আনন্দের বিষয় যে আমার ওই ধারণা মিথ্যে প্রমাণিত হয়েছে।’ বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে শুধু টিকে আছে তা নয়, ভালো করছে। তিনি লিখেছেন, ‘এখন আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, কেউ আর না খেয়ে মারা যায় না।’ অথচ জনসংখ্যা এখন ১৯৭২-এর তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি। তিনি বলছেন আমাদের কৃষিক্ষেত্রের সাফল্যের কথা; বলছেন, ১৯৭২ সালে ঢাকার রাস্তায় খুব কম নারীকেই দেখা যেত, এখন মেয়েদের শিক্ষাক্ষেত্রে নাটকীয় অগ্রগতি হয়েছে, আর পোশাকশিল্পের বিকাশ নারীর ভাবমূর্তি বদলে দিতে সাহায্য করেছে।
এই কথাগুলো এবং এমন অনেক সাফল্যের কথা আমরা পড়েছি প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যার প্রথম পর্ব উজ্জ্বল অর্জন-এ, ২৩ নভেম্বর ২০১২। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ লিখেছেন, বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্র নয় কেন। অধ্যাপক চিকিৎসক মো. নজরুল ইসলাম জানিয়েছেন, শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে। কৃষিক্ষেত্রে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের কথা বলেছেন মাহবুব হোসেন, লিখেছেন ‘সাফল্যের আকাশে জ্বলজ্বলে তারা’। জনস্বাস্থ্যে আমাদের আছে অলৌকিক অর্জন, জানিয়েছেন আহমদ মোশ্তাক চৌধুরী। যেমন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে আমাদের সাফল্যের কথা শুনেছি অধ্যাপক এ কে এম নুর-উন-নবীর কাছে। আজকে আপনারা যে কাগজটি হাতে পেয়েছেন, তাতে স্পেনের রানি সোফিয়া থেকে শুরু করে বিল গেটসের পিতা উইলিয়াম গেটস হয়ে সৌরভ গাঙ্গুলীর মুখ থেকে শুনতে পাবেন বাংলাদেশের সাফল্যের ব্যাপারে প্রশংসার কথা। সত্যি, সুকান্তের ওই পঙিক্তগুলো বারবার করে বলতে হবে, ‘সাবাস, বাংলাদেশ, এই পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়, জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়’।
১৩ নভেম্বর আমরা গিয়েছিলাম রাজবাড়ীর অজপাড়াগাঁ পদমদিতে। ওখানে বিষাদ-সিন্ধুর লেখক মীর মশাররফ হোসেনের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠান ছিল। আমার সঙ্গে ছিলেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান আর সভাপতি আনিসুজ্জামান। রাতের বেলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে। আশপাশের গ্রামের মানুষ ভিড় করে সেই অনুষ্ঠান দেখছে। নারী-পুরুষ শিশু বৃদ্ধ। আমি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলাম, একজন দর্শকও নেই যার পরনে মলিন ছিন্ন বস্ত্র। প্রায় সব কিশোর-তরুণ-যুবক জিনসের প্যান্ট পরা, তাদের গায়ের পোশাকটাও ঝকঝকে। শুধু পোশাক নয়, তাদের চোখেমুখে উজ্জ্বলতা, কারও মুখে দীনতার কোনো চিহ্ন নেই। এটা একটা অজপাড়াগাঁ? একটা উপজেলা সদরও তো এটা নয়! আশ্চর্য তো। বাংলাদেশ কখন পাল্টে গেছে আমার নজরের বাইরে?
ড. আনিসুজ্জামানকে আমার পর্যবেক্ষণটা জানালাম, স্যার বললেন, যারা বলে ৪০ বছরে কোনো অগ্রগতি হয়নি, তাদের ডেকে এনে দেখাও।
আসলে আমাদের এই সমুদয় উন্নয়নের মূলে আমাদের স্বাধীনতা। আর আমাদের এই চমৎকার উন্নয়নের মূল কারিগর আমাদের দেশের মানুষ, সাধারণ মানুষ, পরিশ্রমী সৃজনশীল উদ্যমশীল মানুষ। তাই তো বাংলাদেশ সম্পর্কে ভাবতে বিশ্বের উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে, সুশাসনের অভাব আর দুর্নীতি সত্ত্বেও দেশটা এত উন্নতি করছে কী করে, একে তাঁরা নাম দিয়েছেন বাংলাদেশ প্যারাডক্স। ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ যার বাংলা করেছেন ‘উন্নয়ন ধাঁধা’।
শওকত হোসেনের লেখা (২৩ নভেম্বর ২০১২) থেকে জানলাম, বাংলাদেশকে এখন রাখা হচ্ছে নেক্সট ইলেভেন কিংবা ফ্রন্টিয়ার ফাইভ-এ। মানে যে ১১টা বা পাঁচটা দেশ এরপর পৃথিবীতে ভালো করবে, বাংলাদেশ তাদের একটা। চীন তৈরি পোশাকের প্রতিযোগিতায় আর নিজেকে রাখছে না, ভারত তার বাজার বাংলাদেশের জন্য খুলে দিচ্ছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নতিতে উল্লম্ফন দেখা দেবে। অন্য সব হিসাব বাদ দিন, ৯৭ শতাংশ ছেলেমেয়ে স্কুলে যাচ্ছে, হাজার হাজার ছেলেমেয়ে জিপিএ-৫ পাচ্ছে, ২০ বছর পর এরা যদি কৃষকও হয়, হবে আলোকিত কৃষক, বিদেশে গেলে হবে শিক্ষিত দক্ষ শ্রমিক। সেই বাংলাদেশ একটা সম্পন্ন বাংলাদেশ হবেই, এটা আমার চ্যালেঞ্জ।
কিন্তু ২৩ নভেম্বরের ‘উজ্জ্বল অর্জন’ শীর্ষক সংখ্যাটিতেই মাননীয় স্পিকার আবদুল হামিদের লেখার শিরোনাম, ‘রাজনীতিতে সহিষ্ণুতার অভাব’। মাহ্ফুজ আনাম লিখেছেন, ‘বাইশ বছরের গণতন্ত্র দিয়ে আমরা কী করেছি’? সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান লিখেছেন, ‘বুড়িগঙ্গা মরুক এটাই কি ওরা চায়’?
আসলে আমাদের বাংলাদেশ তরতরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, এই অগ্রগতি আরও বেগবান হতো, আরও সুন্দর হতো, যদি আমাদের রাজনীতির সংঘাতটা একটা পরিমিতির মধ্যে থাকত, যদি আমরা সুশাসন পেতাম, যদি আমাদের কৃষক, শ্রমিক, অভিবাসীদের কষ্টার্জিত টাকা তানভীরেরা কিংবা শেয়ার কেলেঙ্কারির হোতারা বা দুর্নীতিবাজ সুপুত্রেরা বাইরে পাচার না করত। আর আমাদের উন্নয়নের প্রধান বলি হচ্ছে আমাদের পরিবেশ, আমাদের নদী, আমাদের কৃষিজমি বা খোলা মাঠ।
আমরা কি দুর্নীতিমুক্ত, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধসম্পন্ন, পরিবেশের প্রতি যত্নশীল রাজনীতি কোনো দিনও পাব না? আজ আশার পসরা সাজানোর দিন। আজ প্রথম আলোর চরণধ্বনি বেজে উঠেছে ভোরের আকাশে। আজ আমরা বরং আছমা খাতুনদের কথা শুনব, তাঁদের কাজ থেকে প্রেরণা নেব। এই দেশে ভালো মানুষ আছেন, বড় মানুষদের এখন ভালো মানুষ হয়ে উঠতে হবে।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.