শেয়ারবাজার-বাজার ব্যবস্থাপনা ও বাংলাদেশ ব্যাংক by বোরহান উদ্দীন

 শেয়ারবাজারসহ দেশের অর্থনীতির ভিতকে শক্ত রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দৃষ্টি নিবন্ধন আবশ্যক। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণে এসইসির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত রাখার জন্য অনুরোধ করছি
১৮ আগস্ট ২০১০ সাল। শেয়ার মার্কেটে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছিল। তাহলো বাজার মূলধন ৩ লাখ কোটি টাকারও বেশিতে অতিক্রম করা। নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে যেমন বাজার মূলধনের পরিমাণ বেড়েছিল, অন্যদিকে শেয়ার সংখ্যা আর্থিক লেনদেন মূল্যসূচক সব দিক থেকেই এক অস্বাভাবিক উচ্চতায় অবস্থান করেছিল শেয়ারবাজার। এ বৃদ্ধিকে তৎসময় ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কর্তৃপক্ষ বলেছিল, অর্থনীতি ভালো অবস্থায় থাকলে এরকম হয়ে থাকে। কর্তৃপক্ষের অভিমত, এতে কর্মসংস্থানের সৃষ্টিও হয়েছে।
কিন্তু শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞদের মতামত হলো, এ যে নিয়ন্ত্রণহীন ঊর্ধ্বমুখী বাজার লাগামহীন ঘোড়ার মতো থাকে। যাকে নিয়ন্ত্রণে না আনতে পারলে ক্ষুদ্র-মাঝারি পর্যায়ের বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকির মধ্যে থেকে তাদের পুঁজি হারাবে। মূলধনের বিষয় বিশেল্গষণ করলে দেখা যায়, ২০০৯ সালের শেষ দিকে শেয়ারবাজারের মূল্যসূচক ছিল ৩১৮৭ পয়েন্ট, ২০১০ সালের আগস্টে সূচক বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৬৭১৯ পয়েন্টে। আর আজ যে সময় লিখতে বসেছি তখন শেয়ারবাজারের শেয়ারের মূল্যপতন এমন পর্যায়ে পেঁৗছেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সরকারকে বেকায়দায় ফেলানোর জন্য এটি একটি বড় চক্রের কাজ। ডিএসসি কর্তৃপক্ষ এখন কী বলবে? দেশের অর্থনীতি কোন পথে? এটা কি ইতিবাচক না নেতিবাচক? ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অবস্থান কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার বিভিন্ন লেখায় বলেছিলাম, যদি ১৯৯৬ সালের মতো শেয়ারবাজারের পতন ঘটে তবে মধ্য ও নিম্নবিত্ত বিনিয়োগকারীরা নিঃশেষ হয়ে যাবে। বিপরীতে এর প্রতিফলন শুধু শহরে ঘটবে না, গ্রামীণ অর্থনীতিতে বিপরীতমুখী অবস্থান ঘটবে। সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল যে, ১৯৯৬ সালের মতো বিদেশি কোম্পানি দিয়ে পুঁজি বাজার থেকে অর্থ তুলে নেওয়ার ফন্দি এঁটেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর পূর্বাভাস দিয়েছিলেন 'হুজুগে শেয়ার বেচাকেনা না করার জন্য।' গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেছিলেন, পুঁজি বাজারের অস্বাভাবিক শেয়ারদর ্বৃদ্ধিতে কোনো দুরভিসন্ধিমূলক কাজ থাকতে পারে। এজন্য তিনি বলেছিলেন, এসইসির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ দৃষ্টি রাখবে। ব্যাংকগুলো আইন ও নীতিমালা মেনে চলছে কি-না তদন্ত করে দেখতে হবে। পরিদর্শন দল তীক্ষষ্ট দৃষ্টি রাখবে, কোম্পানির লভ্যাংশ, কোম্পানির মূল্যভিত্তিসহ সার্বিক আয়-ব্যয়ের ব্যবস্থা দেখে যাতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করে সেদিকে দৃষ্টি রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেয়ারবাজারে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি পরিদর্শনে ও নিয়ন্ত্রণের প্রস্তাব নিঃসন্দেহে শেয়ারবাজার উপকৃত হতো। বিধিবাম, এতে স্টক মার্কেটের কর্তা ব্যক্তিরা নানাভাবে এর প্রতিবাদ জানালেন। বলতে লাগল, এতে স্টক মার্কেটের সঠিক কর্মকাণ্ডে চলমান গতি বাধাগ্রস্ত হবে। থমকে যেতে পারে বেচাকেনার বাজার ব্যবস্থা।
প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিভিন্ন নিয়ন্ত্রণ সংস্থা মার্চেন্ট ব্যাংক শেয়ারে ঋণ প্রদান, ব্রোকারেজ হাউজগুলোর শেয়ার বেচাকেনা, অতিমাত্রায় বেহিসাবি লেনদেন করছে কি-না তা যদি দেখা যেত এবং কার্যকর করত তা হলে আজ আকাশচুম্বী পতন ঘটত না।
শেয়ারবাজারে অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যাদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি আছে কিন্তু অস্তিত্ব নেই বা থাকলেও বন্ধ রয়েছে। তাদের শেয়ারও বেচাকেনা হচ্ছে। শেয়ারবাজারে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের বৃহৎ অঙ্কের বিনিয়োগকারীরা ব্যাঙ ও বালকদের ঢিল ছোড়ার মতো খেলে নিঃশেষ করে দিয়েছে। শেয়ারবাজারকে বর্তমান প্রজন্ম ভাবছে কষ্টের পথে থেকে আয় বা দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে না জড়িয়ে শ্রমবিহীন মাধ্যমে শেয়ারে বিনিয়োগ করে রোজগার-আয় করা যায়। সুতরাং দুই হাতকে কর্মের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার না করে গ্যাম্বলিংয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বা করা যায় তাই তো উত্তম।
শিক্ষিত যুবক শ্রেণীকে কালক্ষেপণ না করে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে উৎসাহিত না করলে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে না। শেয়ারবাজারে নিবন্ধিত থেকে একরকম অলসতায় পরিপূর্ণ হয়ে জীবন অতিবাহিত করবে। বাজারে ছন্দপতন ঘটলে হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়বে। এটা দেশের জন্য ক্ষতিকর।
বর্তমান শেয়ারবাজারের অস্বাভাবিক লেনদেনের কারণে যে পতন ঘটেছে তার জন্য সরকার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আমি আমার মত বলছি।
১. একটি শেয়ারের অবিহিত মূল্য ১০ টাকা, সে শেয়ারটি বাজারে কী করে ১২০ টাকা অর্থাৎ ১২ গুণ বৃদ্ধিতে বাজারে বেচাকেনা হয়। যেখানে প্রতিষ্ঠানের প্রকাশিত লভ্যাংশের তুলনায় এক অস্বাভাবিকভাবে বেচাকেনার জন্য যে কৃত্রিমদর উঠানো হয়, তাদের খুঁজে বের করা। একটি প্রতিষ্ঠানের ১০০ টাকার শেয়ার ২৫০০-৩০০০ টাকায় বেচাকেনা হয়েছে, তিনশ'গুণ বৃদ্ধির সময় এসইসি কী করেছিল। তখন কেন সার্কিট ব্রেকার প্রয়োগ করা হয়নি।
২. ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সর্বস্ব নিঃশেষ করে যারা কোটি কোটি টাকা লেনদেন করেছেন, তাদের খুঁজে বের করা।
৩. বর্তমানে বাজার স্থিতিশীল হলেও যে দর পতিত হয়েছে সে হারে শেয়ারের দর উঠানো সম্ভব হবে কি-না ভবিষ্যতে বলে দেবে। তবে যারা বাজার থেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের হুজুগের মাধ্যমে প্রোপাগান্ডার কারসাজিতে টাকা তুলে নিয়ে শেয়ারদরের পতন ঘটিয়েছে, তাদের থেকে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা যায় কি-না পন্থা উদ্ভাবন করা।
৪. এসইসি এবং ডিএসসিতে সৎ ও যোগ্য এবং অভিজ্ঞ কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ। ভবিষ্যতে শেয়ারবাজারের স্থিতিশীলতা আনয়নে ব্যবস্থা গ্রহণ।
১০০ টাকার শেয়ার যখন ৩০০০ টাকায় বেচাকেনা হচ্ছিল, তখন কি এসইসি ওই কোম্পানির সম্পদের হিসাব-নিকাশ করেছিল? যদি না করে থাকে আজকে এ অবস্থার জন্য তাদের দায়ী করা উচিত।
৫. প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের বাজারে ছাড়া শেয়ারের বাজারমূল্যের সঙ্গে কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সম্পদ এবং ব্যবস্থাপনার একটি চিত্র ওয়েবসাইটে অথবা সিটিজেন চার্টার পদ্ধতিতে দর্শনীয় স্থানে বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রদর্শন করা। যাতে বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারে যে কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থান কেমন।
৬. সর্বোপরি বলা যায়, এসব কাজ করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় করাটা সমীচীন হবে।
যত প্রতিবাদই হোক না কেন শেয়ারবাজারসহ দেশের অর্থনীতির ভিতকে শক্ত রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ দৃষ্টি নিবন্ধন আবশ্যক। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রণে এসইসির পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ বাজার নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনায় নিয়োজিত রাখার জন্য অনুরোধ করছি।

বোরহান উদ্দীন : ব্যাংকার

No comments

Powered by Blogger.