পালাতে গিয়ে জামায়াত নেতা সুবহান জেলে

পাবনা-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির মাওলানা আবদুস সুবহান গ্রেপ্তার হয়েছেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব টোল প্লাজা থেকে তাঁকে গ্রেপ্তার করেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। রাতেই তাঁকে পাবনা কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
২০০৩ সালে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনায় পাবনা সদর থানার একটি মামলায় মাওলানা সুবহানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে বলে জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানার ওসি মো. ইউনুছ আলী মিয়া। এ ছাড়া মাওলানা সুবহান একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন গোয়েন্দা নজরদারির মধ্যে ছিলেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়েরের ইঙ্গিত পেয়ে সম্প্রতি দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। গতকাল পালাতে গিয়ে তিনি ধরা পড়েন বলে জানিয়েছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
মাওলানা আবদুস সুবহানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে জামায়াত-শিবির পাবনায় বিক্ষোভ মিছিল বের করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে। এতে সাংবাদিক, পুলিশসহ কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়েছে। এ ঘটনায় পুলিশ আট শিবিরকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে।
আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক আবদুল হান্নান কালের কণ্ঠকে বলেন, এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রসিকিউশনের মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের কাছে মাওলানা সুবহানের বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিলের অনুমতি চাইবেন। তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নিয়মিত যে হাসপাতালে সুবহান চিকিৎসা নেন সেখানে না গিয়ে গোয়েন্দাদের নজর এড়াতে তিনি গত মঙ্গলবার রাজধানীর লালমাটিয়ায় অন্য একটি হাসপাতালে ভর্তি হন। এরপর বৃহস্পতিবার খুব ভোরে সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। এ ক্ষেত্রেও তিনি নিয়মিত যে গাড়ি ব্যবহার করেন সে গাড়ি না নিয়ে অন্য গাড়ি নিয়ে যাচ্ছিলেন। ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতুর দিকে অগ্রসর হওয়া গাড়িটি একেকবার একেকদিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। আটকের পর গোয়েন্দাদের কাছেও তিনি গন্তব্য সম্পর্কে এলোমেলো তথ্য দেন।
এদিকে তদন্ত সংস্থা সূত্র জানিয়েছে, একাত্তরে পাবনায় গণহত্যা, লুটপাটসহ নানা অপরাধে যুক্ত থাকার ব্যাপারে প্রাথমিক তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। পাবনা রাধানগর আলিয়া মাদ্রাসায় ছিল একটি নির্যাতন ক্যাম্প। সেখানকার দায়িত্বে ছিলেন সুবহান। মতিউর রহমান নিজামী ও মাওলানা সুবহান ৫০-৬০ জনের একটি বাহিনী নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে এ ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালাতেন। এরপর তাদের হস্তান্তর করা হতো নুরপুর ওয়াপদা আর্মি ক্যাম্পে। মাওলানা সুবহানের নেতৃত্বে কয়েক শ মানুষকে হত্যার পর লাশ পদ্মা ও যমুনা নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা তদন্ত কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন। ২০১০ সালের নভেম্বরে তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউটরদের একটি দল সরেজমিন তথ্য সংগ্রহকালে মাওলানা সুবহানসহ বেশ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ পায়। পরে তদন্ত সংস্থা বেশ কয়েকবার সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহে পাবনায় গিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে তাঁর সংশ্লিষ্টতার ব্যাপারে বিষদ বিবরণ পায়। তাঁকে গ্রেপ্তারের জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন দাখিল করার প্রস্তুতি চলছে।
মাওলানা সুবহানকে গ্রেপ্তার সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানার ওসি মো. ইউনুছ আলী মিয়া জানান, গতকাল ভোরে মাওলানা আবদুস সুবহান ঢাকা থেকে পাবনা যাচ্ছেন_এমন সংবাদের ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব টোল প্লাজায় অবস্থান নেয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে মাওলানা আবদুস সুবহানকে বহনকারী খয়েরি রঙের টয়োটা প্রাডো গাড়িটি (ঢাকা-মেট্রো-ঘ-১৩-০১৬৩) বঙ্গবন্ধু সেতুর পূর্ব টোল প্লাজায় পেঁৗছালে গাড়ির গতিরোধ করে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন মাওলানা আবদুস সুবহান ছাড়াও গাড়িতে তাঁর চতুর্থ ছেলে ও মিশন গ্রুপের পরিচালক নেসার আহম্মেদ নান্নু এবং ছোট ছেলে মুজাহিদ ছিলেন। গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন মাওলানা সোবহান ও তাঁর দুই ছেলেকে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানায় সোপর্দ করে। বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানা থেকে তাঁর ছোট ছেলে মুজাহিদসহ তাঁকে বহনকারী গাড়িসহ ছেড়ে দিলে তাঁরা ঢাকার দিকে চলে যান। মাওলানা সুবহান ও তাঁর চতুর্থ ছেলে নেসার আহম্মেদ নান্নুকে পরে বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থানা পুলিশের দুটি পিকআপ ভ্যানে করে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম পাড়ে পাবনা সদর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
পাবনায় জামায়াত-পুলিশ সংঘর্ষ : মাওলানা সুবহানকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে জামায়াত বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে পাবনা শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ করে। মিছিলটি দুপুর পৌনে ২টার দিকে শহরের দইবাজারে পেঁৗছালে পুলিশ তাতে বাধা দেয়। তখন জামায়াত-শিবিরকর্মীরা পুলিশের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করলে তা সংঘর্ষে রূপ নেয়।
সংঘর্ষের সময় টিভির পাবনা প্রতিনিধি এস এ আসাদ, দিগন্ত টিভির পাবনা প্রতিনিধি আবদুল মজিদ দুদু, দৈনিক সংগ্রামের পাবনা সংবাদদাতা এস এম আলাউদ্দিন, সদর থানার এসআই আনোয়ারুল ইসলাম, কনস্টেবল প্রণয় কুমার, কনস্টেবল রায়হানুল ইসলামসহ কমপক্ষে ১৫ জন আহত হন। আহতদের পাবনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পাবনা পুলিশ সুপার জাহাঙ্গীর হোসেন মাতুব্বর জানান, ২০০৩ সালের এপ্রিলে সদর উপজেলার চর তারাপুর ইউনিয়নের দাসপাড়া, চোকদারপাড়াসহ চারটি গ্রামে সংঘটিত অগ্নিকাণ্ড ও লুটপাট মামলার প্রধান আসামি হিসেবে মাওলানা আবদুস সুবহানকে গ্রেপ্তার করা হয়।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সদর থানার এসআই আবদুল বারী জানান, ২০০৩ সালের ওই ঘটনায় চরতারাপুর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য আবদুল কুদ্দুস বাদী হয়ে চলতি বছরের ৩ এপ্রিল একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ৩১ আসামির মধ্যে দুইজনকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অন্য ২৯ জনের মধ্যে ২৮ আসামি জামিনে ছিলেন। গতকাল ওই মামলার হাজিরার তারিখ ছিল। চলতি মাসের ১৮ তারিখে পুলিশ ওই মামলার অভিযোগপ্রত্র (চার্জশিট) দেয়।
সংঘর্ষের পর পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একরাম হোসেন নামের এক শিবিরকর্মীকে গ্রেপ্তার করে। বিকেল ৪টার দিকে বড়বাজারের জামায়াত অফিসে অভিযান চালিয়ে পুলিশ সাকিল, সৌরভসহ আরো সাত শিবিরকর্মীকে গ্রেপ্তার করে।

No comments

Powered by Blogger.