ফৌজদারি মামলা ও আইনশৃঙ্খলা by এ এম এম শওকত আলী

গত ১১ নভেম্বর এবং পরবর্তী সময়ে ফৌজদারি মামলা রুজু ও পরিচালনায় প্রচলিত নিয়মকানুন অমান্য করার অভিযোগের সংবাদ মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে। এর মর্মকথা হলো- বিদ্যমান নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করেই সন্ত্রাসরোধ আইনে মামলা রুজু করা হয় এবং এ কারণে অভিযুক্ত জামিনে মুক্তি পায়।
সন্ত্রাসরোধ আইনের বিধিতে মামলা রুজু করার আগে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বানুমতি গ্রহণ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আইনি বাধ্যবাধকতা সঠিকভাবে অনুসরণ করার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পুলিশ কর্তৃপক্ষকে আদেশ জারি করেছে। এ প্রসঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিমন্ত্রী আরো বলেছেন, এ বিষয়টি অবহেলা করার জন্য দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। তিনি আরেকটি উক্তিও করেন। সম্প্রতি জামায়াত-শিবিরের কর্মীবাহিনী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় রাজপথে বারবার ত্রাসের ঘটনা ঘটায়। সম্প্রতি জয়পুরহাটে এসব কর্মী হরতালের সময়ও কর্তব্যরত পুলিশকে আক্রমণ করে। প্রতিমন্ত্রীর মতে, এ ধরনের ঘটনা সন্ত্রাসের পর্যায়ে পড়ে। সন্ত্রাসরোধ আইন সাধারণত উগ্র ইসলামী দলের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করার জন্যই প্রয়োগ করা হয়। অন্যদিকে কারো সম্পত্তি ধ্বংস করা বা বেআইনি মিটিং-মিছিলে সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটানোর অপরাধও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারিক অধিক্ষেত্রভুক্ত। সন্ত্রাসরোধ আইন মূলত ইসলামী জঙ্গি দলের অপরাধ বিচারের জন্য প্রযোজ্য। এ দুই আইনের পার্থক্য নিশ্চয়ই রয়েছে। তবে এ বিষয়ে আইনবিদরাই ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে দেখা যায়, সন্ত্রাসরোধ আইন জামায়াত-শিবিরকর্মীদের বিরুদ্ধেও প্রয়োগ করা হবে। তবে জামায়াত এখনো নিষিদ্ধ দল নয়। বরং রাজনৈতিকভাবে স্বীকৃত এবং সক্রিয় দল। ১২ নভেম্বরের প্রকাশিত সংবাদের বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে পুলিশ কর্তৃপক্ষকে যথাযথ নিয়মকানুন অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছে, যা আগেই বলা হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উল্লিখিত আদেশ এ কথাই প্রমাণ করে, আমাদের তদন্ত ও বিচারব্যবস্থার নানা দুর্বলতা রয়েছে। যেকোনো ফৌজদারি মামলা তদন্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল পর্যন্ত সময়ে প্রধানত দুই সংস্থা জড়িত। এক. তদন্তকারী সংস্থা অর্থাৎ পুলিশ বা র‌্যাব। দুই. সরকারি মামলা আদালতে দাখিল করার প্রক্রিয়ায় মামলাভেদে সরকারি আইনজীবী। এ দুই সংস্থায় জড়িত ব্যক্তিরাই সুষ্ঠু মামলা রুজু করার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। তদন্তকারী সংস্থা গুরুত্বপূর্ণ মামলার অভিযোগপত্র দাখিলের আগে সরকারি আইনজীবী- যাঁদের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) বলা হয়, তাঁদের মতামতও গ্রহণ করে থাকে। এসব আইনজীবীর নিয়োগপ্রক্রিয়ায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও দায়রা জজ জড়িত। এসব প্রক্রিয়া Legal Remembrancer Manual-এ বর্ণিত। এ ম্যানুয়ালে বর্ণিত পদ্ধতি অনুযায়ী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সম্ভাব্য সরকারি আইনজীবী তালিকা প্রস্তুত করেন। এ তালিকা দায়রা জজের মতামত গ্রহণের জন্য পাঠানো হয়। দায়রা জজের মন্তব্য কোনো প্রার্থীর বিপক্ষে গেলে সাধারণত সংশ্লিষ্ট নাম চূড়ান্ত তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। পূর্ণাঙ্গ তালিকা আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়, অনুমোদনের জন্য। আইন মন্ত্রণালয়ের পক্ষে জেলার আইনজীবীদের যোগ্যতা ও দক্ষতা জানা সম্ভব নয়। এ জন্যই এ প্রথা ব্রিটিশ আমল থেকে চালু আছে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাধারণত সম্ভাব্য প্রার্থীর সার্বিক সুনাম, সততা ইত্যাদি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে প্রাথমিক তালিকা প্রস্তুত করেন। জেলার দায়রা জজের পক্ষে যোগ্য ও দক্ষ প্রার্থীর সম্পর্কে প্রত্যক্ষ তথ্য জানা সম্ভব। কারণ এ আদালতে আইনজীবীরা সব ধরনের মামলা পরিচালনা করেন। এ প্রক্রিয়াসহ আইন মন্ত্রণালয়ের চূড়ান্ত অনুমোদন পর্যন্ত লোকচক্ষুর আড়ালে কিছু প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি ঘটে থাকে। সাধারণত সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি অনেকাংশে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নয়। কারণ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে যে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় আনুগত্যভিত্তিক নিয়োগের প্রক্রিয়া। কাজেই জেলা পর্যায়ে সরকারি আইনজীবী নিয়োগের জন্য যোগ্যতা ও দক্ষতার মাপকাঠি আমলে নেওয়া হয় না। এ ছাড়া অতিশয় দক্ষ আইনজীবীরা এ পদে নিয়োগে আগ্রহী নন। কারণ যথাযোগ্য পারিশ্রমিকের অভাব।
সরকারি আইনজীবী পর্যায়ে সন্ত্রাসরোধ আইনের বা বিধির ধারা কেন লঙ্ঘিত হলো সে বিষয়টির প্রতিও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দৃষ্টি দিয়েছে। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, এর জন্য আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি পৃথক নির্দেশ জারির জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লিখিত অনুরোধ জানাবে। এটা কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা সহজেই অনুমান করা যায়। তবে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা এ বিষয়ে যত্নবান হবেন বলে আশা করা যায়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ উদ্যোগের বিশ্লেষণ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, উদ্যোগটি সাম্প্রতিক জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে। তবে এর সঙ্গে আরেকটি সংবাদও রয়েছে। তা হলো, সম্প্রতি নিষিদ্ধ হিযবুত তাহ্‌রীরের কিছু জঙ্গির জন্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চে জামিনের আবেদন করা হয়েছে। কারণ এ ক্ষেত্রে মামলা রুজুর জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের পূর্বানুমতি গ্রহণ করা হয়নি। কাজেই অভিযোগপত্রে কিছু আইনি শূন্যতা বিদ্যমান।
এর আগে মিডিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ মামলায় অভিযুক্তরা সহজে জামিন লাভ করে মর্মে পুলিশের কিছু কর্মকর্তা প্রকাশ্যে আক্ষেপ করেছেন। এমন ঘটনাও জানা গেছে, গুরুতর মামলার আসামিরা জামিনে মুক্ত হয়েই আবার একই অপরাধে লিপ্ত হয়েছে। এ কারণে হয়তো শান্তিপ্রিয় নাগরিকরাও ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি যে ত্রুটিপূর্ণ মামলা রুজু ও পরিচালনার জন্য হয়েছে, তা ততটা তলিয়ে দেখা হয়নি। এ দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখলে বলা যায়, সহজে জামিনে মুক্তি পাওয়ার বিষয়টির জন্য আদালতকে দায়ী করা সমীচীন নয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক সূত্রমতে, অনেক সময় ঘুষ আদান-প্রদানের বিনিময়েও মিথ্যা মামলা রুজু করা হয়। মিথ্যা মামলা সাজাতে গিয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা অনেক সময় ভিত্তিহীন এবং আইনসিদ্ধ নয় এমন তথ্য ব্যবহার করে থাকেন। এসব ক্ষেত্রে জামিন পাওয়ার বিষয়টি সহজ হওয়ারই কথা। তবে কিছু ক্ষেত্রে যে পুলিশ বা তদন্তকারী সংস্থা রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তারের ফলে মিথ্যা মামলা সাজাতে বাধ্য হয় এটাও হতে পারে। ২০০৯-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক প্রভাবদুষ্ট মামলা প্রত্যাহারের জন্য একটি কমিটি বহুসংখ্যক মামলা প্রত্যাহার করার সুপারিশ করে। এ বিষয়টি মিডিয়ায় সমালোচনার ঝড় তুলেছিল। ১৪ নভেম্বর প্রকাশিত একটি বাংলা দৈনিকে কয়েকটি গুরুতর মামলা প্রত্যাহারসহ দণ্ড মওকুফ বা হ্রাসের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেখা গেছে। এসব ঘটনা ২০০৯-পরবর্তী সময়ের। ঠিক পরের দিন একটি ইংরেজি দৈনিকে দয়ালু রাষ্ট্রপতি শিরোনামে যে তথ্য পরিবেশিত হয়েছে তা ছিল আরো আশঙ্কার কারণ। এ তথ্যে বলা হয়েছে, গত তিন বছরে ২১ জন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিকে বর্তমান রাষ্ট্রপতি দণ্ড মওকুফ করেছেন। অন্যদিকে ১৯৭২-পরবর্তী সময়ে মাত্র চারজন এ ধরনের দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ড মওকুফ করা হয়। তবে এ কথাও সত্য যে রাষ্ট্রপতি এককভাবে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন না। প্রচলিত রীতি অনুযায়ী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রস্তাব করে আইন মন্ত্রণালয়ে মতামতের জন্য নথি পাঠায়। আইন মন্ত্রণালয়ের কোনো আপত্তি না থাকলে প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশক্রমে রাষ্ট্রপতি প্রস্তাব অনুমোদন করে। পত্রিকান্তরে আরো জানা যায়, শিশু পরাগকে যারা অপহরণ করে, তাদের মধ্যে জামিনে মুক্তি পাওয়া আসামিও ছিল। এ ধরনের ঘটনার ইতি না হলে গুরুতর অপরাধীদের জন্য একটি অভয়ারণ্যের পরিবেশ সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কাই অধিকতর।
হিযবুত তাহ্‌রীরের জঙ্গিদের জামিনের মামলায় হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ঢাকার সংশ্লিষ্ট জজসহ পুলিশ কর্মকর্তাদের তলব করেছেন। অন্যদিকে এসব বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও সচেতন। আশা করা যায়, বিচার ও নির্বাহী বিভাগের এ যুগপৎ পদক্ষেপের ফলে সার্বিক অবস্থার কিছু উন্নতি হবে। এ ধরনের সমন্বিত পদক্ষেপ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য অত্যন্ত জরুরি। এর সঙ্গে প্রয়োজন তদন্তকারী সংস্থাসহ সরকারি আইনজীবীদের দক্ষতা বৃদ্ধি। বর্তমান সময়ে উগ্র ইসলামপন্থী বিচারাধীন জঙ্গিদের তদন্ত বিচার সম্পন্ন করা সরকারের একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবলীলা। এদেরও প্রকাশ্যে রাজপথে ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বিরত করা অন্য একটি চ্যালেঞ্জ। জামায়াতকে এখনো নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়নি। বর্তমানে এ নিয়ে অনেকেই এ দলকে নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছেন। তবে নিষিদ্ধ করার ব্যাপারেও হয়তো সাংবিধানিক বাধা রয়েছে। ১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে সংবিধানে কয়েকটি সংশোধনীই এখনো অক্ষুণ্ন রয়েছে। ১৯৯১-পরবর্তী সময়ে জামায়াত সংসদে সংখ্যালঘু আকারে হলেও প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম হয়েছে। এটা প্রমাণ করে, ভোটারদের কিছু অংশ এদের প্রতিনিধি করতে ইচ্ছুক। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজপথে আন্দোলনের জন্য জামায়াতের শক্তি। তবে সে শক্তি হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডে বিশ্বাসী। এ জন্যই ফৌজদারি মামলা। মামলা রুজু ও পরিচালনা যথাসম্ভব নিখুঁত হতে হবে। অন্যথায় এ শক্তি আরো বৃদ্ধি পাবে। সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনার উক্তিটিও প্রাসঙ্গিক। তাঁর মতে, নিজস্ব অভিমত ব্যক্ত করার অধিকার সবারই রয়েছে। কিন্তু এর জন্য শান্তি ভঙ্গ করলে তা গ্রহণযোগ্য নয়। অর্থাৎ এদের আইনের আওতায় আনতে হবে। সংবাদে দেখা যায়, ডিসেম্বর মাসে জামায়াত-শিবির পুনরায় শান্তি ভঙ্গের কারণ হবে। এ জন্য পূর্বাহ্নেই প্রস্তুতি প্রয়োজন।
নভেম্বর, ২০১২
লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা

No comments

Powered by Blogger.