উপজেলা মধ্যবর্তী স্তর, একে কার্যকর করতে সমন্বিত স্তরবিন্যাস জরুরি

এক. উপজেলা সৃষ্টি ও তা বজায় রাখার উদ্দেশ্য প্রয়োজনের নিরিখে বিবেচিত ও গৃহীত হয়নি বলে এটি কিছুতেই কার্যকর হবে না, হতে পারছে না। প্রায় ২৭ বছর আগে তৎকালীন সামরিক সরকার এর কাজ কী হবে, এর আয় কোথা থেকে আসবে, এটি গ্রামীণ, নগরীয়, না গ্রামীণ-নগরীয় হবে,
সম্পর্ক কার সঙ্গে কেমন হবে, স্তরগত অবস্থান কী হবে ইত্যাদি একদম বিবেচনায় না নিয়ে শুরুতে শুধু নতুন দল গঠনের সহায়ক শক্তি দাঁড় ও অবৈধ ক্ষমতা প্রলম্বিত করার উদ্দেশ্যে 'উপজেলা' চালু করে। বর্তমান সরকারও উপরিউক্ত বিষয়গুলো বিবেচনায় না নিয়ে অনির্বাচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সৃষ্ট অবস্থার চাপে পড়ে খণ্ডিত উপজেলা পরিষদ (একজন চেয়ারম্যান ও দুজন ভাইস চেয়ারম্যান) নির্বাচন শুধু মুখে মেনে নেয় বলে তা আধা মরা অবস্থায় ঝুলে আছে বলে মনে হয়। প্রায় চার বছর পার হওয়ার পরও প্রতিনিধি ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, অফিশিয়াল খরচ ও উন্নয়ন ব্যয়ের সামান্যতম অংশও এর নিজস্ব আয় থেকে নির্বাহ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে বর্তমানে অন্যান্য স্থানীয় ইউনিটের সামান্য পরিমাণ যে আয় রয়েছে তা কর্তন করে উপজেলার জন্য কিছু আয় সৃষ্টি করার পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে বলে জানা যায়; সে জন্য মৃতপ্রায় স্থানীয় ইউনিটগুলোর মধ্যে বিরোধ-কলহ সৃষ্টির স্পষ্ট লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। আমরা সিডিএলজির পক্ষ থেকে বারবার বলে আসছি, উপজেলা একটি মধ্যবর্তী স্তর, এটাকে কার্যকর করতে হলে সর্বাগ্রে স্থানীয় সরকারের একটি সমন্বিত স্তরবিন্যাস ঠিক ও গ্রহণ করতে হবে; তাতে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট (বিভাগ অথবা জেলা) এবং সর্বনিম্ন ইউনিটদ্বয়ের (নগর ও ইউনিয়ন) কাজ বাছাই ও নির্দিষ্ট করার পর বোঝা যাবে মধ্যবর্তী স্তরের (উপজেলা) কাজ কী হবে, অর্থ কোথায় থেকে আসবে, আর এর প্রয়োজনীয়তাই বা কতটুকু রয়েছে। তবে এসবের প্রতি সরকার আদৌ কর্ণপাত করছে বলে মনে হয় না, বরং একটার পর একটা অপ্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করে পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করে চলেছে।
দুই. পত্রিকা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা ও জেলা পরিষদের অধিকারে থাকা স্থানীয় স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর করের একটি অংশ উপজেলা পরিষদকে দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। যেসব উপজেলার ভেতর পৌরসভা রয়েছে সেগুলোর ক্ষেত্রে স্থানীয় সম্পত্তি হস্তান্তর কর হিসেবে আদায়কৃত অর্থ পৌরসভার দুই শতাংশের এক শতাংশ উপজেলাকে দেওয়া হবে। আর যেসব উপজেলার আয়তনের মধ্যে পৌরসভা নেই সেসব এলাকায় জেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের জন্য আদায়কৃত অর্থ সমান তিন ভাগে ভাগ করে উপজেলা পরিষদকে এক ভাগ দেওয়া হবে (ইত্তেফাক, ২ সেপ্টেম্বর ২০১২)। এতে কিছু উপজেলায় পৌরসভা ও উপজেলার মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হবে এবং কিছু উপজেলায় ইউনিয়ন ও জেলার সঙ্গে উপজেলার বিরোধ সৃষ্টি হবে। উপজেলা সৃষ্টির শুরুতে এর নিজস্ব আয় সৃষ্টিতে আটটি উৎস নির্দিষ্ট করা হয়; যেমন- জলমহাল ইজারা, হাটবাজার ইজারা, ফেরিঘাট ইজারা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বৃত্তির ওপর কর, প্রমোদ কর ইত্যাদি। লক্ষ করার বিষয়, উক্ত খাতগুলো কোনো না কোনো বেসিক স্থানীয় ইউনিটে (ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড) অবস্থিত। এগুলোর আয় থেকে কিছু অংশ উপজেলার জন্য দেওয়া হলে বেসিক ইউনিটগুলো আর্থিকভাবে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে পড়বে। তা ছাড়া তৎকালীন সরকারের আমলেও উপরিউক্ত খাতগুলো উপজেলা পরিষদের আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে জলমহাল ও হাটবাজার ইজারা দেওয়ার কর্তৃত্ব উপজেলা নির্বাহী কার্যালয়ের হাতে থাকলেও ব্যবসা-বাণিজ্যের সনদ (ট্রেড লাইসেন্স) দেওয়ার ক্ষমতা পৌরসভা ও ইউনিয়নগুলোর হাতে রয়েছে। জেলা প্রশাসন, ফেরিঘাট ইজারা ও প্রমোদ কর আদায়ের বিষয়টি তত্ত্বাবধান করে থাকে। তবে এসব আয়ের একটি অংশ উপজেলাকে দেওয়া হয়। অন্যদিকে ইউনিয়নের হাটবাজার ইজারা দেওয়ার ক্ষমতা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার হাতে ন্যস্ত থাকলেও পৌরসভার হাটবাজারগুলো ইজারা দেওয়ার ক্ষমতা পৌরসভার হাতে দেওয়া আছে। সিনেমা ব্যবসায় মন্দার কারণে বহু সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেছে। যাত্রা-নাটক-সার্কাসের অবস্থা একই। সে জন্য প্রমোদ কর নেই বললেই চলে। অর্থাৎ বর্তমান অবস্থায় উপজেলার নিজস্ব আয়ে প্রতিনিধি ও কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া তো দূরের কথা, কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ৪৫ লাখ টাকার জিপগাড়ির তেল খরচও বহন করা সম্ভব নয়। তাই প্রশ্ন এসে যায়, যে উপজেলার নিজস্ব আয়ে একটি বাইক কেনার সামর্থ্য নেই, প্রতিদিন চা-নাশতা খাবার, খাওয়ানোর পয়সা নেই; সেই উপজেলার চেয়ারম্যানকে ৪৫ লাখ টাকার গাড়ি দেওয়ার রহস্যটা কী? প্রসঙ্গত, মনে প্রশ্ন জাগে, কাজ ও দায়িত্ব ছাড়া জেলা পরিষদের নামে নিযুক্ত প্রশাসকরা শুধু গাড়ি, বাড়ি, পদমর্যাদা, বেতন-ভাতা ও রাজকীয় সুযোগ-সুবিধা ভোগের রহস্যটা কী?
তিন. মজার বিষয় হলো, উপজেলা পরিষদ নিজস্ব আয়ের উৎস ও সামর্থ্য এবং দায়িত্ব সম্পর্কে একদম নীরব থেকে মাঝেমধ্যে স্বশাসনের দাবি করে থাকে। কিন্তু স্বশাসনের সঙ্গে আর্থিক স্বাবলম্বিতার বিষয়টি যে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, এটি তারা বোঝে কি না, প্রশ্ন করা যেতে পারে। আর কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তাদের উপজেলা চেয়ারম্যানের অধীনে করার আন্দোলনের সঙ্গে স্বশাসনের সম্পর্কই বা কোথায়? বাংলাদেশে গাড়ি, সুসজ্জিত অফিস ও পদ-পদবি এখনো আভিজাত্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে, প্রয়োজনের নিরিখে এগুলোর ব্যবহার ও গুরুত্ব এখনো গৌণ বিষয়। বিদ্যমান এই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে স্থানীয় সরকারের স্বশাসন অর্জন আর আভিজাত্যের প্রতীক প্রাপ্তিকে গুলিয়ে ফেলা উচিত হবে কি? আর গ্রামীণ তৃণমূলে ইউনিয়নকে স্থানীয় সরকারের অন্যতম সর্বনিম্ন ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হয়নি; বরং এটিকে নানা উপায়ে ক্ষতিগ্রস্ত করার চেষ্টাই করা হয়েছে। ইউনিয়নের নিচে 'স্বনির্ভর গ্রাম সরকার', 'পল্লী পরিষদ', 'গ্রাম সভা', 'গ্রাম পরিষদ' ও 'গ্রাম সরকার' এবং ওপরে 'উপজেলা' ইত্যাদি করার নামে ইউনিয়নকে একদম দুর্বল থেকে দুর্বলতম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হয়েছে। ফলে প্রায় ১৪০ বছরের এই পুরনো ইউনিটটি এর নিজস্ব আয়ে একজন মাত্র কর্মচারীর (ইউপি সচিব) বেতন দেওয়ার সামর্থ্য অর্জন করেনি, করতে পারছে না। প্রশ্ন হচ্ছে, এর বালকত্ব থেকে সাবালকত্ব অর্জনে আর কত বছর দরকার হবে?
চার. উপরিউক্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার আন্দোলনের পথিকৃৎ আবু তালেব প্রণীত 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা' নামক গবেষণা গ্রন্থে চমৎকার ব্যাখ্যা আছে (তিনি চার বছর আগে উপজেলাকে কার্যকর করার জন্য ২৫ দফা দাবিও পেশ করেছিলেন)। ওই গবেষণা গ্রন্থে উল্লেখ আছে- বাংলাদেশে স্থানীয় সরকার কার্যকর করতে হলে প্রথমত দুই প্রকারের সরকার ব্যবস্থা তথা কেন্দ্রীয় সরকার ব্যবস্থা ও স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা আন্তরিকভাবে মেনে নিতে হবে। কেন্দ্রের পরে স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ইউনিট হিসেবে বিভাগ কিংবা জেলাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ ও কার্যকর করতে হবে; আর গ্রামীণ এলাকায় ইউনিয়ন ও নগরীয় এলাকায় নগরকে স্থানীয় সরকারের সর্বনিম্ন ইউনিট হিসেবে স্থাপিত ও কার্যকর করতে হবে। এখানে নগর বলতে বিদ্যমান সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডকে বোঝানো হয়েছে। স্থানীয় সরকারের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন স্তর নির্ধারণ এবং এগুলোর কাজ ও ক্ষমতা নির্দিষ্ট করার পর জানা যাবে মধ্যবর্তী স্তর যেমন উপজেলার কাজ ও ক্ষমতা কী হবে, অর্থ কোথায় থেকে আসবে, আর এর প্রয়োজনীয়তাই বা কতটুকু রয়েছে।
পাঁচ. যেকোনো সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন, যে কাজটি একজন ব্যক্তি কিংবা একটি ইউনিট করতে পারলে তা করার জন্য একাধিক কর্মকর্তা বা কর্মচারী নিযুক্ত করা কিংবা একাধিক ইউনিট রাখা যুক্তিসিদ্ধ কাজ নয়; এবং অর্পিত দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে, যথাযথভাবে সম্পন্ন করার স্বার্থে গ্রামীণ ও নগরীয় কাজগুলো করার জন্য আলাদাভাবে একক কর্তৃপক্ষের অধীনে ন্যস্ত না করাও যুক্তিযুক্ত কাজ নয়। পৌরসভা এলাকায় উপজেলা চেয়ারম্যানের কোনো কাজ ও ক্ষমতা নেই বলে প্রতীয়মান, কিন্তু পৌরবাসীর ভোটেও উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। উপজেলা চেয়ারম্যানকে পৌরসভা এলাকায় কাজ ও ক্ষমতা দিলে তাঁর পদমর্যাদা ও ভাতা পৌরসভার মেয়রের চেয়ে বেশি করতে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় এটি করা কি সম্ভব হবে? যদি দিতে হয় তাহলে কাজ ও ক্ষমতাই বা কী হবে? এসব বিষয় বিবেচনায় না নিয়ে যাঁরা উপজেলা ও উপজেলা আইন করেছেন, তার জন্য অহেতুক কৃতিত্ব দাবি করছেন, এসব করতে গিয়ে দেশের কোটি কোটি টাকা অপচয় করেছেন, তাঁদের জন্য শুধুই করুণা হয়! এ ধরনের খুবই ক্ষতিকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে এখনই উচিত হবে 'গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকারের রূপরেখা'য় প্রস্তাবিত স্তরবিন্যাস দুটির যেকোনো একটি গ্রহণ করা এবং প্রতিটি ইউনিটে সরকার কাঠামো যেমন- ইউনিয়ন সরকার, নগর সরকার ইত্যাদি প্রতিস্থাপন করে সেগুলো পরিচালনার ভার সত্যিকার অর্থে স্থানীয় প্রতিনিধিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। তাহলে পৌরসভা তথা নগরীয় ইউনিট উপজেলার সীমানা থেকে স্বাভাবিকভাবেই বাদ পড়ে যাবে; তৃণমূলে একই সঙ্গে গ্রামবাসী ও নগরবাসীর গণতান্ত্রিক ক্ষমতায়ন, স্বশাসন অবশ্যই প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।
লেখকবৃন্দ : চেয়ারম্যান, জানিপপ; রাষ্ট্রবিজ্ঞান, বিসিএস শিক্ষা
এবং সদস্য, সিডিএলজি
janipop1995@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.