ইসরায়েল যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন পেয়েছে তবে পার্থক্য রয়েছে by পিটার অ্যাপস

গত সপ্তাহে গাজা সংঘাত চরম আকার ধারণ করার পর ইসরায়েলের কর্মকর্তা ও সমর্থকরা কূটনৈতিক মাধ্যমে ও গণমাধ্যমে অভিযান চালিয়ে এ কথা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি ইসরায়েলের পেছনে বরাবরের মতোই রয়েছে।
ওয়াশিংটনে নিযুক্ত ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূত মাইকেল ওরেনকে নিয়মিত এখন কেবল নেটওয়ার্ক ও টক শোতে দেখা যাচ্ছে। আমেরিকান-ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির মতো প্রো-ইসরায়েলি লবিগুলো এবং ইসরায়েল প্রজেক্ট নামক সংগঠন হামাসের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের ছবি আর সীমান্ত এলাকার সাধারণ ইসরায়েলিদের সাক্ষাৎকারের ফুটেজ ই-মেইলের মাধ্যমে পাঠিয়ে সাংবাদিকদের জর্জরিত করে ফেলেছে। ইরানকে মোকাবিলা করার ব্যাপারে জনগণের মধ্যে বিরোধিতা বৃদ্ধি পাওয়ার এক বছর পর এই সময়ে ওবামা প্রশাসন ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সরকারের মধ্যে সম্পর্কে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে মন্দ অবস্থা চলছে। কিন্তু ইসরায়েলের সমর্থক ও স্বতন্ত্র বিশ্লেষক- উভয় পক্ষই একটি কথা বলছে যে ইসরায়েলের প্রয়োজনের সময় যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল সম্পর্ক কত গভীর এবং ইসরায়েলের সমর্থকদের প্রভাব কত বেশি সেটা গত সপ্তাহেই যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের মাত্রা দেখে বোঝা গেছে।
খুব অল্পসংখ্যক লোকই মনে করে, আগামী দিনে যখন ইরান ইস্যুটি সামনে আসবে, তখন এর কোনো ব্যত্যয় ঘটবে। কিন্তু এ মুহূর্তে ইসরায়েলের কর্মকর্তারা এবং সমর্থকরা শুধু একটি কথাই বলে যাচ্ছেন যে গাজা সংকটে আমেরিকার কাছ থেকে যে ধরনের সমর্থন পাওয়া গেছে, তাতে তারা সন্তুষ্ট। ওয়াশিংটনভিত্তিক ইসরায়েল প্রজেক্ট হলো একটি গ্রুপ, যারা ইসরায়েলের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চাপ প্রয়োগ করে থাকে। এর প্রধান নির্বাহী জোস ব্লক বলেছেন, 'আমরা মনে করি, যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটি ভালো সাড়াই পাওয়া গেছে। এই বিশেষ সম্পর্ক কতটা দীর্ঘ, তারই একটি স্বাক্ষর এটা। দুই নেতার ব্যক্তিগত সমঝোতার চেয়ে এটা অনেক বড় কিছু।'
ব্যাপকভাবে ধারণা রয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামার প্রতি অনীহা এবং মিট রমনির প্রতি সমর্থন দেওয়ার পর এখন নেতানিয়াহু আবার ওবামার সঙ্গে সম্পর্ক ঝালাই করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন বা চেষ্টা করছেন। গত বৃহস্পতিবার তিনি ওবামার প্রশংসা করেছেন ইসরায়েলকে দ্বিধাহীন সমর্থন প্রদান করার জন্য। গত সপ্তাহে সিএনএন এবং ওআরসির এক জরিপে দেখা গেছে, ৫৭ শতাংশ আমেরিকান মনে করে, ইসরায়েলের সেনা পদক্ষেপ ছিল সঠিক। আর ২৫ শতাংশ এর বিরোধিতা করেছে।
তবে গাজার বিষয়টিই হলো একমাত্র ইস্যু, যে ব্যাপারে দুই দেশ সহমত পোষণ করে। কিন্তু ইরান ইস্যুর বাইরে বিশেষ করে অনেক ডেমোক্র্যাট এবং মোট জনসংখ্যার প্রায় দুই শতাংশ ইহুদি কমিউনিটির অনেকে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের বসতি স্থাপন নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করেছে। তারা রক্ষণশীল চিন্তা ও চরমপন্থী দলগুলোর প্রভাব বেড়ে যাওয়া নিয়েও হতাশা ব্যক্ত করেছে। ওবামা প্রশাসনের সাবেক রাজনৈতিক নিয়োগপ্রাপ্ত এবং বর্তমানে ট্রুম্যান ন্যাশনাল প্রজেক্টের ফেলো এরিয়েল রাটনার বলেছেন, 'অবশ্যই যুদ্ধের সময় সবাই না হলেও আমেরিকান সমাজের একটি বড় অংশ ইসরায়েলের পক্ষে থাকবে। কিন্তু ভবিষ্যতে ইসরায়েল যদি তাদের মত সঠিকভাবে আমলে না নেয়, তাহলে বড় ধরনের সমস্যাগুলো আবির্ভূত হবে।' ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে পশ্চিম তীর। তারা ২০০৭ সালে হামাসের কাছে পরাজিত হয়ে গাজার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। এই কর্তৃপক্ষের জাতিসংঘে নিযুক্ত মিশনের একজন মুখপাত্র যুক্তরাষ্ট্রের প্রচারমাধ্যমে যুদ্ধের সংবাদ প্রচার অথবা ইসরায়েল-ওয়াশিংটন সম্পর্ক নিয়ে মন্তব্য করতে অস্বীকার করেছেন। কিন্তু তিনি বলেছেন, ফিলিস্তিনিরা মনে করে, জাতিসংঘে তাদের যে জাতি হিসেবে স্বীকৃতির প্রস্তাব রয়েছে, তাকে ইসরায়েল উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ধ্বংস করার পদক্ষেপ নিয়েছে। নিজের পরিচয় গোপন রেখে তিনি বলেছেন, আমরা বিশ্বাস করি, ইসরায়েলিরা আমাদের জাতিসংঘের এ স্বীকৃতি পাওয়া বন্ধ করতে সব ধরনের চেষ্টা করবে।'
ইসরায়েলকে বিরত থাকতে বলার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র খুই গুরুত্বপূর্ণ। ইসরায়েলি কর্মকর্তারা বলেছেন, এবারের সংঘাতের শুরুতে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা নেতানিয়াহুকে ফোন করেছিলেন। তিনি ফোনে বলেছেন, ২০০৮-০৯ সালের যুদ্ধের মতো যুক্তরাষ্ট্র এবার স্থলভাগে হামলা করে প্রবেশ করা দেখতে চায় না। হয়তো সে কারণেই সে সময়ের মতো হতাহতের সংখ্যা তীব্র আকার ধারণ করেনি এবং যুদ্ধের মাত্রা তীব্র হয়নি। সে সময়ে গোটা গাজায় এক হাজারের বেশি লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। ইসরায়েলের কর্মকর্তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিজেও স্থল হামলা এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন।
সাম্প্রতিক সংঘাতে ছয়জন ইসরায়েলি নাগরিক ও দুজন সেনা নিহত হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের হতাহতের সংখ্যা এর অনেক গুণ। স্থানীয় কর্মকর্তাদের হিসাব অনুযায়ী ১৬৩ জন। হামাসের তুলনায় ইসরায়েল অনেক ভারী গোলাবারুদ ব্যবহার করেছে। ইসরায়েল বলেছে, তারা অনেক নির্ভুলভাবে অস্ত্র ও বোমা ব্যবহার করেছে, যাতে ব্যাপক সাধারণ জানমালের ধ্বংস এড়িয়ে যাওয়া গেছে। কিন্তু হামাস চেষ্টা করেছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় অস্ত্র নিক্ষেপ করতে।
সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় থেকে শুরু করে টুইটার, ফেসবুক- সর্বত্র ইসরায়েলের সমর্থকরা বলছে, তারা অনেক ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম। ইসরায়েলের প্রজেক্ট ব্লক বলেছে, জনগণের তথ্য পাওয়ার সুযোগ ও ধরন অনেক পাল্টে গেছে। এখন আর চিরাচরিত প্রচারমাধ্যমগুলো একচ্ছত্র নেই। এটি একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখুন, ইসরায়েলের কর্মকর্তারা তাঁদের বিষয়গুলো একই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়া ও চিরাচরিত মিডিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে এসেছেন।

লেখক : রয়টার্সের রাজনৈতিক করেসপনডেন্ট। ভাষান্তর করেছেন মহসীন হাবিব

No comments

Powered by Blogger.