আমাদের মুজিবনগর by ফারুক হোসেন

আজ ১৭ এপ্রিল। ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার মেহেরপুর জেলার তৎকালীন বৈদ্যনাথতলা বর্তমান মুজিবনগর আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে। শপথ অনুষ্ঠানের জন্য বৈদ্যনাথতলাকে বেছে নেওয়ার যথাযথ কারণও ছিল।
মেহেরপুর সদর থেকে বেশ দূরে বৈদ্যনাথতলার অবস্থান। এখান থেকে যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল খারাপ। সড়কপথে হানাদার বাহিনী আক্রমণ করতে চাইলে সময় লাগবে এবং তাদের প্রতিরোধ করা সহজ হবে। বৈদ্যনাথতলা ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে দূরত্ব মাত্র ১০০ গজের মতো।
স্বাধীনতার সূতিকাগার_ এই ঐতিহাসিক স্থানটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৭৪ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর স্মৃতি মিউজিয়ামের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তদানীন্তন শিল্পমন্ত্রী সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং একই দিনে বঙ্গবন্ধু তোরণের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী। এরপর স্থানটিতে দীর্ঘদিন কোনো উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি। ১৯৮৭ সালে এরশাদ সরকার সেখানে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ এবং রেস্ট হাউস নির্মাণ করেন। সেই সময় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৩ স্তম্ভবিশিষ্ট একটি স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। ৩৯.৩৭ একর জমির ওপর প্রায় ১৩শ' বৃক্ষশোভিত আম্রকাননের নিরিবিলি সবুজ শান্ত পরিবেশে এক গর্বিত অহঙ্কার নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে স্মৃতিসৌধটি। ২৩টি কংক্রিটের ত্রিকোণ দেয়ালের সমন্বয়ে উদীয়মান সূর্যের প্রতিকৃতিকে পটভূমি করে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধটি নির্মিত হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় বৈদ্যনাথতলার সেই আম্রকাননকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মুজিবনগর কমপ্লেক্স। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই ২৩টি বছর পাকিস্তানিদের নিপীড়ন, শোষণ আর নির্যাতনের প্রতীক এই ২৩টি স্তম্ভ, পাশাপাশি বীর বাঙালির ক্রমবর্ধমান প্রতিরোধের প্রতীক এই ২৩টি দেয়াল। ২ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার বেদিটিতে অসংখ্য গোলাকার বৃত্ত দ্বারা স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের স্মৃতিচিহ প্রতিফলিত করা হয়েছে। ৩ ফুট উচ্চতার অপর বেদিটির অসংখ্য নুড়িপাথর মুক্তিযুদ্ধকালীন সাড়ে সাত কোটি ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী জনতার প্রতীক। যেখানে প্রথম বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার শপথ গ্রহণ করেছিল, স্মৃতিসৌধের বেদিতে সেই স্থানকে লাল সিরামিক ইট দিয়ে আয়তকার রণক্ষেত্র চিহিত করা হয়েছে। আরেকটি আকর্ষণ বাংলাদেশের মানচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টরে মানচিত্রটিকে ভাগ করা হয়েছে। বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান অনুযায়ী মানচিত্রের উত্তর দিকটা উঁচু থেকে ক্রমান্বয়ে দক্ষিণ দিকটা ঢালু করা হয়েছে এবং সমুদ্র-তীরবর্তী অঞ্চলকে চিহিত করে পানির ওপর ভাসমান দেখানো হয়েছে। মানচিত্রের বাইরে উত্তর দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, জাতীয় ৪ নেতা, গার্ড অব অনারকারী ১২ আনসার সদস্যসহ ৪০০টি মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য নির্মাণ করা হয়েছে।
বিশাল আমবাগানের ছায়াতলে আত্মপ্রকাশের পর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সেখানে আবেগপ্রবণ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন, পলাশীর আম্রকাননে ১৭৫৭ সালে বাংলাদেশের যে স্বাধীনতার সূর্য অস্ত গিয়েছিল আজ তার নিকটবর্তী আরেক আম্রকাননে সেই স্বাধীনতার সূর্য পুনরায় উদিত হলো। বাংলাদেশের মুজিবনগর মুক্তাঙ্গনে শতাধিক দেশি-বিদেশি সাংবাদিক, প্রেস ফটোগ্রাফার, বেতার ও টিভি প্রতিনিধিদের সামনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ ও প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণের ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তৎকালীন মেহেরপুর মহকুমার এসডিও (বর্তমান সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা) ছিলেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী। তাকে জানানো হয়, ১৭ এপ্রিল ভবেরপাড়ার জমিদার বৈদ্যনাথের আমবাগানে একটি উচ্চ পর্যায়ের সভা অনুষ্ঠিত হবে। সেই অনুযায়ী মঞ্চসজ্জাসহ সার্বিক ব্যবস্থা করলেন তিনি। নেতৃবৃন্দের জন্য আশপাশের গ্রাম থেকে চেয়ার-টেবিল আনা হলো। চেয়ারগুলো ছিল হাতলবিহীন। বর্তমানে এগুলো ঢাকা মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত। সকাল ৮টার দিকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্র্নেল মোহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী, পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান এবং অর্থমন্ত্রী ক্যাপ্টেন মনসুর আলীসহ নেতৃবৃন্দ মুজিবনগর পেঁৗছলেন। আমবাগানের মাঝামাঝি পশ্চিমপ্রান্তে বর্তমানে যেখানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে, ঠিক তার মাঝখানে সভামঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। যে ভিতের ওপর সেদিন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়েছিল ঠিক সেখানে একটি স্তম্ভ তৈরি করা হয়। আর ওই স্তম্ভকে স্মৃতিসৌধের মাঝখানে রেখে বর্তমান স্মৃতিসৌধটি নির্মাণ করা হয়েছে। প্রথমে সাদা টুপি, চেক লুঙ্গি ও সাদা শার্ট পরে স্থানীয় যুবক বর্তমানে মুজিবনগর ডিগ্রি কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক বাকের আলী পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে তেলাওয়াত করে সভার শুভ উদ্বোধন করেন। নতুন রাষ্ট্র সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশন করলেন প্রয়াত প্রভাষক আসাদুল ইসলামসহ স্থানীয় মিশনারির শিল্পীবৃন্দ। জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও নবগঠিত স্থানীয় ১২ জন আনসার বাহিনীর একটি দল কর্তৃক গার্ড অব অনার গ্রহণের পর নেতৃবৃন্দ আসন গ্রহণ করেন। নেতৃবৃন্দের সবার পরনে ছিল সাদা পায়জামা ও পাঞ্জাবি। ব্যতিক্রম ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ। তার পরনে ছিল গাঢ় রঙের লম্বা কোট-প্যান্ট এবং টুপি। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাবেক মন্ত্রী আবদুল মান্নান এমএনএ। অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন ও শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হলেন শেখ মুজিবুর রহমান, তবে তার অনুপস্থিতিতে উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একটি বিবৃতি পাঠ করেন এবং বৈদ্যনাথতলার নাম রাখেন মুজিবনগর। তিনি উলেল্গখ করেন, ইয়াহিয়া খান গণহত্যা চালিয়ে নিজেই পাকিস্তানের কবর খুঁড়েছেন। বাংলাদেশের নতুন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। তিনি বলেন, নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশ বিশ্বসভায় স্থান করে নেবেই।

No comments

Powered by Blogger.