বিতর্কিত রায়ের নির্বাচনে যাব না : খালেদা

রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আদালতের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায় প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, এ রায় পক্ষপাতদুষ্ট, বাতিলযোগ্য, অগ্রহণযোগ্য ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এ রায়ের ভিত্তিতে আয়োজিত কোনো নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেবে না।
সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের চার দিন পর গতকাল বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে দলীয় অবস্থান তুলে ধরেন সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা। অবসরে চলে যাওয়া প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক রায়ে সই করাতেও রায়টি অগ্রহণযোগ্য বলেছেন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, 'অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর কোনো বিচারপতির শপথ থাকে না, তাই অবসরে যাওয়ার পর রায় লিখতেও পারেন না, শুনানি কিংবা সইও করতে পারেন না। কিন্তু এ বি এম খায়রুল হক সেই কাজটি করেছেন।'
বিএনপির চেয়ারপারসন বলেন, 'প্রধান বিচারপতি থাকাকালে তিনি (খায়রুল হক) প্রকাশ্য আদালতে যে সংক্ষিপ্ত ও বিভক্ত রায় ঘোষণা করেছিলেন, তার সঙ্গে অবসরে যাওয়ার ১৬ মাস পর কয়েক দিন আগে প্রকাশিত রায়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য অভূতপূর্ব এবং বিচারিক অসদাচরণ।'
প্রসঙ্গত, ত্রয়োদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে গত বছর রায় দেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। ওই রায়ের ভিত্তিতে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলোপের এক বছরের বেশি সময় পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর ৩৪২ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
খালেদা জিয়া বলেন, ১০ মে ২০১১ তারিখে যখন সংক্ষিপ্ত রায় ঘোষণা করা হয়, তখন জাতীয় সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান ছিল। বর্তমানে সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীতে সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার ৯০ দিন আগে থেকেই নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরু করার বিধান রেখেছে। তিনি বলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মূল কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, অনির্বাচিত ব্যক্তিদের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালিত হতে পারে না। অথচ ঘোষিত পূর্ণাঙ্গ রায়ে প্রস্তাব করা হয়েছে, ক্ষমতাসীন সরকারই সংক্ষিপ্তাকারে নতুন নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ করা পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবে। যদিও রায়ের অন্য অংশে নির্বাচনের ৪২ দিন আগে সংসদ ভেঙে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। এই বিধান সরকারের ইচ্ছার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে করা হয়েছে। সংসদ বহাল না থাকলে কেউই নির্বাচিত থাকেন না। তা হলে ওই ৪২ দিন অর্থাৎ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলাকালে, নির্বাচনের সময় এবং নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করা পর্যন্ত অনির্বাচিত ব্যক্তিরা রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকবেন কোন যুক্তিতে? এটি বিচারপতি খায়রুল হকের রায়ের স্ববিরোধিতার অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে একটি। তিনি বলেন, ক্ষমতাসীন সরকারের ইচ্ছে পূরণের জন্যই যে এসব পরস্পরবিরোধী প্রস্তাব করা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বিচারের নামে দলীয়করণের এমন নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোনো আদালতে খুঁজে পাওয়া যাবে না।
খালেদা জিয়া আরো বলেন, সংবিধান পরিবর্তনের বিষয়টি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল না। সুশীল সমাজের প্রতিনিধি এমনকি বিচারপতিরাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে অভিমত দিয়েছেন। এই রায়ে অবৈধ ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের সরকারকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে, যা রাজনীতিকরণ রায়ের আরেকটি দৃষ্টান্ত।
রাষ্ট্রপতি চাইলে নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিতে পারেন জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় বিরোধী দলের নেতা বলেন, 'জনগণকে বিভ্রান্ত করার এটি প্রধানমন্ত্রীর আরেকটি অপচেষ্টা মাত্র। প্রকৃতপক্ষে তিনি সাজানো নির্বাচনের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় যাওয়ার পাঁয়তারা করছেন।'
খালেদা জিয়া বলেন, এ রায়ের কারণে দেশে অনভিপ্রেত অস্থিরতা সৃষ্টি হবে এবং রাজনৈতিক সংকট আরো বৃদ্ধি পাবে। এ সরকার একটি সাজানো নির্বাচনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পাঁয়তারা করছে। তিনি বলেন, 'আমরা ঘোষণা করছি, সাবেক প্রধান বিচারপতির এ রায় নৈতিকতাবিরোধী ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। জনগণ এ রায় কখনো গ্রহণ করবে না।'
জনগণ আন্দোলনের মাধ্যমে নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেওয়ার দাবি আদায় করে ছাড়বে_এ প্রত্যয় ব্যক্ত করে খালেদা জিয়া বলেন, জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার জন্য নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের গণতন্ত্রকামী জনগণ কোনো অবস্থাতেই দলীয় সরকারের অধীনে সাজানো নির্বাচন মেনে নেবে না।
গুলশানে নিজের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পড়ার পর সাংবাদিকদের কয়েকটি প্রশ্নেরও উত্তর দেন বিএনপির চেয়ারপারসন। সরকার আগাম নির্বাচন দিতে পারে_এমন আলোচনা প্রসঙ্গে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে ছাড়া দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দেশের মানুষ প্রতিহত করবে।
বড় দুই দলের বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে দেশে আবার 'ওয়ান-ইলেভেনের' আর্বিভাব ঘটতে পারে কি না প্রশ্নের জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, 'আমরা চাই দেশে একটি সুষ্ঠু অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হোক। নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি আওয়ামী লীগই করেছিল। তাই আমি বলব, নির্দলীয় সরকার পদ্ধতি পুনর্বহালের জন্য সরকার সংসদে বিল এনে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে আইন পাস করুক। সরকার যদি সংবিধান সংশোধনের বিল পাস না করে তাহলে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হবে।' তিনি বলেন, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতির উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায়ের কারণে চলমান আন্দোলন কেউ দুর্বল করতে পারবে না।
বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে এই পূর্ণাঙ্গ রায়ের ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রাখবে কি না জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বিচারপতি টি এইচ খান বলেন, বর্তমান জজ ও অবসরপ্রাপ্ত জজ কখনো এক হতে পারেন না। বর্তমান জজের শপথ আছে। কিন্তু অবসরপ্রাপ্ত জজের কোনো শপথ ছিল না। তাই ১৬ মাস পরে হোক আর ১৬ দিন পরেই হোক, অবসরে যাওয়া বিচারপতি রায় দেওয়ার কোনো ক্ষমতা রাখেন না।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আর এ গনি, ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, এম কে আনোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, সহসভাপতি সাবেক বিচারপতি টি এইচ খান, শমসের মবিন চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসনের প্রেসসচিব মারুফ কামাল খান সোহেল, সংসদ সদস্য শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, আবুল খায়ের ভূঁইয়া প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.