বিশেষ সাক্ষাৎকার : ড. শাহদীন মালিক-সংসদ ভেঙে দিয়েই নির্বাচন করতে হবে

পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। বিরোধীদলীয় জোট এখন বাতিল হয়ে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবিতে আন্দোলন করছে। অন্যদিকে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আদালতের লিখিত রায় প্রকাশের পর তা প্রত্যাখ্যান করেছে বিরোধী দল।
এ অবস্থায় আগামী নির্বাচন ও আগামী দিনের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কালের কণ্ঠের মুখোমুখি হয়েছিলেন বিশিষ্ট আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মহসীন হাবিব   
কালের কণ্ঠ : তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয়েছে। এখন আপিল বা অন্য কোনো আইনি আবেদনের সুযোগ আছে?
শাহদীন মালিক : আপিল বিভাগের রায় হলো শেষ কথা। এরপর আর কিছু হয় না। বিচার-প্রক্রিয়ার সর্বশেষ কথা হলো আপিল বিভাগের রায়। সাংঘাতিক ব্যতিক্রমধর্মী ক্ষেত্রে রিভিউ হয়। কিন্তু সেটা এতই ব্যতিক্রমধর্মী যে মাত্র দুটি কারণে রিভিউ হয়। সে দুটি কারণ এখানে প্রযোজ্য নয়। অতএব এখানে রিভিউর প্রশ্ন নেই। তার পরের কথা হলো পুনর্বিবেচনা। এখন কথা হলো, বিচারকরা একটা রায় দিয়েছেন। রায় দিয়ে বলেছেন যে এটা বেআইনি বা আপনি দোষী। কিন্তু আপনি তাদেরই কাছে আবেদন করছেন যে আপনি আগে যা বলেছেন ভুল বলেছেন, আসলে এ লোকটি নির্দোষ। তখন আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি কি নিজেরাই বলবেন যে আমরা আগে যা বলেছিলাম ভুল বলেছিলাম। এটা কখনো হয় না। এর পরও যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় যা-ই হোক, সংসদ তো পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে দিয়েছে। অতএব ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় ছিল, সেই রায়ের ওপর ভিত্তি করে সংসদ ত্রয়োদশ সংশোধনী সংবিধান থেকে তুলে দিয়েছে। অতএব রায়ের সঙ্গে এখন আর এটার সম্পর্ক নেই।
কালের কণ্ঠ : বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক বলেছিলেন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কথা। কিন্তু ১৬ মাস পর চূড়ান্ত আদেশ যখন দিলেন তখন বললেন, কেবল নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠন করা যেতে পারে। এতে কী তিনি তাঁর রায়ের মূল জায়গা থেকে সরে গেলেন?
শাহদীন মালিক : না। এটাও আমার দৃষ্টিতে একটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হয়েছে। ১৬ মাস আগে ১০ মে তিনি যা বলেছেন সেখানে বলেছিলেন, ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল, এটা অসাংবিধানিক। তিনি সেখানে বলেছিলেন, দেশের, জাতির প্রয়োজনে সংসদ যদি মনে করে, তাহলে আরো দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে করতে পারবে। এটা আমার দৃষ্টিতে একটা উদ্বৃত্ত কথা। সংসদ আলোচনা করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। দুটি কেন, সংসদ সংবিধান সংশোধন করে বলতে পারে, আরো ৫০টা নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। সংসদ কী নিয়ে আলোচনা করে, কী সিদ্ধান্তে আসবে সেটা বিচার বিভাগের রায়ে বলার কথা নয়। বিচারপতি যেটা বলেছিলেন এটা তাঁদের একটা অবজারভেশন। একটা মতামত। রায় বলতে আমরা যেটা বুঝি, রায় হলো একটা আদেশ। ধরুন, যেকোনো ব্যাপারে রায়ে বলা হতে পারে- এই ব্যাপারে অমুক নির্দোষ অথবা দোষী অথবা এই জমি অমুকের, ওখানেই শেষ হয়ে যায়। তারপর কিছু পর্যালোচনা থাকে, তার কোনো আইনগত মূল্য নেই। বিশেষ করে বর্তমান এই ইস্যুতে, পার্লামেন্ট কী করবে না করবে, দুটি রাখবে না ১০টি রাখবে অথবা একটি নির্বাচনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে না- এটা সম্পূর্ণ সংসদের ব্যাপার।
কালের কণ্ঠ : একটি কথা শোনা যাচ্ছে অনেকে বলছেন। যদি সংসদ ভেঙে দেওয়া হয়, তাহলে তো আর নির্বাচিত প্রতিনিধি থাকেন না। তাহলে সে সংসদ কী করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে থাকবে?
শাহদীন মালিক : সংসদ তো ভেঙে দিয়েই নির্বাচন করতে হবে। সারা দুনিয়ার প্রথা হলো, যদিও নির্বাচিত প্রতিনিধি তাঁরা থাকবেন না, কিন্তু ধরে নেওয়া হবে যে তাঁরা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে কন্টিনিউ করবেন। যেটা আবার অনেকে বুঝতে ভুল করছেন, আইনে অনেক কিছু থাকে। সংবিধানে অনেক কথা বলা আছে, আবার সেখানে মার্ক করা আছে যে এ ক্ষেত্রে ওই কথাটি প্রযোজ্য হবে না। যেমন সংবিধানের ১৪৭-এর ৪-এ বলা আছে, মন্ত্রীর পদ হলো লাভজনক পদ। আবার ৬৬ ধারায় বলা আছে, কারা নির্বাচন করতে পারবেন না। সেখানে কিন্তু বলা আছে, যাঁরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে লাভজনক পদে নিয়োজিত, তাঁরা নির্বাচন করতে পারবেন না। তাহলে দাঁড়াচ্ছে যে মন্ত্রীও নির্বাচন করতে পারবেন না! পরে বলা আছে, নির্বাচনের জন্য মন্ত্রীর পদটা লাভজনক নয়। এ রকম সংবিধানের অনেক জায়গায় রয়েছে। বলা আছে, সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার আছে, কিন্তু আবার বলা আছে, ৪৫ অনুচ্ছেদে, যাঁরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নিয়োজিত, যাঁরা সেনাবাহিনীতে নিয়োজিত তাঁদের মৌলিক অধিকার নাই। তাহলে তাঁরা প্রশ্ন করতে পারেন, আমরা কি দেশের নাগরিক না? হ্যাঁ, তাঁরা নাগরিক; কিন্তু সংবিধানই আবার বলে দিয়েছে তাঁদের মৌলিক অধিকার নাই। আবার সংবিধানের প্রথমেই বলা আছে, সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার আছে। অতএব সংবিধানের অনেক জায়গায় এ রকম রয়েছে। আমি সারা দিন উদাহরণ দিতে পারব। সুতরাং প্রথমে যেমন একটি কথা বলা হয়েছে, তারপর আবার অন্য রকম এবং বিশেষ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম আছে। সুতরাং এটিও একটি ব্যতিক্রম যে যাঁরা সংসদ সদস্য ছিলেন, মন্ত্রী ছিলেন তাঁরা সংসদ ভেঙে গেলেও প্রথা হলো, সংসদ না থাকলেও ধরে নেওয়া হবে যে তাঁরা এখনো নির্বাচিত প্রতিনিধি। শুধু ওয়েস্টমিনস্টার নয়, সারা দুনিয়ার গণতান্ত্রিক দেশগুলোতেই একই ব্যবস্থা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত- সর্বত্রই এ রকম।
কালের কণ্ঠ : এখন বিরোধী দলকে আইনি ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে কিভাবে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে?
শাহদীন মালিক : প্রথা অনুযায়ী যে দল ক্ষমতায় আছে- আগামী সংসদ ভেঙে যাবে, কিন্তু এই দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। কিন্তু নির্বাচন করবে নির্বাচন কমিশন। এটা বাস্তবে এখন বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়, তাই তো? অতএব এখন সরকার বলছে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। অথবা ধরুন, প্রধানমন্ত্রী একবার বলেছিলেন এই সরকারের মধ্যে অন্য দলের দুয়েকজন থাকতে পারেন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়। কিন্তু এটা বিরোধী দলের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তারা চাচ্ছে যে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে না। এখন এ বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ব্যাপার হয়ে গেছে। এ সমস্যার এখন সমাধান হতে হবে রাজনীতির মাঠে, রাজনীতিবিদদের দ্বারা। দুই নেত্রী যদি দুই অবস্থানে অনড় থাকেন, তাহলে যেটা হবে তা হলো রাজনীতির মাঠে একজন জিতবেন। যদি বিরোধী দল জেতে, তাহলে একটি নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। আর যদি সরকারি দল জেতে, তাহলে এ সরকারের অধীনেই নির্বাচন হবে। তবে জনগণ এ পরিস্থিতি চায় না। তারা চায় একটি রাজনৈতিক সমঝোতা হোক। তার মধ্য দিয়ে একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন হোক। তবে আমার কাছে যেটা মনে হয়, দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু অবাধ নির্বাচন করতে পারবে সে ব্যাপারে জনগণের আস্থা নেই। আর সে ব্যবস্থা হলে বিএনপিও হয়তো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না। আর প্রধান বিরোধী দল যদি নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে, তাহলে যে দলই সরকার গঠন করুক না কেন, সেটা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। সেটা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না। আর সেটা না হলে আমার মনে হয় না যে সে সরকার তিন থেকে ছয় মাসের বেশি টিকতে পারবে। যেমন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন। সেটিও একতরফা হওয়ার ফলে টেকেনি।
কালের কণ্ঠ : আপনি বলছেন, দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন কমিশন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে এমন আস্থা জনগণের নেই। আপনি কি মনে করেন নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট শক্তিশালী নয়?
শাহদীন মালিক : নির্বাচন কমিশন যথেষ্ট শক্তিশালী, হয়তো দুয়েকটি ছোটখাটো ব্যাপারে সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দিতে পারে, কিন্তু নির্বাচন কমিশনের যে আইনি কাঠামো আছে তা সাধারণভাবে যথেষ্ট শক্তিশালী। কিন্তু সেই সঙ্গে আমাদের যোগ করতে হবে যে রাজনৈতিক দলগুলো যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের পক্ষে না থাকে, তারা যদি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয় যে আমরা জিতবই এবং জেতার জন্য যা করা দরকার হয় তা-ই করব, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে আপনি যতই শক্তিশালী করুন কাজ হবে না। শতকরা ৫-১০ জন যদি অনিয়ম করে, তাহলে নির্বাচন কমিশন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু ৩০০ আসনে দুই হাজার প্রার্থীর সবাই যদি মনে করেন, আমি আইন মানব না, আমাকে যে করেই হোক নির্বাচিত হতেই হবে, তাহলে নির্বাচন কমিশনের কী করার থাকবে?
কালের কণ্ঠ : আইনি কাঠামোতে নির্বাচন কমিশন শক্তিশালী আপনি বলছেন। কিন্তু দেখুন, অত্যন্ত জোরালো আবেদন করেও নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে কমিশন সেনাবাহিনী পায়নি। সরকার দেয়নি। তাহলে নির্বাচন কমিশনের শক্তি থাকে কোথায়?
শাহদীন মালিক : নির্বাচন কমিশন সরকারের কাছে অসংখ্যবার এ রকম চেয়েছে। একটা নির্বাচনে চেয়ে পায়নি। এটি আমি মনে করি একটি ব্যত্যয়। অসংখ্য পরীক্ষার মধ্যে একটি ঘটনা দিয়ে বিচার করা যাবে না। দেয়নি, অথচ নির্বাচনটি কিন্তু সর্বজনগ্রহণযোগ্য হয়েছে।
কালের কণ্ঠ : তাহলে শেষ কথা হলো, দুই দল সমঝোতায় এলে তত্ত্বাবধায়কবিষয়ক কোনো আইনি সংকট থাকবে না?
শাহদীন মালিক : অবশ্যই থাকবে না, এখন সব কিছু নির্ভর করছে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর। বিশেষ করে দুই নেত্রী এবং সংসদ সদস্যদের ওপর। তাঁরা বসে সমস্যার সমাধান করলে এ নিয়ে কোনো জটিলতাই থাকবে না। মূল কথা হলো, রাজনৈতিক মাঠ।
কালের কণ্ঠ : ধন্যবাদ আপনাকে।
শাহদীন মালিক : আপনাকেও ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.