লালমনিরহাটে জনসভায় শেখ হাসিনা-গণতন্ত্রের স্বার্থেই সংশোধনী

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গণতন্ত্র সুসংহত করতেই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আনা হয়েছে, যাতে জনগণের ভাগ্য নিয়ে আর কেউ ছিনিমিনি খেলতে না পারে। এ সংশোধনীর বিরোধিতাকারী বিএনপির উদ্দেশে তিনি বলেন, ভোটচোররা ভোট চুরি করে ক্ষমতায়
আসার চেষ্টা করছে। তারা যাতে সেটি করতে না পারে সে জন্য তিনি সবাইকে সজাগ থাকার আহবান জানান। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে লালমনিরহাটের কালেক্টরেট মাঠে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন।
শেখ হাসিনা আরো বলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র টিকে থাকবে। এ দেশের মানুষ ভোটের অধিকার আর কারো হাতে তুলে দেবে না। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধ ও চার নেতা হত্যার বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধবিরোধীরা বঙ্গবন্ধুসহ তাঁর পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'বিএনপি-জামায়াত জোট বা অন্য কোনো সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরু করেনি। কিন্তু আমরা এর বিচার শুরু করেছি, তা শেষও করব।'
এক বছরের মধ্যে উত্তরের জেলা লালমনিরহাটে দ্বিতীয়বারের মতো এলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে গত বছরের ১৯ অক্টোবর তিনি লালমনিরহাটে এসে ছিটমহল দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার সঙ্গে দেশের মূল ভূখণ্ডের সংযোগকারী তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে খুলে দেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, '২০২১ সালের মধ্যে আমরা এ দেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করব। আমরা বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে একটি শান্তির দেশে পরিণত করব।'
গত নির্বাচনে এ জেলার তিনটির সবকটি আসন মহাজোটকে উপহার দেওয়ায় বক্তব্যের শুরুতেই জেলাবাসীকে ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া মাঠের কাদাপানির মধ্যে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের জনসভা সফল করার জন্য কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, 'বিগত জোট সরকারের আমলের চেয়ে আমাদের সময়ে মানুষের আয় বেড়েছে, কমেছে দ্রব্যমূল্য। এ কারণে অর্থনীতি চাঙ্গা হয়েছে।'
সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, 'দেশের কল্যাণে আমরা কৃষিবান্ধব সরকার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছি। বিগত সরকারের আমলে কৃষকের কোনো উন্নয়ন হয়নি। আমাদের সরকার কৃষকদের উন্নয়নের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশে আজ খাদ্য ঘাটতি নেই, খাদ্য নিরাপত্তা যাতে বিঘি্নত না হয় সে জন্য আমরা কাজ করছি। জোট সরকারের আমলে চালের দাম প্রতি কেজি ৪০ টাকা ছিল, আমরা তা অনেক কমিয়ে এনেছি।'
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ২১ মিনিটের বক্তৃতায় লালমনিরহাটের উন্নয়নের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড উল্লেখ করে বলেন, 'লালমনিরহাট সদর হাসপাতালকে ২৫০ থেকে ৩৫০ শয্যায় উন্নীত করেছি ও একটি জিপ দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার সেন্টার করে দেওয়া হয়েছে। বুড়িমারী স্থলবন্দর ইতিমধ্যে আধুনিক করা হয়েছে। আমরা সরকারে এসে ভারত গিয়ে তিনবিঘা করিডর ২৪ ঘণ্টা খুলে রাখার ব্যবস্থা করেছি।'
২০০১ সালের নির্বাচনের পর লালমনিরহাটে বিএনপির নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, 'এই লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগ নেতা সামসুল ইসলাম সুরুজকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল। ছাত্রলীগ নেতা সোহেলকে হত্যা করেছিল তারা। আমরা তখন প্রতিবাদ জানাতে এসেছিলাম। আমরা তখন ওয়াদা করেছিলাম, বিএনপির সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ আমরা নির্মূল করব, আমরা তা করেছি।'
একসময় মঙ্গা এলাকা হিসেবে উত্তরাঞ্চলের বদনাম ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাঁর সরকার এই অপবাদ ঘুচিয়েছে। এখন আর কোনো মঙ্গা নেই। তিনি বলেন, 'সঠিক উন্নয়নের জন্য রংপুরকে আলাদা বিভাগ করেছি। সিটি করপোরেশন করেছি।'
লালমনিরহাট জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেনের সভাপতিত্বে জনসভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বাণিজ্যমন্ত্রী গোলাম মোহাম্মদ কাদের, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, জাফর আলী, মাজহারুল হক, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদ প্রশাসক মতিয়ার রহমান, কালীগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান নুরুজ্জামান আহমেদ, আদিতমারী উপজেলা চেয়ারম্যান সিরাজুল হক, হাতীবান্ধা উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি লিয়াকত হোসেন বাচ্চু, পাটগ্রাম উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল আমিন বাবুল, জেলা মহিলা লীগের সভাপতি সফুরা বেগম রুমী, সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু সাইদ দুলাল ও আওয়ামী লীগ নেতা মোফাজ্জল হোসেন।
জনসভা শুরুর আগে জনসভাস্থলে তৈরি করা কয়েকটি ফলক উন্মোচনের মাধ্যমে ১৭১ কোটি টাকা ব্যয়ে লালমনিরহাট-বুড়িমারী রেললাইন সংস্কারকাজ ও ২৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন ডায়াবেটিক হাসপাতালের বহুতল ভবনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হয়। এ ছাড়া লালমনিরহাটের কালীগঞ্জ ও রংপুরের গঙ্গাচড়ার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগের অংশ হিসেবে দ্বিতীয় তিস্তা সেতুর নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। লালমনিরহাট-কুড়িগ্রামের মধ্যে সংযোগের জন্য ধরলা সেতু ও নার্সিং ট্রেনিং কলেজ নির্মাণের লক্ষ্যে তিনি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
এর আগে প্রধানমন্ত্রী রংপুরে তিস্তা সড়ক সেতু উদ্বোধন করেন। এ উপলক্ষে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি রংপুরকে আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, 'রংপুরকে বিভাগ করেছি। সিটি করপোরেশনও করেছি। একে একে এখানকার উন্নয়নমূলক কাজ দ্রুত শেষ করা হবে। এই অঞ্চলকে আলাদা অর্থনৈতিক অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা হবে।'
১২২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হবে ৭৫০ মিটার লম্বা এ সড়ক সেতু। এর উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী রংপুরের কাউনিয়া প্রান্তে দুপুর সোয়া ২টার দিকে সুধীজনদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এতে বিএনপি ক্ষমতায় এলেই রংপুর অঞ্চলের উন্নয়ন থেমে যায় অভিযোগ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে এই এলাকার যথেষ্ট উন্নয়ন করেছে, ভবিষ্যতেও করবে। তিনি বলেন, সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করার সময় রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট অঞ্চল মঙ্গা ছিল। সে সময় তিস্তা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ করে এ এলাকার মানুষকে দারিদ্র্যের হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার চিন্তা করে আওয়ামী লীগ সরকার। তিনি বলেন, '২০০১ সালে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করি আমি। কিন্তু বিএনপির নেতৃত্বে চারদলীয় জোট ক্ষমতায় এলে সেতুর নির্মাণকাজ পিছিয়ে যায়। এ কারণে এ এলাকার মানুষের ভাগ্যের তেমন কোনো পরিবর্তন হয়নি। মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর তিস্তা সড়ক সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করা হয়।'
সেতু উদ্বোধনকালে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মোতাহার হোসেন প্রমুখ। উদ্বোধন শেষে সেতুর ওপর দিয়েই অন্য প্রান্তে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এর আগে দুপুর সোয়া ১টার দিকে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে অবতরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। পরে সড়ক পথে সেতুর উদ্বোধনস্থলে যান তিনি। এ সময় রাস্তার দুই পাশে এই এলাকার বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার হাজার হাজার মানুষ প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানায়।
২০০১ সালের ১ জুলাই তিস্তা নদীর ওপর লালমনিরহাট ও রংপুরের সংযোগস্থলে কাউনিয়ায় সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সরকার পরিবর্তনসহ প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় সেতু নির্মাণ নিয়ে আর এগোতে পারেনি সড়ক ও জনপথ বিভাগ। পরে ২০০৬ সালের ৫ আগস্ট সেতুর দ্বিতীয় দফা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র জানায়, কুয়েত ফান্ড ফর আরব ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের অধীন সড়ক ও জনপথ বিভাগ 'সেতু-৩ প্রকল্প'-এর আওতায় এ সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। রেল সেতুর ভাটিতে (পূর্ব পাশে) এ তিস্তা সড়ক সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ৮৭ কোটি ছয় লাখ চার হাজার ৩৬ টাকা। কিন্তু পাঁচ দফায় সময় বাড়ানোর কারণে প্রকল্প ব্যয় ৩৪ কোটি ৯৭ লাখ ৯৫ হাজার ৯৩৬ টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ১২২ কোটি চার লাখ টাকা।

No comments

Powered by Blogger.