পারিবারিক নির্যাতন না করা ও ঠেকানোর অঙ্গীকার- সমাজবদলের প্রচেষ্টায় ১০ লাখের বেশি ‘চেঞ্জমেকার’ by মানসুরা হোসাইন

বাংলাদেশের ১০ লাখের বেশি মানুষ পারিবারিক নির্যাতন করবেন না বলে আনুষ্ঠানিকভাবে অঙ্গীকার করেছেন। চোখের সামনে এ ধরনের নির্যাতন দেখলে তাঁরা মেনে নেন না। অন্যদেরও এ থেকে বিরত থাকতে উদ্বুদ্ধ করেন। এই অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষগুলো পরিচিত ‘চেঞ্জমেকার’ নামে।
পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের উদ্যোগে ‘আমরাই পারি’ নামে সামাজিক প্রচারাভিযানে যুক্ত হয়েছেন চেঞ্জমেকাররা। ২০০৪ সালে অক্সফামের সহায়তায় এ প্রচারাভিযানের সূচনা হয়েছিল বাংলাদেশেই। দক্ষিণ এশিয়াসহ বর্তমানে বিশ্বের মোট ১৫টি দেশে এটি চলছে।
পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের জাতীয় সমন্বয়কারী জিনাত আরা হক প্রথম আলোকে বলেন, যে কেউ যেকোনো সময় থেকে নিজেকে চেঞ্জমেকার হিসেবে ভাবতে পারেন। তবে তাঁর মধ্যে পারিবারিক নির্যাতনকে চ্যালেঞ্জ করার ইচ্ছা বা মনোবল থাকতে হবে। কাজে দায়বদ্ধতা বাড়ানো এবং পরিসংখ্যান রাখার সুবিধার জন্য এলাকার স্থানীয় সংগঠনের কাছে গিয়ে চেঞ্জমেকার হিসেবে নাম লেখাতে হয়। এর আওতায় সব কাজ করতে হয় সম্পূর্ণ স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে।
একজন ব্যক্তিকে চেঞ্জমেকার হওয়ার পর তিনি কমপক্ষে ১০ জনের সঙ্গে পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে কথা বলবেন বলে অঙ্গীকার করতে হয়। তবে গত বছর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পরিচালিত এক জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের একজন চেঞ্জমেকার গড়ে ৬৪ জনের সঙ্গে কথা বলেন। নেপালে ৩৯ জন, ভারতে ২৬ জন, পাকিস্তানে ১৯ জন এবং শ্রীলঙ্কার চেঞ্জমেকাররা ২৬ জনের সঙ্গে কথা বলেন। জরিপ বলছে, চেঞ্জমেকারদের কথা শোনার পর বাংলাদেশের শতকরা ৬৯ ভাগ মানুষই তা বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়েছে। এটিও দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি।
পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে ২০০৯ সালে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) করা এক গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৯৩ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার। ৯১ শতাংশ অর্থনৈতিক এবং ৮৪ শতাংশ নারী মানসিক নির্যাতনের শিকার। ১৩ শতাংশ নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে থাকেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে অনেকেই মুখ খুলতে চান না। এমনকি অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন চাকরিজীবী নারীরাও মুখ বুজে নির্যাতন সহ্য করেন। নির্যাতনের মাত্রা চরম পর্যায়ে পৌঁছালে তখন তা জানাজানি হয়।
বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে ‘আমরাই পারি’ প্রচারাভিযানের পক্ষ থেকে দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দেশে স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪৯ জন। স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন ১৯০ জন। স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে নির্যাতিত হয়েছেন ২২ জন এবং খুন হয়েছেন ৪৯ জন।
প্রতিরোধ জোটের জাতীয় কমিটির চেয়ারপারসন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাই পারি’ বা বিভিন্ন সংগঠন কাজ করার ফলে দেশে নারী নির্যাতন কমে গেছে তা বলার মতো পরিস্থিতি আসেনি। তবে বিভিন্ন পর্যায়ে সচেতনতা তৈরির ফলে নারীরা মুখ খুলছেন। ২০ বা ২৫ বছর ধরে নির্যাতনের শিকার নারীরাও আইনি সহায়তা পাওয়ার জন্য এখন আসছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রে।
আসকের নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, অনেকে ‘আমরাই পারি’ প্রচারাভিযানের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বুঝতে পারছেন যে এই নির্যাতনগুলো নিয়ে কথা বলা যায়। আট বছরে ১০ লাখ চেঞ্জমেকার তৈরি হওয়া অবশ্যই বড় একটি অর্জন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
জানা গেছে, চেঞ্জমেকারদের বেশির ভাগ নিজেরাও একসময় পরিবারে নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। কেউ কেউ আবার ছিলেন নির্যাতকের ভূমিকায়ও!
এ প্রচারাভিযানে ৪৮টি জেলায় ৩৯টি বেসরকারি সংগঠন সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করছে। এ সংগঠনগুলোতে মাসে গড়ে ৫০ থেকে ৬০ জন ভুক্তভোগী পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে কথা বলতে আসছেন।
শুরুতে মাত্র ছয়টি সংগঠন ও সাতটি জেলায় প্রচারাভিযানটি শুরু হয়। বর্তমানে দেশের প্রায় ৫০০টি স্থানীয়, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠনের সমন্বয়ে আন্দোলনটি স্বতন্ত্র পরিচয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। এখন ৫৫ জেলার ৪৭২ উপজেলার দুই হাজার ৩৮৪টি ইউনিয়ন পরিষদ ও ওয়ার্ডের ১৬ হাজার ৬৬৬টি গ্রামে চেঞ্জমেকাররা পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কাজ করছেন। চেঞ্জমেকারদের প্রায় অর্ধেকেরই বয়স ১৪-২৫ বছর। এ ছাড়া কর্মসূচিতে পুরুষের অংশগ্রহণ প্রায় শতকরা ৫০ ভাগ।
চেঞ্জমেকাররা দাবি করেন তাঁরা নিজের ব্যক্তিগত জীবন এবং আশপাশের মানুষদের মধ্যে কিছুটা হলেও পরিবর্তন আনতে পেরেছেন।
দিনাজপুরের রাহাবুর রহমান বলেন, তিনি আগে মা ও বোনদের সঙ্গে সারাক্ষণই খিটিমিটি করতেন। চেঞ্জমেকার হওয়ার পর বুঝতে পেরেছেন নারীদের সম্মান করতে হয়। সম্প্রতি রাহাবুর অন্য একজন চেঞ্জমেকারকে বিয়ে করেছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্ত্রীর সঙ্গে বোঝাপড়া ভালো। তাঁর ঘাড়ে বোঝা চাপাই না বা মানসিকভাবে নির্যাতন করি না। তাই আমরা খুব ভালো আছি।’
নওগাঁর পত্নীতলা উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মরিয়ম বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০০৮ সালে চেঞ্জমেকার হওয়ার আগ পর্যন্ত অনেক কিছুই জানতাম না। বলতে গেলে স্বামীর আচরণ পরিবর্তন করতে পেরেছি ৮০ ভাগ। অন্যদিকে ভাইস চেয়ারম্যান নিজে চেঞ্জমেকার হওয়ায় এলাকার মানুষজনও এ ধরনের নির্যাতন করতে খানিকটা ভয় পায়।’
দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের বর্গাচাষি চেঞ্জমেকার নুরুল হকের ভাষায়, ‘পুরুষ মানুষের তো, বুঝাই পাচ্ছেন টেনশন আছে কিছু ...রাগ যে একবারে করি না এইটা বললে সম্পূর্ণ মিথ্যা হবে। তবে এখন তো মনে করেন আমার রাগের ডিগ্রি ১০০ হতে ৫০ এর নিচে আসি গেছে।’
অক্সফামের কর্মসূচি-প্রধান এম বি আখতার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরাই পারি’ জোটের সচিবালয়ের কর্মীদের বেতন, প্রচারণা উপকরণ তৈরিসহ কিছু খাতে অক্সফাম এখনো আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। তবে অক্সফাম চাইছে আস্তে আস্তে আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দিতে, যাতে করে দেশীয় সংগঠন ও দাতা সংস্থা এবং বিশেষ করে সরকার নিজেই কার্যক্রমটি পরিচালনা করে।
এ ধরনের প্রচারাভিযানের গুরুত্ব প্রসঙ্গে সুলতানা কামাল বলেন, একজন নারী যদি সারাক্ষণ স্বামী বা তাঁর পরিবারের অন্যদের হাতে মার খাওয়ার ভয়ে থাকেন তাহলে তাঁর জন্য ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে। এ প্রচারাভিযানে যুক্ত হয়ে নারীরা এ আত্মবিশ্বাস অর্জন করছেন যে তাঁর সঙ্গে এ ধরনের আচরণ কেউ করতে পারবে না। ওই নারী এ আত্মবিশ্বাস অন্যান্য অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করতে পারছেন। শুধু সরকার আইন বা নীতি করে অবস্থার পরিবর্তন করে দেবে তা নয়। ‘আমরাই পারি’ কর্মসূচিতে প্রত্যেককে নিজের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাই এ প্রচারাভিযান অব্যাহতভাবে চলতে হবে।

No comments

Powered by Blogger.