স্মরণ- আমাদের মামানি by শারমিন লাকি

মনে হয় সেদিনের কথা। কিন্তু সবই এখন স্মৃতি। সিদ্দিকা কবীরের সঙ্গে কাজের সুযোগ পেয়েই আমি ধ্বনিচিত্রের অনুষ্ঠান করার প্রস্তাবে রাজি হয়েছিলাম। তখন আমি অডিও জগতের মানুষ। ধ্বনিচিত্র থেকে একদিন টেলিফোন করল। জানতে চাইল, একটা রান্নার অনুষ্ঠান হবে, আমি উপস্থাপনা করব কি না।


ভিজ্যুয়াল জগতে আসার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। তাই সঙ্গে সঙ্গে ‘না’ বলে দিলাম। কিন্তু পরে যখন জানাল অনুষ্ঠানটি হবে বিখ্যাত সিদ্দিকা কবীরের সঙ্গে, বিনা বাক্যে রাজি হয়ে গেলাম। শুরু হলো আমার জীবনের এক নতুন অধ্যায়।
সিদ্দিকা কবীর’স রেসিপি শুরুর আগে এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে সিদ্দিকা কবীরের বাসায় একটা আলোচনা সভার মতো হলো। সেবারই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। কী নাশতা খেতে দেয় তা নিয়ে ভেতরে ভেতরে আমি খুব উত্তেজিত। ঢোকার পর প্রথম কথা, ‘তুমিই শারমিন?’...এরপর সব আলোচনার পরে কত পদের নাশতা যে এল! সেই স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে।
শুটিং শুরু হলো। প্রথম দিকে আমি বেশ জড়সড় হয়ে থাকতাম। মাথার ওপর চারপাশে এত ক্যামেরার আলো। তবে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাই। শুরুতে আমাদের একজন সাহায্যকারী ছিল, তিনি রান্নার উপাদানগুলো ঠিক করে দিতেন। আমার কাজ ছিল পাশে দাঁড়িয়ে উপস্থাপনা করা। এভাবে প্রায় ৫০ পর্বের মতো হয়ে গেল। তত দিনে অবশ্য সিদ্দিকা কবীর আমাদের মামানি হয়ে গিয়েছেন। তিনি সারা যাকেরের মামি। সেই সূত্র ধরেই আমরা ইউনিটের সবাই তাঁকে মামানি বলে ডাকতাম। হঠাৎ একদিন সিদ্দিকা কবীর বললেন, ‘শারমিন, তুমি রুটি বেলতে পারো?’ আমার আত্মসম্মানে যেন লাগল কথাটি। কেননা, আমি রুটি আর লুচি খুব ভালোভাবে বেলতে পারি। আমি মামানির সামনে রুটি বেলতে শুরু করলাম। রুটি গোল হয়ে ঘুরতে লাগল। অনেকগুলো রুটি বানালাম। সিদ্দিকা কবীর মুগ্ধ হয়ে গেলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, ‘আর সাহায্যকারীর দরকার নেই। শারমিনই এখন থেকে আমাকে সাহায্য করবে।’ বাদ পড়ল সেই সাহায্যকারী।
ধীরে ধীরে গাম্ভীর্য আর কাঠিন্যের আবরণের আড়াল থেকে অন্য মামানিকে আবিষ্কার করতে থাকলাম। তাঁর মতো রসবোধসম্পন্ন মানুষ আমি কম দেখেছি। এটা তাঁর কাছের মানুষেরা ছাড়া আর কেউ বুঝতে পারে না। একবার এক পর্বে রেসিপির উপকরণ বললেও পরে সেটি ব্যবহার করতে ভুলে গিয়েছিলাম। সেই ভুল ধরে একজন দর্শক চিঠি লিখলেন। অনুষ্ঠানে সেটি পড়ে শোনানো হলো। উত্তরে সিদ্দিকা কবীর বলেছিলেন, ‘আমরা লজ্জিত। কিন্তু আমরা ভুল করলেও আপনি করবেন না। আপনারা আমাদের অনুষ্ঠান মনোযোগ দিয়ে দেখেন, সেটাও বুঝতে পারলাম।’
কীভাবে যে নয় বছর কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না। শুরুর দিকে সিদ্দিকা কবীর একদম সাজতে চাইতেন না। আমি জোর করে একটু সাজিয়ে দিতাম। পরে তো আমরা মিলিয়ে শাড়ি পরতাম। কখনো আবার রং কনট্রাস্ট করে পরেছি। দেখা গেল যেকোনো নিমন্ত্রণে, কোনো নতুন দোকান উদ্বোধনে একসঙ্গে যাওয়া হতো। কোথাও একা গেলেই প্রশ্ন, সিদ্দিকা কবীর কোথায়? বউ-শাশুড়ির ভূমিকায় আমাকে আর মামানিকে অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন অনেকে। বিজ্ঞাপনও করলাম একসঙ্গে। অনেকে ভাবতেন, সত্যিই হয়তো আমি তাঁর ছেলের বউ। একদিন সিদ্দিকা কবীর বললেন, ‘শারমিন, শর্মী (সিদ্দিকা কবীরের ছেলের বউ) তো রাগ করেছে। ওর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে।’ এ ছাড়া সব সময় বলতেন, ‘তুমি কিন্তু অডিও জগৎ একদম ছেড়ে দিয়ো না। কবিতা আবৃত্তি করা বন্ধ কোরো না।’
মৌসুমী ভৌমিকের গান ভীষণ পছন্দ করতেন। শুটিংয়ের ফাঁকে প্রায়ই আমাকে মৌসুমী ভৌমিকের ‘আমি শুনেছি সেদিন’ গানটা গাইতে বলতেন। আর সবার দিকেই তাঁর ছিল সমান খেয়াল। ইউনিটের সবাই খাবার খাওয়ার পর তিনি খেতেন। আমার ছেলের জন্য তো বাক্সে বা টিস্যুতে পেঁচিয়ে খাবার দিয়ে দিতেন। প্রথম দিকে আমরা রাত পর্যন্ত শুটিং করতাম। আমার অসুবিধা দেখে তিনি এই অনুষ্ঠানের পরিচালককে সন্ধ্যার মধ্যেই শুটিং শেষ করার কথা বললেন। এভাবে কবে কখন যে আমি মানুষটির আত্মার আত্মীয় হয়ে উঠেছি, বুঝতে পারিনি।
এনটিভিকে সিদ্দিকা কবীর কথা দিয়েছিলেন ৩০০ পর্ব পর্যন্ত চালিয়ে যাবেন সিদ্দিকা কবীর’স রেসিপি অনুষ্ঠানটি। শেষের দিকে তাঁর শরীর অসুস্থ থাকত। চিন্তা ছিল ৩০০ পর্ব শেষ করতে পারবেন তো? তিনি পেরেছিলেন। ৩০০ পর্ব পূর্ণ করেছিলেন ঠিকই। আরেকটি বিষয় না বললেই নয়, এই অনুষ্ঠানে সিদ্দিকা কবীর সব সময় পুষ্টিকর কম তেল-মসলাযুক্ত রান্নার রেসিপি দেখানোর চেষ্টা করতেন। উৎসবে বা বিশেষ অনুষ্ঠানে তিনি ভারী ধরনের খাবারের রেসিপি দেখাতেন। পৃথিবীর অনেক দেশে বড় বড় রেস্তোরাঁয় খেয়ে একটা জিনিস উপলব্ধি করেছি, সিদ্দিকা কবীরের মতো কেউ ডেজার্ট বানাতে পারে না। তাঁর অরেঞ্জ মাফিনের অন্য রকম স্বাদ। একবার খেলে জীবনে সেই স্বাদ ভোলা সম্ভব না। সিদ্দিকা কবীরের সব রেসিপির মধ্যে পোলাও ও মাছ রান্নার সময় মনে হতো যেন জাদু। সিদ্দিকা কবীর তাঁর বইয়ে আমাকে একটি অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন। সেখানে তিনি আমাকে ‘সুহাসিনী’ নামে সম্বোধন করেছিলেন। প্রতিবছর ঈদে আমরা নানা পরিকল্পনা করতাম। এবার আমি একা হয়ে গেলাম।
ভাবতেই পারছি না মামানিকে ছাড়া ঈদ করার কথা। প্রতিবছর ঈদে একটি শাড়ি কিনতাম আমার মায়ের জন্য, আরেকটা মামানির জন্য। সব সময় মনে হয় মামানি চারপাশেই আছে। মামানি নেই, এটি ভাবতে গেলেই শূন্যতা গ্রাস করে। একটা অদ্ভুত চাপা কষ্ট হয় আমার। এই কষ্ট কাউকে বোঝানো যাবে না।
অনুলিখন: তৌহিদা শিরোপা

No comments

Powered by Blogger.