মাদকাসক্তিতে শৈশব ছিনতাই by মাজেদুল নয়ন

নীলক্ষেত মোড়ের তেরো বছর বয়সী ছিন্নমূল শিশু রাজু। কাগজ কুড়িয়ে পেট চালায়। বন্ধুদের পীড়াপীড়িতে একদিন কটূ গন্ধযুক্ত ধোঁয়া নাকে টেনে কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকে সে। একটু পরেই মাথাটা যেন ফাঁকা হয়ে যায়। অন্যরকম অনুভূতি! এরপর আর থামেনি রাজু। আসক্ত হয়ে পড়ে ড্যান্ডিতে (জুতার গাম)।

এভাবেই সঙ্গদোষে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে রাজধানীর ছিন্নমূল শিশুরা। মাদক ব্যবসায়ও শিশুদের ব্যবহার বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতেই শিশুদের ব্যবহার করছে ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে ছিন্নমূল পথশিশুদের সংখ্যাই বেশি। আর মাদক বহন করতে গিয়ে একসময় নিজেরাই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে তারা।
আবার অনেকে মাদকাসক্তি থেকে আসছে ব্যবসায়। নেশার টাকা জোগাড় করতেই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে তারা।

রাজধানীসহ সারা দেশে এখন অনেক শিশু ফেন্সিডিল, অ্যালকোহল, গাঁজা, হেরোইন, প্যাথেডিনের মতো মাদকদ্রব্যের ব্যবসার সঙ্গে সরাসরি জড়িত। দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতেও মাদকপাচারে ব্যবহার করা হচ্ছে শিশুদের।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে বর্তমানে মাদক পাচারে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে নারী  ও শিশু। এর মূলে রয়েছে দারিদ্র্য।

মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক পরিদর্শক জানান, সীমান্তে মাদক পাচারে শিশুরা প্রতি ট্রিপে পায় নগদ ১০০ টাকা। যাতায়াত ভাড়া ও খাওয়ার করচ দেয় মাদক ব্যবসায়ীরা। শিশুদের দিয়ে এ কাজ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি কম। আবার ধরা পড়লেও সহজে ছাড়া পাওয়া যায়। এ সুবিধার কারণেই সীমান্তে শিশুদের নিরাপদ বাহক হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

চলতি বছরের শুরুতে জয়পুরহাট সদর পুলিশ নাজমুল (৯) ও শাহিনুর (৮) নামে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ুয়া দুই শিশুকে ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ পাঁচবিবি থেকে আটক করে। ফেনসিডিল পৌঁছে দেওয়ার জন্য তারা বগুড়া যাচ্ছিলো বলে জানায় পুলিশ। পরে জয়পুরহাট সদর থানায় নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে তাদের কাছ থেকে অনেক তথ্য উদ্ধার করে পুলিশ।

আটক নাজমুল পাঁচবিবি উপজেলার হাফিজুরের ছেলে এবং শাহিনুর একই এলাকার সজিব উদ্দিনের ছেলে। তারা উত্তর গোপালপুর গ্রামের রমজান আলীর ফেনসিডিল বহন করছিল। বগুড়ার তিন মাথা মোড়ে অপেক্ষায় থাকা সম্রাট নামে অপর ফেনসিডিল ব্যবসায়ীর কাছে পৌঁছে দিলে প্রত্যেককে একশ’ টাকা করে দেয় বলে জিজ্ঞাসাবাদের জানায় তারা। তাদের যাতায়াত ভাড়া ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে রমজান আলী। তাদের জানা মতে, রমজান আলীর ফেনসিডিল ব্যবসায় জড়িত আছে সাত শিশু।

গত জানুয়ারিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলায় ২৯ বোতল ফেনসিডিলসহ এক মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে ছয় বছর বয়সের এক শিশুকে আটক করে বিজিবি।

বিজিবি সূত্র জানায়, ছয় বছর বয়সী শিশু মহসীনকে স্কুল ব্যাগে করে মাদক পাচার করতে দিয়েছিল এক ব্যবসায়ী। আটক মহসীন জানায়, আখাউড়া রেলস্টেশনে তার ভিক্ষুক মায়ের সঙ্গে থাকে সে। বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছে। স্কুলে যাওয়ার সুযোগ তার কখনো হয়নি।

বিজিবি আরো জানায়, বাংলাদেশ সীমান্তের পাশে ভারতীয় ভূখণ্ডে ফেনসিডিল উৎপাদনের ৫১টি অবৈধ কারখানা রয়েছে। এসব কারখানা ফেনসিডিল আনার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে শিশুরা।

রাজধানীতে পথশিশু ও বস্তিবাসী শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে মাদক ব্যবসায়। বস্তিগুলো ঘনবসতি এলাকা হওয়ায় খুব সহজেই এ কাজ করছে বিভিন্ন বয়সের শিশু।

গোয়েন্দা সূত্রগুলোর দেওয়া তথ্য মতে, রাজধানীর নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির (পুরনো ক্যাম্পাস) পেছনে চন্দনের খুপরি দোকান, বিএনপি বস্তি, মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ, পিলখানা গণকটুলি, তেজগাঁও রেল বস্তিবাজার, এফডিসি গেট, খিলগাঁও রেলগেট, টিটিপাড়া, কমলাপুর রেলস্টেশনের পেছনের রাস্তা, শ্যামলী মেথর পট্টি, মিরপুর স্টেডিয়াম ও মাজার এলাকা, মিরপুর চিড়িয়াখানা এলাকা, ঢাকা কমার্স কলেজের সামনে, মিরপুর ১১নং বিহারি পট্টি, পুরনো ঢাকার নাজিরাবাজার, বাবুবাজার এবং আলুবাজারের লোহার মার্কেটের পেছনসহ বেশ ক’টি স্পটে মাদক কিনতে পাওয়া যায়। সবগুলো স্থানেই মাদকসেবীদের কাছে সরবরাহের কাজ করানো হয় শিশুদের দিয়ে।

 ২০১২ সালের এপ্রিলে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য ও মাদকাসক্তির ওপর এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রিভিলেন্স অব মেন্টাল ডিজঅর্ডার, এপিলেপসি, মেন্টাল রিটার্ডেশন অ্যান্ড সাবস্টেন্স অ্যাবিউজ অ্যামং চিলড্রেন অব ঢাকা ডিভিশন শীর্ষক এ প্রতিবেদনে জানা যায়, বর্তমানে মেয়ে শিশুরাও আসক্ত হচ্ছে মাদকে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১১ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়েশিশুরা মাদকে আসক্ত হচ্ছে বেশি। মেয়েশিশুরা নিরাপত্তহীনতাসহ সমাজ ও পরিবারের নানাবিধ অসঙ্গতির কারণে আত্মহত্যাসহ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছে বলে এতে মন্তব্য করা হয়েছে।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের হিসাবে, ঢাকা বিভাগে মাদকাসক্ত শিশুর ১৭ শতাংশই মেয়ে এবং ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সী মেয়েশিশুরা শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রচন্ড ঝুঁকিতে রয়েছে।

এ প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, শুধু ভবঘুরে, ভাসমান যৌনকর্মী বা পথশিশুদের মধ্যেই মাদকসেবন সীমাবদ্ধ নেই এখন মধ্যবিত্ত বা ধনী পরিবারের শিশুরাও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

কেউ বাবা-মায়ের মধ্যে ঝগড়া বা বিচ্ছেদের কারণে, কেউবা বন্ধুদের সঙ্গে শখের বশে মাদক নিতে গিয়ে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞ মতামতে বলা হয়েছে, মাদক মনের জোর কেড়ে নেয়। নষ্ট করে দেয় স্বাভাবিক ভদ্রতাবোধ, কর্তব্যবোধ ও সৌজন্যতা।

ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়েশিশুরা মাদক বা অপরাধ সংঘটনের ক্ষেত্রে বেশি ঝুঁকিতে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের একটি সূত্র জানায়, রাজধানীতে প্রায় ৮শ’ মাদক ব্যবসায়ী রয়েছে। একেকজন মাদক ব্যবসায়ীর ১০ থেকে ১২ জন করে সেলসম্যান আছে যাদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।

তবে, বিক্রেতা ও বহনকারীদের মধ্যে ৫০ ভাগ নারী ও ৩৫ ভাগ শিশু রয়েছে বলে দাবি করেছে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি সূত্র। এ হিসাবে শুধু রাজধানীতেই ৮ হাজার নারী ও ২ হাজার ৮শ’ শিশু মাদক বিক্রয় ও বহনের সঙ্গে জড়িত।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এএস মাহমুদ এ ব্যাপারে বলেন, “রাজধানীতে বর্তমানে প্রায় চার লাখ শিশু ছিন্নমূল। এর মধ্যে প্রায় এক লাখ শিশু মাদকাসক্ত। দেশের সীমান্ত এলাকাগুলোতে মাদক বহনে শিশুদের ব্যবহার করা হয় সবচেয়ে বেশি।”

ব্যবসায়ীরা নিজেদের স্বার্থে শিশুদের মাদকাসক্ত করে তোলে বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, এছাড়া রাজধানীর একাধিক চক্র ও প্রভাবশালী ব্যক্তি স্বার্থ হাসিল করতে ছিন্নমূল শিশুদের নেশায় জড়িয়ে দিচ্ছে। প্রথমে তারা মাদকদ্রব্য ফ্রি দেয়। আসক্ত হয়ে পড়লে শিশুরা তখন এমনিতেই কিনতে বাধ্য হয়। আর এ টাকা জোগাড় করতে গিয়ে ব্যবসায় জড়িয়ে পড়া ছাড়া উপায় থাকে না।

এএস মাহমুদ আরো জানান, ড্যান্ডি, প্যাথেড্রিন ছাড়াও বর্তমানে শিশুরা ইয়াবা, পোড়া মবিল ও টিকটিকির লেজ খেয়েও নেশা করছে। এগুলো স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ¶তিকর।

এখন এই ছিন্নমূল শিশুদের মাদকাসক্তি থেকে ফেরানো এবং পুনর্বাসনের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা আহছানিয়া মিশনের সমš^য়কারী ইকবাল মাসুদ চৌধুরী বলেন, “মাদকাসক্ত শিশুদের কিছুদিন চিকিত্সা দিয়ে ছেড়ে দিলে চলবে না, পাশাপাশি তাদের পুনর্বাসন করতে হবে। অন্যথায় এসব শিশু রাস্তায় ফিরে গিয়ে আবারো মাদকাসক্ত হয়ে পড়বে।”

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জিল্লুর রহমান খান রতন বলেন, “পথশিশুরা অভিভাবকহীন-ছন্নছাড়া জীবনযাপন করে বিধায় তারা সহজেই যে কোনো ধরনের নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ে। এরা ৮ থেকে ১০ বছর বয়সেই নেশার জগতে প্রবেশ করে। এতো অল্প বয়স থেকে নেশা করায় তাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় এবং অপুষ্টিসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে পরিণত বয়সের আগেই মৃত্যুমুখে পতিত হয়।”

No comments

Powered by Blogger.