বন্ধু সাকিব by তারেক মাহমুদ

প্রত্যেক মানুষের ভেতরে আরেকটা মানুষের বাস। বাইরের মানুষ আর ভেতরের মানুষ এক নাও হতে পারে। রুদ্র-কঠোর বহিরাবরণ উচ্ছল অন্দরমহলের আভাস কদাচিত দেয়। অবিশ্বাসীদের জন্য জ্বলন্ত এক উদাহরণ সাকিব আল হাসান।


‘সাকিব আল হাসানকে যেমন দেখেছি’ জাতীয় বইয়ে ‘মুডি’ সাকিবের কথাই বেশি আসবে। সাকিব তিনটা কথার জবাবে একটা কথা বলেন। অনেক সময় একটা কথাও না বলে শুধু হাসেন। সাকিবের মধ্যে আবেগ কম, সাকিব মানুষ না হয়ে একটা রোবট হলে ভালো হতো—ইত্যাদি ইত্যাদি।
সাকিবের চরিত্রের প্রকাশিত অংশে ওরকম ধারণা বেশি পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু ‘অফিশিয়াল’ সাকিবের সঙ্গে ‘আনঅফিশিয়াল’ সাকিবের পার্থক্য বিরাট। ব্যক্তিগত আড্ডায় সাকিবও উচ্ছল, মনের কথা গজ-ফিতা দিয়ে মেপে মেপে বলেন না।
দেশের সবচেয়ে বড় তারকার নাম এ মুহূর্তে সাকিব আল হাসান। বয়স বেশি না বলেই হয়তো নিজেকে আড়াল করতে অনেক সময় কঠিন ব্যক্তিত্বের কপট বর্ম তাঁকে পরতেই হয়। তার পরও সাকিবকে ঘিরে আলো থাকে। সাকিব তরুণীদের কাঙ্ক্ষিত পুরুষ হন এবং সাকিবের হূদয়ও কখনো কখনো বয়সের দাবি মেনে রাত জাগে—হতেই পারে এসব। একজন তরুণ তারকার ব্যক্তিগত জীবনে এটুকু রং থাকা দোষের নয়।
তবে সাকিবের বন্ধুত্ব-দর্শন একটু ভিন্ন। বন্ধু হলেই দিন-রাত আঠার মতো লেগে থাকতে হবে, কারণে-অকারণে মুঠোফোনের বোতাম টিপতে হবে, ব্যাপারটা তাঁর কাছে তেমন নয়। সাকিব বলেন, বন্ধুত্ব মনস্তাত্ত্বিক ব্যাপার। মোবাইল-ফেসবুকের চেয়ে মানসিক যোগাযোগের নেটওয়ার্কই এখানে ‘স্ট্রং’ থাকা জরুরি। আর বন্ধু মানে, যার সঙ্গে কথা বলে ভালো লাগে। যার সঙ্গ উপভোগ্য। যার সামনে অবলীলায় মনের কপাট খুলে দেওয়া যায়। যাকে দিনের পর দিন না দেখলেও মরচেহীন চকচকে সম্পর্ক থাকে। সাকিবের চোখে সেই ভালো বন্ধু, ‘...যার সঙ্গে কথা বললে শান্তি শান্তি লাগে। কিছু জিনিস ভাগাভাগি করা যায়। সে কিছু বললে আমার ভালো লাগবে। আমি কিছু বললে তার ভালো লাগবে।’ তবে যিনিই সাকিবের বন্ধু হবেন, অন্য বন্ধুদের সঙ্গে পার্থক্যটা ভালোই বুঝবেন নিশ্চয়ই। বন্ধু হিসেবেও যে সাকিব প্রবল ব্যতিক্রম! বন্ধুত্বের দাবি নিয়ে এলেও সবাইকে সব আবেগ আর ভাবনার ভাগ দেবেন না তিনি, ‘কিছু জিনিস থাকেই যা কারও সঙ্গে শেয়ার করা যায় না। খুব ভালো বন্ধুর সঙ্গেও না।’
বন্ধুত্বকে ‘মানসিক যোগাযোগ’ ভাবেন বলেই হয়তো আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার ব্যাপারগুলো সাকিবের মধ্যে নেই। নিয়ম করে ফোন করা, সকাল-বিকেল যোগাযোগ, আড্ডা—কোনোটাই হয় না। সময় না পাওয়া একটা কারণ। মন থেকেও ঠিক আসে না এসব লৌকিকতা, ‘কারও সঙ্গে যে সারাক্ষণ কথা বলি, এ রকম হয় না। এমন কেউ নেই যার সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতেই হবে। না করলে রাগ করবে। মাগুরা গেলে দেখা হয় সবার সঙ্গে। কিংবা কোনো ট্যুর থেকে এসে হয়তো সবাই একসঙ্গে বসলাম। নিয়ম করে কিছু না হলেও বন্ধু বন্ধুই থাকে।’ তা কী হয় বন্ধুদের আড্ডায়? ‘কার জীবনে কী কী ঘটছে এসব নিয়ে কথা হয় না। সবার জীবনেই তো সুখ-দুঃখের কত কাহিনি থাকে। তার সবই আলোচনায় আসে না। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে মজাই হয় বেশি। ছোটবেলার স্মৃতি নিয়ে কথা হয়।’
জীবনে তিনটা ভাগ সাকিবের। মাগুরার সাকিব, বিকেএসপির সাকিব, তারকা সাকিব। তিন সময়ে তিন ধরনের বন্ধু। মাগুরার বন্ধুরা স্কুলের বন্ধু বা এলাকার বন্ধু। এবার ঈদে মাগুরায় গেলে দিনের অর্ধেক সময় এই বন্ধুদের উৎসর্গ করে দেবেন, ‘ঈদে মাগুরায় গেলে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত নিজের মতো থাকি। বিকেল থেকে বন্ধুদের সঙ্গে। ওখানে আমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সবাই মিলে চিন্তা করে ঠিক হয় আড্ডা দিতে কোথায় যাওয়া যায় বা কী করা যায়। তারা যেখানে যায় আমিও পেছন পেছন যাই।’ সাকিবের মাগুরার বন্ধুমহল ২৫-৩০ জনের। তাদের মধ্যে আবার কাছের বন্ধু, দূরের বন্ধু আছে। ছোটবেলায় যেমন পাশের বাসার প্রতীক ছিল সবচেয়ে কাছের বন্ধু।
দ্বিতীয় ধরনের বন্ধুরা বিকেএসপির। জীবনের অনেকটা সময় এখানেই কেটেছে। বিশেষ করে বন্ধুত্বের গাঁথুনি শক্ত করা বয়ঃসন্ধিকালটা। সাকিবের ভাষায়, ‘আসল সময়টাতে তো বিকেএসপিতেই ছিলাম।’ তো সেই আসল সময়ে সাকিবের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ছিল সায়মন, এখনো তা-ই আছে। সাকিব বিশেষ দ্রষ্টব্যের মতো বলেন, ‘ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের মধ্যে ও আলাদা।’ বড় হওয়ার পর মাগুরার বন্ধুদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ নয়ন। কাছের বন্ধুদের কথা আলাদা করে বলতে বললে সায়মন আর নয়নের কথাই আসে, ‘সায়মনের সঙ্গে দেশের বাইরে গেলেও কথা হয়। নয়নের সঙ্গেও কথা হয়। নয়ন মাগুরার বন্ধু। ঢাকা কলেজে পড়ে। ওদের সঙ্গে বেশির ভাগ জিনিসই শেয়ার করি, মানে একজন বন্ধুর সঙ্গে যতটুকু করা যায় আর কি।’
শৈশব-কৈশোর মাগুরা আর বিকেএসপিতে কাটায় সাকিবের কাছে এই দুই জায়গার বন্ধুরাই বেশি প্রিয় হবেন স্বাভাবিক। প্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ, তারকা বন্ধুর ব্যাপারে এই বন্ধুদের বাড়তি আগ্রহ নেই, ‘আমাকে নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই তাদের। দেখা হলে কিরে কী খবর, কেমন আছিস, এর বাইরে কিছু জানার থাকে না। বন্ধুদের আড্ডায়ও বেশির ভাগ সময় আমি মধ্যমণি থাকি না। আমারও এটাই পছন্দ। ওরা আমাকে আগে যেমন দেখত, এখনো ওভাবেই দেখে। ক্রিকেটার সাকিবকে নিয়ে কেউ অত বেশি আগ্রহী না।’
সাকিব আল হাসানের নামডাক এখন আর টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায় আটকে নেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানেই এই নামের প্রতিধ্বনি শোনা। সাকিবের বন্ধুমহলও ছড়িয়ে পড়েছে দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে। এই বিদেশি বন্ধুরা হলো তৃতীয় ধরনের বন্ধু। কাউন্টি ক্রিকেট, আইপিএল খেলার সুবাদে ইংল্যান্ডের মঈন আলী বা ভারতের মনোজ তিওয়ারি যেমন। এখানেও অবশ্য বন্ধুত্ব-দর্শন একই—নিয়মিত যোগাযোগ কারও সঙ্গেই নেই। হঠাৎ হঠাৎ ফোন আসে, ফোন যায়। ভালো পারফরম্যান্সে অভিনন্দন বিনিময় হয়। ছাড়া ছাড়া বন্ধুত্ব মঈন-তিওয়ারিরা কেমন উপভোগ করেন কে জানে, সাকিবের কাছে দেশি-বিদেশি সব বন্ধুই এক, ‘বন্ধুদের সঙ্গে সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কমই কথা হয়। দুষ্টামি-ফাজলামি, শপিং করতে যাওয়া, খেতে যাওয়া—এসবই বেশি হয় আসলে। মনোজ-মঈনের সঙ্গেও সম্পর্কটা সে রকম। অন্য বিদেশি খেলোয়াড় বন্ধুদের সঙ্গে হয়তো হাই-হ্যালোর সম্পর্ক। এদের সঙ্গে হায়-হ্যালোর চেয়ে একটু বেশি।’
কোনো কিছুতেই বাড়তি আগ্রহ না দেখানোর একটা অলিম্পিক হলে সাকিব তাতে সোনা জিততে পারেন। যত কাছের বন্ধুই হোক, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি তাঁর অপছন্দ, ‘অন্যদের ব্যাপারে আমার অত কৌতূহল নেই। সে জন্য আবেগাক্রান্ত সম্পর্কও বেশি হয় না। সবারই ব্যক্তিগত জীবন আছে। কেউ যদি নিজ থেকে তার কথা বলতে চায় শুনি। নইলে কিছু জানতে চাই না। প্রশ্ন করতে আমি খুব একটা পছন্দ করি না।’ বন্ধুর বিপদে-আপদে এই সাকিবই আবার অন্য রকম। অসুস্থ কোনো বন্ধুর যদি রাত তিনটায়ও রক্তের প্রয়োজন হয়, তার জন্য ঠিকই ছুটে যাবেন হাসপাতালে।
সাকিবের বন্ধু হলে সুবিধা আরও আছে। বন্ধুদের আচরণে কষ্ট পাওয়ার লোক এই ক্রিকেটারটি নন। রাগের বশে কেউ কিছু বলে ফেললেও বেশি দূর গড়ায় না। দুদিনেই ভুলে যান সাকিব, ‘বন্ধুদের আচরণে কখনো কষ্ট পাই না। মনেও থাকে না কে কী বলল। ছয় মাস আগে কী হয়েছে, এটা আমার পক্ষে মনে রাখা কঠিন। এ জন্য কে কী কষ্ট দিল সেটাও মনে থাকে না।’
বন্ধু সাকিবকে তো জানলেন। এখন সাকিবকে বন্ধু বানাবেন কি না, সে আপনার সিদ্ধান্ত।

No comments

Powered by Blogger.