স্মৃতির মহল্লা- মেড ইন নাখালপাড়া by মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

চড়ুইভাতি নামে আমার একটা টেলিছবি আছে। সেখানে একটা দৃশ্যে ইলোরা গহর অপি করিমের ডিজাইন পরীক্ষা নিচ্ছিল। পুরুষঘটিত কারণে ইলোরা আগে থেকেই অপির ওপর বিরক্ত ছিল। ঝাল মেটানোর দুরন্ত সুযোগ পেয়ে ইলোরা প্রশ্ন করে—


ইলোরা—এটা কী ডিজাইন করছ? তুমি থাক কোথায় যেন?
অপি—নাখালপাড়া।
ইলোরা—ও, নাখালপাড়া? তাইলে তুমি ভালো ডিজাইন দেখবা কোত্থেকে?
এই কথার সারমর্ম হচ্ছে—নাখালপাড়ার মেয়ে হলে তোমার রুচি তৈরি হবে কোত্থেকে? এই কথাটা চড়ুইভাতিতে অপিকে শুনতে হলেও বাস্তবে আমাকে বহুবার শুনতে হয়েছে। যে কারণে শৈশব থেকেই বাইরে গেলে আমি সচেতনভাবে আড়াল করার চেষ্টা করতাম যে ‘আমি নাখালপাড়ার ছেলে’। এই রকম একটা অবদমনের ভেতর দিয়ে বড় হওয়া দুঃসহ এক ব্যাপার। ফলে বড় হয়ে যখন নিজের ভেতরের আনন্দ-বেদনার ঝাঁপি খোলার সুযোগ পেলাম, তখন প্রথম সুযোগেই উগরে দিলাম নাখালপাড়ার জন্য ভালোবাসা। চড়ুইভাতির ওই দৃশ্যটা ছিল আমার স্মৃতির ঘায়ে লাগানো একটু মলম।
এই নাখালপাড়াকে নিয়ে যখন ৬০০ শব্দের মধ্যে লিখতে বলা হলো প্রথম আলো থেকে, তখন আনিস ভাইকে প্রথম যে কথাটা বললাম, ‘অসম্ভব ব্যাপার! নাখালপাড়া নিয়ে তো ৬০০ শব্দে কোনো লেখা শেষ হতে পারে না। কারণ নাখালপাড়া আমাকে প্রগলভ করে দেয়।’ তবু দেখা যাক, আল্লাহর নামে একটা চেষ্টা দিই।
নাখালপাড়া কীভাবে আমাকে তৈরি করেছে? নাখালপাড়ায় আমরা কী কী পেয়েছিলাম? কী ঐশ্বর্য ছিল নাখালপাড়ার? নাখালপাড়ায় উদ্ধত নারকেলগাছের মাথায় টিয়া পাখির ঝাঁক ছিল। মধ্য দুপুরে নিঃসঙ্গ গলিতে কমলা রোদের বান ছিল। আর ছিল গল্প-বুড়ির বাড়ি। আমাদের প্রতিটা জানালায় গল্প ঝুলে থাকত। প্রতিটা বারান্দায়, বাড়ির সীমানা দেয়ালের আড়ালে, গলির সুনিপুণ বাঁকে গল্প ছড়িয়ে ছিল। বিচিত্র সব মানুষের ততোধিক বিচিত্র সব গল্প। আমার তো মনে হয় নাখালপাড়ায় ঘুরে বেড়ালে আমার বেশির ভাগ চরিত্রের আর্কিটাইপ খুঁজে পাওয়া যাবে। হয়তো দেখা যাবে, ফোর টুয়েন্টির মন্টু বাড়ির টেক্কিতে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে, কিংবা থার্ড পারসন সিঙ্গুলারের রুবা মায়ের বাড়ি ছেড়ে রাতের অন্ধকারে অনিশ্চিত গন্তব্যে যাত্রা করেছে, কিংবা ক্যারাম-এর শফিকুল ক্যারম খেলায় হেরে এখনো হেনস্তা হচ্ছে। তবে বলুন, আমি নাখালপাড়ার এইসব ঐশ্বর্যকে অস্বীকার করব কোন মুখে?
আমার ছবির চিত্রনাট্য লেখা হতো নাখালপাড়ায়, আমার শৈশবে। সেখানে আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোই পরে স্রেফ পুনরুদ্ধার করেছি বড় হয়ে লেখা চিত্রনাট্যে। আমি এর আগে একটা লেখায় লিখেছিলাম, নাখালপাড়াই আমার গল্প বলার বিশেষ ভঙ্গিটা তৈরি করে দিয়েছে। মহল্লার মানুষ কঠিন রকমের রসিক হয়। যে ঘটনা সোজা-সাদামাটাভাবে ঘটানো যায়, সেটা তারা ঘটাত ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে, রহস্য করে। ফলে চিত্রনাট্যের শেষ অঙ্কের জন্য সবাই অপেক্ষায় থাকত। একটা উদাহরণ দিই। ধরা যাক, মহল্লার উঠতি কিশোর বাবলু নতুন সিগারেট খাওয়া ধরেছে। লুকিয়ে সিগারেট খেতে গিয়ে কোনো মুরব্বির চোখে পড়ে গেছে। মুরব্বি ওইখানেই ওকে ধাওয়া না করে গল্পটা ঠেলে দেন পরের দিনের দিকে। পরদিন মুরব্বি বাবলুকে ডেকে পাঠান। ১০০ টাকার নোট দিয়ে এক প্যাকেট গোল্ডলিফ সিগারেট আর একটা ম্যাচ আনতে বলেন। বাবলু সিগারেট, ম্যাচ আর ফেরত পাওয়া ভাঙতি টাকা মুরব্বির হাতে তুলে দিতে গেলে মুরব্বি শুধু টাকাটা নিয়ে সিগারেট আর ম্যাচ বাবলুর কাছেই রাখতে বলেন। তারপর বেশ রসিয়ে বলেন, ‘কি ফাচুকি সিগারেট খাও? খাইবা যখন ভালোটা খাও, গোল্ডলিফ খাও।’ সরাসরি সিগারেট খেতে নিষেধ না করে এই যে বিশাল চিত্রনাট্য রচনা করে অবশেষে শেষ দৃশ্যে এসে আসল তথ্যটা ইঙ্গিতে দিলেন—এটাই কি আমার গল্প বলার ভঙ্গিতে ভর করেনি? তবে বলুন, আমি নাখালপাড়ার ঐশ্বর্যের কোন ঋণকে অস্বীকার করব?
নাখালপাড়ায় পাঠাগার ছিল। গলিতে গলিতে ক্লাব ছিল। বছরজুড়ে ফুটবল-ক্রিকেট-ব্যাডমিন্টন-বরফ পানি-টিলো স্প্রেস-পিঠ জালান্তিস—বিচিত্র সব খেলা ছিল। শীত মৌসুমে গলিতে গলিতে পাল্লা দিয়ে চলত রচনা প্রতিযোগিতা, নাচ-গান-আবৃত্তি-নাটক। এসবই তো আমাকে ঠেলে দিয়েছে শাহবাগের দিকে।
প্রিয়তমা নাখালপাড়া, আমি তোমায় ভালোবাসি। এই পর্যায়ে তিশা এসে জানতে চাইল, কী লিখি। উত্তর শুনে বলল, ‘নাখালপাড়াকে নিয়ে লেখা নাখালপাড়ায় গিয়েই লিখতে হবে।’ তথাস্তু। তার সঙ্গে চললাম নাখালপাড়ায়। মহল্লায় ঢুকতেই ‘আস্সালামু আলাইকুম ভাই’, ‘ভাবি, আস্সালামু আলাইকুম’ সংগীত শুরু হলো সমবেত কণ্ঠে। এবার বউ বলল, ‘সব তো ভালো কথা লিখলা। এবার ওই কথাটাও লিখো। তা হলে না সম্পূর্ণ হবে লেখাটা।’ ‘ওই কথাটা’ হলো—এই যে এত ভালোবাসি নাখালপাড়াকে, কিন্তু সেখানে তো থাকি না। প্রেমের শুরুর দিকে তিশা বলছিল, বিয়ের পরে নাখালপাড়ায় থাকবে। আমি সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে সেটা ঠেকিয়েছি। কেন? এত ভালোবাসা নিয়েও তবে কেন দূরে থাকা? নাকি ভালোবাসলে দূরেই থাকতে হয়? নাকি আমি আসলে আমার স্মৃতির নাখালপাড়াকে ভালোবাসি, যেটা এই নাখালপাড়ায় নেই। যে নাখালপাড়াকে খুঁজতে আমি এই নাখালপাড়ায় যাই।

No comments

Powered by Blogger.