(অপ্রকাশিত রচনা) বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য by সেলিম আল দীন

ঐতিহ্য কথাটা কোন জাতি-সম্প্রদায় দেশের ইতিহাসে সামগ্রিক অবয়ব সম্পর্কিত এক স্বাভাবিক নির্বাচনের সমকালীন ধারাকেই নির্দেশ করে। আর সংস্কৃতি সেই ঐতিহ্যের খানিকটা অংশের সঙ্গে দেশকালের রাজনীতি- অর্থনীতি ও বিশ্বব্যবস্থার যোগে রচিত হয়।

প্রাচীনকালে এই উপমহাদেশের এক ভাষাতাত্ত্বিক দার্শনিক এমত বলেছেন যে- ‘বর্তমান ব্যাপার না হলেই যে বর্তমান কালের বিষয় হবে না তা নয়। তা যদি হত তাহলে বর্তমান কাল হয় কি করে।’ সংস্কৃতিও এই চিরজীবী বর্তমান।
প্রাচীনকালে, গৌড়-বঙ্গ-সমতট-হরিকেল-চন্দ্রদ্বীপ-রাঢ়ের মধ্যে, ‘বঙ্গ’ নামটিই শেষ অবধি সমগ্র ভৌগলিক সীমাকে জয় করে বাংলাদেশ হয়ে উঠল। সে কালের রাজ্য কিংবা ভৌগলিক সীমা, আধুনিক কালের রাষ্ট্র-দর্শনের মতে বিচার্য নয়। কিন্তু রাষ্ট্র আধুনিক মানুষের এক অসাধারণ সৃষ্টি। তার মধ্যে সম্প্রদায়-গোষ্ঠী-জাতি-মহাজাতি এক আঙ্গিকে লীন হয়ে যায়। আধুনিক মানুষের বুদ্ধি ও যুক্তি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধই রাষ্ট্রের ভিত্তি। আজকের বাংলাদেশ তার রাষ্ট্র সীমার মধ্যে সার্বভৌম। এই রাষ্ট্রীয় সীমায় বসবাসকারী নানা জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি তাই রাষ্ট্রের সীমানায় বিচার করাটাই জরুরী। এর মধ্যে বৈচিত্রময় সাংস্কৃতিক ঐক্যের সূত্র সন্ধান প্রয়োজন।

খ্রীষ্টপূর্বকাল থেকে প্রচলিত বাঙালীর নিজস্ব দর্শন সাংখ্য-যোগতন্ত্রের প্রভাবে- বৌদ্ধ ধর্মের ধ্রুপদী- জন্মান্তরবাদ হয়ে উঠল ‘বৌদ্ধ সহজিয়াতন্ত্র’। বাঙলার প্রাচীন এক ধর্মসম্প্রদায়- যাঁরা সিদ্ধাচার্য নামে খ্যাত হলেন তাঁদের হাতে প্রথম রচিত হল চর্যাপদের মত অসাধারণ গীতিমূলক পদ। পণ্ডিতদের মতে, (ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ) এই চর্যাপদের প্রভাবেই ইরানে গজলের উদ্ভব। সিদ্ধাচার্যদের গীতিমূলক এই পদের ধারা থেকেই আমাদের গীতিপ্রবণ মানসিকতার প্রথম পরিচয় লভ্য।

পাল বংশের চিত্রকলায় ঐশ্বর্য সর্বভারতীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করলে দেখা যায়- আমাদের মনমানসিকতা রঙ আর রূপের ভিন্ন পন্থা বেছে নিয়েছে। সে সকল চিত্রে নারীর অঙ্গাভরণের মধ্যে রয়েছে কর্ণ-কণ্ঠ-হাত ও বাহুর বিচিত্র অলঙ্কার। সিদ্ধাচার্যরা সর্বত্যাগী গায়ে মাখতেন ভষ্ম- নগ্ন থাকতেন নানা যোগমুদ্রায়- অমর হবার দুর্মর সাধনায় লিপ্ত হতেন।

এরপর সেন বংশের আমলে- ব্রাহ্মণ সংস্কৃতি বাহিত হল উচ্চকোটি সমাজে। এক অভিজাত উম্মূল সংস্কৃতি রচনার প্রয়াসী হলেন বল্লাল সেন ও তৎপরবর্তী সম্রাটগণ। সে চেষ্টা যে বাঙলার সাহিত্য শিল্পরীতিতে খুব একটা গ্রহণযোগ্য হলো না তার প্রমাণ লক্ষণ সেনের সভাকবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’। ভাষা প্রাকৃত-সংস্কৃত-কাব্যরীতি মঙ্গল নাটের ধারা। এ কালে নৃত্য দাক্ষিণাত্যের খানিকটা ছায়া পদ্মাবতীর নাচে প্রত্যক্ষ করা যায়।

লক্ষণ সেনের সভায় বর্ণাশ্রমের প্রভাব ছিল। শেখ গুভোদয়ায়-নটগাঙ্গে নিম্নশ্রেণীর তন্তবায়ীদের সঙ্গে যে কৌতুককর ঘটনা ঘটান- তা তাদের জন্য ছিল মর্মান্তিক। এ সময়ে এলেন আধ্যাত্মিক সাধনায় জয়ী এক দরবেশ- জালালুদ্দিন তাব্রিজী। অবাক হতে হয়- তিনি জয়দেব ও তদীয় পত্নীর সঙ্গীতের গুণগ্রাহী। বারাঙ্গনা নর্তকী শশীকলাকে করছেন পুরস্কৃত। স্বয়ং লক্ষণ সেন হলেন তার ভক্ত। প্রাচীন ভাদুগানে শেখের গুণ এবং অতিলৌকিক ক্ষমতার কথা স্থান করে নিলো।

এরপর মুসলমানদের বঙ্গবিজয়ের ঘটনা। শূন্যপূরাণে, দেব-দেবীগণের মুসলমানে রূপান্তরের উল্লেখ আছে। ইরান, ইরাক, তুরস্কে লালিত সুফী-তত্ত্বের বাণী নিয়ে যে সকল দিব্য পুরুষের আবির্ভাব ঘটল, এই জনপদে তাঁরা পেলেন সম্মান। তাঁদের পবিত্র করস্পর্শের ছায়াতলে এসে দাঁড়াল অন্ত্যজ শ্রেণীর মানুষেরা। পঞ্চদশ শতকেই পূর্ণ ধর্মীয় চেতনাপুষ্ট কৃত্যমূলক সাহিত্যের পাশে এল ইউসুফ জুলেখার প্রণয় পাঁচালি। বাঙলার সংস্কৃতিতে যোগ হল নতুন উপাদান।

একালে দেবদেবী পূজার সঙ্গে এলো মুসলমান পীরদের ‘সেবা’ রীতি। সত্যনারায়ণ আর সত্যপীর অভেদ রূপ নিলেন। হিন্দু মুসলমান সম্প্রদায় নির্বিশেষে সত্যপীরের পাঁচালি রচিত হলো।

পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকে মুসলমানদের একত্ববাদ ও ফানাফিলাহ তত্ত্বের প্রভাবে এল চৈতন্যদেবের কৃষ্ণতত্ত্ব। এর অন্য নাম অচিন্ত্য দ্বৈতাদ্বৈতবাদ। এ দর্শনের প্রভাবে বাঙলা নাট্যরীতি-কাব্য-পটচিত্র- এক কথায় সমগ্র শিল্পরীতি ও জীবনভেদে এল পরিবর্তন।

আলাউদ্দিন হুসেন শাহের আমলে এই জনপদের সমৃদ্ধি চূড়ান্তে পৌঁছেছিল। মুসলমান শাসনের ফলেই বাঙলা ভাষায় আরবী-ফারসী প্রভৃতি নানা শব্দের যোগ ঘটল। এ কথা সবারই জানা যে- মুসলমান সেনাপতি পরাগল খাঁ ও তদীয় পুত্র ছুটি খানের উৎসাহে যুদ্ধ কাব্য হিসাবে মহাভারতের অনুবাদ হয়েছিল। রামায়ণ- শ্রীকৃষ্ণবিজয় কাব্যও মুসলমান অধিপতিগণের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিল।

বাঙলা শতকে দৌলৎ কাজী-আলাওল প্রমুখ যুগন্ধর কবির হাতে অসাম্প্রদায়িক মুক্তমানবরসের কাব্য পালার জয়যাত্রা হলো শুরু।

সপ্তদশ অষ্টাদশ শতকে গাজীপীর পাঁচালিতে দেখা যায়- পীর গাজীর মাসী হচ্ছেন গঙ্গা- সে হিসাবে সর্পদেবী মনসা তাঁর ভগ্নী। মুকুট রায়ের কন্যার সঙ্গে পরীরা বদলে দিচ্ছে পালঙ্ক আর অঙ্গুরী। শাহাপরী (ইরানী ঐতিহ্য থেকে গৃহীত) গাজী-কালু পীরের নির্দেশে তৈরী করে দিচ্ছেন মসজিদ আর নগর।

সত্যপীরের পাঁচালি রচনা করেছেন তাহির মামুদ আর তার শিষ্য কৃষ্ণহরি দাস। কৃষ্ণরাম দাসের রায়মঙ্গলে দেখা যায় দক্ষিণ রায়ের সঙ্গে গাজীপীরের যুদ্ধে স্বয়ং ঈশ্বর যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয়ে দু’জনের মধ্যে বন্ধুত্ব স্থাপন করে দিচ্ছেন। আমাদের সংস্কৃতি তাই মুসলমান ও হিন্দুর এক উদার সম্মিলনের ফল।

এর সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর কথাও উল্লেখযোগ্য। চাকমা-মারমা-ব্যোম-সাঁওতাল-রাখাইন-গারো-হাজোংদের সংস্কৃতি এখন পর্যন্ত সম্প্রদায়গত সংস্কৃতিরূপে আপন অস্তিত্ব বজায় রাখলেও আধুনিক কালের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনিবার্য ফলস্বরূপ সে সকল বিচ্ছিন্ন সাংস্কৃতিক ধারাও একটি সাধারণীকৃত রূপলাভ করতে চলেছে।

চাকমাদের নৃত্যে- মারমাদের রূপকথা- সাঁওতালদের সৃষ্টিতত্ত্ব সংক্রান্ত নৃত্যগীত- গারোদের নৃত্যকলা ক্রমেই আধুনিক কালে বাংলাদেশে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-মারমাদের নিজস্ব রূপকথা অবলম্বনে রচিত নাটক একটি মারমা রূপকথায় নৃত্য ও সংগীত মারমাদের কাছ থেকে গৃহীত হয়েছে। মারমারা মূলত বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। এভাবে ইতিহাস ও সমকালের ধারায় বিচার করলে দেখা যায় গোষ্ঠী-সম্প্রদায়-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পূর্ণত অসাম্প্রদায়িক চেতনার উপর ভিত্তি করেই রচিত। বিশ্বমানবের মিলনক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষও যোগ দিতে চায়। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যে বিচিত্র সংস্কৃতির ধারাকে একটি গণতান্ত্রিক ঐক্যে সংহত করার প্রেরণা এদেশের অতীত ইতিহাস থেকেই লভ্য। সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামি- বিচ্ছিন্নতাবোধ বা উগ্র জাতীয়তাবাদ সংস্কৃতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এর ফল শুভ হয় না। এদেশের অতীত ইতিহাস একথা মনে করিয়ে দেয় যে- সূর্য-চন্দ্র ও নক্ষত্রখচিত একটি মাত্র আকাশের নিচেই আমাদের বাস। আমাদের দেশের সংস্কৃতি বিশ্ব সভ্যতারই অনিবার্য অংশ- এ কথা বিশ্বাস করি।

No comments

Powered by Blogger.