রম্যগল্প- পাত্রী চাই by সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

এবার ঈদের ছুটিটা লম্বা। বাড়িতে মা অসুস্থ। ফলে ছুটিটা আরেকটু বাড়িয়ে আগেভাগেই বাড়ির পথে একটা বাসে উঠে পড়ল কবির। দিনটা সুন্দর, কিন্তু বাসটা জঘন্য। কবিরের মতো কিছু যাত্রী ঈদের, তাঁরা সঙ্গে বেশ বাক্স-পেটরা নিয়ে উঠেছেন, কিন্তু সেগুলো ছাদের অনিশ্চয়তায় গছিয়ে না দিয়ে সঙ্গেই রেখেছেন।


এ জন্য একটা গাদাগাদি ভাব বাসটাতে। কবির একটা পত্রিকা কিনেছিল, কিন্তু সেটি মেলে ধরার মতো পরিসর নেই। সে মেজাজ খারাপ করে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকল। তাকিয়ে থাকতে থাকতেই সে টের পেল, পাশের যাত্রী ‘রোদ লাগছে’ বলে কবিরের পত্রিকাটা টেনে নিলেন এবং তার বিরক্ত বিস্মিত চোখের ওপর দিয়ে জানালাটা ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা শুরু করলেন।
কবির এবার চোখ বন্ধ করল। তার রাগ হচ্ছে, আরও ভালো বাস কেন খুঁজে নেয়নি এ জন্য নিজেকে গালমন্দ করার ইচ্ছাও হচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ তার মনে হলো, অনর্থক রাগ করে ঈদে বাড়ি যাওয়ার মতো আনন্দে কেন সে ছাই ঢালবে? তা ছাড়া এত আগে বাড়ি যাওয়ার আরেকটা যে কারণ, তা নিয়েও সে কেন ভাববে না? এবং সেই ভাবনায় যে আরও আনন্দ আছে, তার স্বাদটাই বা কেন নেবে না?
এই ভাবনাটার উৎপত্তি এক মাঝরাতে মায়ের একটা ফোন থেকে। ‘খোকা কি ঘুমাচ্ছিস?’ মা তার চিরাচরিত প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলেন। মা জানেন, কবিরের অফিসে প্রচুর কাজ। কিছুতেই নটা-দশটার আগে বাড়ি ফিরতে পারে না। এ জন্য রাতেই তাকে ফোন করতে হয়। কবিরের চিরাচরিত উত্তরও এ রকম, ‘ঘুমালে তোমার সঙ্গে কথা বলছি কেমন করে মা?’ কিন্তু এবার কবিরকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘তোর জন্য একটা মেয়ে দেখেছি। মেয়েটা সুন্দরী, মনটা খুব ভালো।’
‘হু’, কবির তার হঠাৎ জাগা বিস্ময় চেপে বলেছে, ‘পড়াশোনা?’
‘পড়াশোনাও ভালো। বিএ পাস।’
‘উচ্চতা?’ কবির জিজ্ঞেস করেছে।
‘উচ্চতা’? ‘তুই মাপিস বিয়ের পর,’ মা রাগ করে বলেছেন, ‘এরপর কি জিজ্ঞেস করবি, ওজন কত?’
কবির লজ্জা পেল। হঠাৎ কনে দেখার কথা শুনে কিছুটা অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। তার চোখের সামনে পত্রিকার ‘পাত্রী চাই’ বিজ্ঞাপন ভাসছিল।
‘আমি কথাবার্তা বলে রাখছি, তুই আয়, এলে বাকিটা নিয়ে এগোনো যাবে।’ মা বলেছেন এবং তাকে একটা আংটি কিনে নিয়ে যেতে বলেছেন, সোনার।
আংটিটা কিনতে কবিরের বোনাসের টাকার অনেকটাই চলে গেছে। এটি কেনার কোনো ইচ্ছা তার ছিল না। এই মুহূর্তে বিয়ে করার কোনো প্রস্তুতিও তার নেই। কিন্তু মা বলেছেন, তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। কবিরের একটা গতি করে যেতে পারলে তিনি নিশ্চিন্তে দুচোখ বুজতে পারবেন।
এই ‘গতি করাটা’ নিয়ে কবিরের আপত্তি আছে। বিয়েটা গতি নয়, দুর্গতি। এবং ক্ষতি। সে দেখেছে, বিয়ের পর প্রথম যে স্বাধীনতাটা যায়, তা বিছানার দুদিক থেকে নামার। এটি একটি বড় ক্ষতি। বাথরুমটা দখল হয়ে যায়, সেটি দ্বিতীয় ক্ষতি। অনেক কষ্টে বাড়িওলাকে মামা-চাচা ডেকে সে দুই কামরার একটা বাসা ভাড়া নিয়েছে, মুগদাপাড়ার হিজিবিজি অন্তঃপুরে। বাসাটা সে বেশ ভালোই সাজিয়েছে। এখন একটা বিয়ে করা মানে এই দুই কামরার ওপর থেকে তার কর্তৃত্ব চলে যাওয়া। এটি হবে তৃতীয় ক্ষতি। ক্ষতির এবং দুর্গতির তালিকাটা সে আরও লম্বা করত, কিন্তু বাসটা চলতে শুরু করেছে এবং পকেটে একটা হাত ঢুকিয়ে আংটির বাক্সটা ছুঁয়ে চোখ বন্ধ করে সে ভেবেছে, আর মাত্র পাঁচ ঘণ্টা। তারপর বাড়ি। বাড়ি মানে আনন্দ।
আধা ঘণ্টাও হয়নি, বাসটা থামল। পাশের যাত্রী, যিনি কবিরের পত্রিকাটা বাগিয়ে নিয়ে জানালায় লাগিয়েছিলেন, সেটি হাতে নিয়েই নেমে গেলেন। কবিরের উচিত ছিল পত্রিকাটা ফিরিয়ে নেওয়া, কিন্তু তাতে তার আনন্দে ভাটা পড়ত। সে চোখ বন্ধ করেই থাকল। কিন্তু বন্ধ চোখ খুলতে হলো। একটি মেয়ে তাকে বলছে, ‘একটু সরবেন? আমি বসব।’
মেয়েটিকে দেখে কবির চমকে উঠল। এ কি মেয়ে, না পরি! নায়িকা, না হুরি! বাসের সব যাত্রীর চোখ মেয়েটির দিকে। কিন্তু মেয়েটি কোনো দিকে তাকাচ্ছে না। সে কবিরের পা ঘেঁষে সিটে গিয়ে তার গা ঘেঁষে বসল। বসেই একটা সুন্দর হাসি দিল।
সেই হাসি কবিরকে যেন সিটশুদ্ধ উড়িয়ে নিল।
কবিরকে স্তম্ভিত করে মেয়েটিই কথা বলতে শুরু করল, ‘বাড়ি যাচ্ছেন?’
‘জি’, কবির বলল, ‘আপনি?’
‘বলতে পারেন’, সংক্ষিপ্তভাবে বলল মেয়েটি।
কবিরের কাছে পুরো ব্যাপারটা স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। এও কি সম্ভব? এ রকম অসম্ভব সুন্দরী একটি মেয়ে ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া এত অসংখ্য বাসের মধ্যে এই বাসটাকেই বেছে নিল এবং এই সকালেই এবং ঠিক তার পাশেই যে এসে বসল? এ তো পরিসংখ্যানের চিন্তাকেও হার মানায়।
মেয়েটি চুপ করে আছে কিন্তু মুখের হাসিটা মেলায়নি। অর্থাৎ কথা বললে সে আপত্তি করবে না। ‘আপনি কি পড়াশোনা করছেন?’ কবির জিজ্ঞেস করল।
‘এই বাসে বসে পড়াশোনা করব কীভাবে?’ মিষ্টি হেসে মেয়েটি বলল। ‘না মানে...’ বিব্রত কবির একটা ব্যাখ্যা শুরু করল।
‘বুঝেছি কী জানতে চাইছেন। আমি উচ্চশিক্ষিতা,’ মেয়েটি বলল, ‘ফার্মাসিতে অনার্স মাস্টার্স, ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট, প্রাচ্যের অক্সফোর্ড থেকে।’
‘বাহ’ কবিরের গলায় প্রশংসা ঝরে পড়ল।
‘আমি গানও গাইতে পারি। নতুন কুঁড়িতে আমার প্রথম আবির্ভাব। এখন আমি বিটিভিতে তালিকাভুক্ত।’
‘তাই নাকি!’ কবিরের প্রশংসা দ্বিগুণ হলো।
‘আমি খেলাধুলাও করি। আমি প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের ব্লুজদের একজন ছিলাম। এই দেখেন না, আমার সেই ব্লেজার।’
কবির খেয়াল করল, মেয়েটি তার শাড়ির ওপর একটা নীল ব্লেজার পরেছে, ব্লেজারটা তাকে খুব উজ্জ্বল করে তুলেছে।
‘আমি রান্নাও করতে পারি। মাধুর জাফরির মতো রান্না।’
‘মাধুর জাফরি?’ কবির জিজ্ঞেস করল।
‘অতি বিখ্যাত রন্ধনশিল্পী।’ মেয়েটি বলল, ‘আমার উচ্চতা পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি। রান্নাঘরে যখন গায়ে অ্যাপ্রোন চাপিয়ে রাঁধি, আমাকে দেখলে আপনি বেহুঁশ হয়ে যাবেন।’
কবিরের অবশ্য এখনই বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার কথা। ‘আপনি তাহলে ঘরকন্নায় খুব পটু।’
‘খুব সম্ভ্রান্ত হলেও ঘরের কাজ আমি নিজেই করি। আর পটু যে বললেন, আমি পটুয়াও। ছবি আঁকতে পারি। আমার ছবির প্রদর্শনী হয়েছে, প্রচুর ছবি বিক্রিও হয়েছে।’
‘বাহ!’ কবিরের প্রশংসা এখন আকাশ ফুঁড়ে উঠছে।
‘আমি খুব ফরসা। আমি এত দিনে লাক্স সুন্দরী হতে পারতাম, শুধু বাবা এসব পছন্দ করেন না বলে প্রতিযোগিতায় যাইনি।’
‘ও! ফরসা যে তা তো দেখতেই পাচ্ছি।’ কবির বলল, এবং মনে মনে যোগ করল, একেবারে দুধে আলতা রং!
কবিরের হাত এবার পকেট থেকে আংটিটি বের করে আনল। দামি আংটি। মেয়েটি বলল, ‘এই আংটি কার জন্য?’
‘মা একটি মেয়ে দেখে রেখেছেন, মেয়েটিকে পছন্দ হলে তার আঙুলে পরিয়ে দেব।’ সে কষ্টেসৃষ্টে বলল, কথাগুলো বলতে তার লজ্জা হচ্ছিল।
মেয়েটি হাসল, ‘আংটিটা চাইলে আমাকে পরাতে পারেন।’ কবির আকাশ থেকে পড়ল। আবার ভেতরে একটা ভীষণ পুলকও দাপাদাপি শুরু করল।
‘সত্যি?’ উচ্ছ্বসিত হয়ে সে বলল।
‘হ্যাঁ’। আমার এত যে গুণ, তা তো সব আপনার জন্য, আপনার চেহারাটা বাংলার পাঁচ অথবা প্যাঁচার মতো হলেও। আপনি তো মনে মনে সে রকম পাত্রীই খুঁজছেন—শিক্ষিতা, সম্ভ্রান্ত, পতিব্রতা, অবনতা, মার্জিতা ব্রীড়াবণতা...’
কবিরের অস্বস্তি হতে থাকল। সে গত দুদিনে মাকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে, পাত্রীটি পতিব্রতা হবে কি না, তার আচরণ মার্জিত কি না। অস্বস্তিতে পড়ার পাশাপাশি সে অবাকও হলো। মেয়েটি তার এই চিন্তাটি জানল কী করে!
‘দিন, আংটিটা আমাকে দিন।’ মেয়েটি বলল। কিন্তু কবিরের সংকোচ হচ্ছে। এভাবে, একটা বাসের ভেতরে, একটা অপরিচিতা মেয়ের আঙুলে সে কী করে আংটি পরিয়ে দেয়? অথচ মেয়েটিকে দেখে তার মনে হচ্ছে, এই মেয়েটির জন্যই তো সে পথ চেয়ে বসেছিল। এই মেয়েটির জন্য অনন্তকাল পথ চেয়ে বসে থাকা যায়। কিন্তু... তারপরও...
কবিরের হঠাৎ মনে হলো তার হাতটা যেন একটা মোচড় খেয়ে ভেঙে গেল। একই সঙ্গে অথবা মোচড় খাওয়ার একটু আগে—সে শুনল, মেয়েটি বলছে, ‘আমি জুডো-কারাতেও জানি। জুডোতে স্বর্ণপদক প্রাপ্ত। আংটিটা আমারই প্রাপ্য। দিন।’

২.
একটা চিৎকার করে কবির জাগল। তার হাত থেকে আংটির বাক্সটা কেড়ে নিতে মোচড় দিয়েছে একটা পুচকা মতো ছেলে। বাসটা থেমে ছিল। ছেলেটি উঠেছে এবং দেখেছে, হাতে আংটির বাক্স চেপে ধরে ঘুমাচ্ছে কবির। ছেলেটি অবশ্য পালাল। কবিরের পত্রিকা হাতিয়ে নেওয়া পাশের যাত্রী এসব জানিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আংটিটা বড় বেঁচে গেল। এটি কার জন্য?’
কার জন্য, তা কবির জানে না, কিন্তু কার জন্য নয়, তা সে এখন ভালোভাবেই জানে। সে শুধু বলল, ‘মা জানেন।’

No comments

Powered by Blogger.