ঈদস্মৃতি- মায়ের সঙ্গে ঈদ by সুলতানা কামাল

ছোটবেলায় ঈদের প্রস্তুতিটা আমাদের বাড়িতে শুরু হতো ২৭ রোজার দিন থেকেই প্রায়। সেদিন সকালবেলা আমাদের কাজ ছিল মেহেদি পাতা তোলা। আমাদের বাড়ির উঠানেই মেহেদিগাছ ছিল—পাড়ার অন্যরাও সেদিন মেহেদি পাতার জন্য আমাদের উঠানে ভিড় জমাত।


দুপুর থেকে মেহেদি বাটা এবং সন্ধ্যায় সেই মেহেদি হাতে লাগানো হবে, সেই উত্তেজনায় সময় গোনা। ২৭ রোজার দিনে আর একটা বড় কাজ হতো আমাদের বাড়িতে। তা হলো ঘরের পরদা, বিছানার চাদর, চেয়ারের কাভার—সব ধোয়ার কিংবা নতুন করে তৈরি করার পালা। এসব মা সুফিয়া কামাল নিজের হাতেই করতেন। সন্ধ্যায় ইফতার শেষে তাঁর প্রিয় সিঙ্গার মেশিনটি নিয়ে বসে যেতেন বারান্দার টেবিলে। আমরা দুই বোন, কখনো কখনো আমাদের ঠিক বড় ভাইটি, মায়ের কাছে ঘুরঘুর করা। কখন কাপড়টা একটু টান করে ধরতে হবে, কখন মেশিনের সুচে অথবা ববিনে সুতা পরিয়ে দিতে সাহায্য করতে হবে।
একই সঙ্গে তখন হয়তো চলছে আমাদের ঈদের জামায় ফুল তোলা বা বোতাম লাগানোর মতো শেষের দিকের কাজগুলো। মা নিজের হাতেই কাপড় কেটে, সেলাই করে, ফুল তুলে নকশা তুলে তা আমাদের জন্য তৈরি করতেন। সেখানেও হাতে হাতে মাকে সাহায্য করা। ২৭ থেকেই শুরু হতো উৎকণ্ঠা! ঈদ কি ২৯ রোজার শেষে হবে, না রোজা সেবার ৩০টিই হবে! ২৯ রোজার দিন শেষে ঘন ঘন চাঁদ দেখার চেষ্টা করা, রেডিওর ঘোষণা আর সাইরেনের শব্দের জন্য কান পেতে থাকা। আর মায়ের রান্নাঘরে ঈদের খাবার তৈরির নানা তৎপরতা। যেসব খাবার একটু আগেই তৈরি করে রাখা যায়, সেগুলো নিয়ে তো চিন্তা নেই। কিন্তু সেমাই, মাংস ইত্যাদি কি রান্নায় চড়ানো হবে আর কী হবে না, সে নিয়ে ভাবনা-চিন্তা, আলোচনা। বিশেষত এই কারণে যে তখন পর্যন্ত আমাদের বাড়িতে ফ্রিজ ছিল না। ঘরে ঘরে টেলিফোন নেই—আমরা দৌড়াদৌড়ি করে ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশীদের বাড়িতে খোঁজ নিচ্ছি ঈদের কোনো খবর পাওয়া গেল কি না!
পঞ্চাশের দশকের শেষের দিকে আর এক ব্যাপার! পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চাঁদ দেখার খবর আসবে! কখনো কখনো প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। তখন যোগাযোগব্যবস্থা এত সহজ হয়নি—খবর আসতে সময় লাগত। এর মধ্যে ঈদের পোশাক তৈরি করা শেষ করতে হবে। রান্নাবান্নার আয়োজন সারতে হবে।
বেশ কয়েকবার প্রায় মধ্যরাতে খবর পাওয়া গেল যে ঈদের চাঁদ দেখা গেছে। সেই রাতেই তারাবাগের দুই পুকুরের সংযুক্তি ঘটানো পুলের ওপর আমাদের ভাই-বোন আর প্রতিবেশী বন্ধুদের নাচানাচি, হইহল্লা। আর মা তার সহযোগীদের নিয়ে লেগে যেতেন রান্না করতে। সকাল হলেই নামাজ শেষে পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের সমাগম ঘটবে। এরই ফাঁকে ফাঁকে মা কবিতা লিখে চলেছেন নানা পত্রিকার অনুরোধে। বেগম পত্রিকায়, শুধু কবিতা না, মায়েদের ছবিসহ ঈদসংখ্যা প্রকাশিত হতো। সেই বড়দের ছোটদের ঈদসংখ্যা পাওয়ার লোভও আমাদের কম ছিল না। সুফিয়া কামালের বাড়িটি ছিল সবার জন্য উন্মুক্ত একটি বাড়ি। যাদের সঙ্গে বহুদিন দেখা নেই, যোগাযোগও নেই—তেমন আত্মীয়-বন্ধুরাও ঈদের দিনে মায়ের কাছে উপস্থিত হতেন। মা তাঁর স্বভাবসুলভ স্মিত হাসিটি বজায় রেখে সবাইকে আপ্যায়ন করে যেতেন। ভাইয়েরা নামাজ শেষে পাড়া ঘুরে বাড়িতে এসে সমবয়সীদের সঙ্গে হয় ক্যারম খেলা, নয়তো নানা ধরনের ক্লাসিকসের কমিক বই পাওয়া যেত সেসব নিয়ে আলোচনা আর নয়তো দলবেঁধে সিনেমা দেখতে যেত গুলিস্তান বা নাজ সিনেমা হলে। আমরা দুই বোন মায়ের সঙ্গে অতিথি আপ্যায়নে ব্যস্ত থাকতাম, তবে মাঝে সময় করে বেড়িয়েও আসতাম। আমাদেরও সমবয়সী বন্ধুরা আসত। সবচেয়ে আকাঙ্ক্ষিত অতিথি ছিলেন আমাদের বড় বোন, দুলাভাই আর তাঁদের ছেলেমেয়েরা—যারা প্রায় আমাদেরই সমবয়সী। এত অতিথি সজ্জনের মধ্যেও বড় বোন এসে গেলে যেন মায়ের মুখের হাসিটিও পরিপূর্ণতা পেত। ওরা আসা মাত্র আমরাও উঠানে এক্কাদোক্কা, গোল্লাছুট খেলতে লেগে যেতাম। বড় বোন মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে খেলায় যোগ দিলে আমাদের আনন্দ-উল্লাস আরও বেড়ে যেত। এর মাঝে হঠাৎ হঠাৎ দেখা মিলত বহুদিন আগে যারা কোনো একসময় আমাদের বাড়িতে মাকে সাহায্য করার কাজে ছিলেন তাঁরা, যাঁরা আমাদের কাছে পরিচিত ছিলেন অমুক কাকা অথবা মামা অথবা বুয়া বলে। মা তাঁদেরও একই আগ্রহে এবং যত্নের সঙ্গে আপ্যায়ন করে যেতেন। আর মায়ের প্রতিটি কাজ, রান্না হতে হবে নিখুঁত।
কত যে যত্ন করে, প্রচুর শ্রম দিয়ে মা শেষ করতেন এক একটি রান্না! জর্দা, সেমাই হতে হবে একদম ঝরঝরে। শির খুরমা বা দুধের সেমাইয়ে বাদাম-পেস্তা হতে হবে একেবারে আন্দাজমতো। মাংস এমন হতে হবে যে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে না, কিন্তু একটুও শক্ত থাকবে না। পোলাওয়ের ঘি পরিমাণমতো না হলে চলবে না—মাংস কয়েক রকম। সবকিছু মা নিজের হাতে, নিজের তদারকিতে সম্পন্ন করতেন। বাবা ছিলেন চুপচাপ মানুষ। কিন্তু তাঁর সহূদয় সমর্থনে সবকিছু স্বচ্ছন্দে হয়ে যেত।
ঈদের দিনটা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হতো বিকেলের চায়ের সঙ্গে। অতিথিরা সব চা খেয়ে একে একে বিদায় নিতেন। এর পরও সন্ধ্যা-রাতে অতিথি আসতেন বৈকি—যাঁরা দিনে সময় পাননি তাঁরা। এ ছাড়া পরদিন এবং তার পরের দিনও ঈদের রেশ থাকত। ছোটবেলায় আমরা ধরেই নিতাম ঈদ তিন দিন ধরে উদ্যাপন করা হয়। শুধু কি যাঁরা আসতেন তাঁরাই মায়ের আদর-আপ্যায়ন পেতেন? মোটেও তা না—যাঁরা সেই তিন দিন আসতে পারতেন না কিন্তু মায়ের কাছের জন, প্রিয়জন, মা তাঁদের জন্য ফ্রিজবিহীন সময়েও গরম করে করে খাবার সংরক্ষণের সেই সময়কার উপায় খাটিয়ে তাঁদের প্রিয় খাবারটা তুলে রাখতেন। তাঁদের কেউ কেউ হয়তো বাড়ি গেছেন ঈদ করতে। ফিরে এসেই দেখা করবেন—তাঁদের জন্য তাঁদের ভাগটুকু তোলা থাকত পরম যত্নে। তিনি তাঁর এই চর্চা অব্যাহত রেখেছেন আমৃত্যু এবং যখন নিজে সবকিছু করে উঠতে পারতেন না, সেই কাজটুকু আমাদের দিয়ে করিয়ে নিয়েছেন সর্বোচ্চ আন্তরিকতায়। আর যাঁদের জন্য কিছুই করতে পারতেন না—সুফিয়া কামালের হূদয় থেকে তাঁরা কখনোই অপসৃত হতেন না—তাঁর লেখায়, তাঁর বাণীতে তাঁদের জন্য শুভকামনা আর তাঁদের উৎসবের আনন্দে শামিল হতে না পারার দুঃখ ধ্বনিত হয়েছে বারবার। ঈদের উৎসব তাঁর কাছে ছিল সত্যিকার অর্থে সর্বজনীনতার সুযোগ, অধিকার। গভীর ধর্মবোধের মধ্যে সুফিয়া কামাল সদাসর্বদা ঈদ বলতে যেসব মানুষের কল্যাণকেই বুঝতেন, সবার মঙ্গল চাইতেন, তাঁর ঈদ পালনে প্রতিটি পদে তিনি তার পরিচয় দিয়ে গেছেন আমাদের।

No comments

Powered by Blogger.