গল্প- মজনু by শাহ্নাজ মুন্নী

আষাঢ়ের মলিন বিকাল। বৃষ্টি এই আসে, এই আসে ভাব। আলাউদ্দিন ডাক্তার বিশ্বরোডের পাশে, প্রতিদিনের মতোই, তার আরোগ্য নিকেতন নামের হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকানে ঝাঁপ খুলে বসে আছেন, রোগীর অপেক্ষায়, এই সময় সাধারণত সর্দিজ্বরের রোগী আসে।


তিনি দশ-বিশ টাকা যে যেমন দিতে পারে তেমন টাকা রেখে ওষুধের পুরিয়া দিয়ে দেন। তবে কেউ কেউ আছে এমনই হতদরিদ্র যে এই সামান্য টাকাটা দেওয়ারও ক্ষমতা নাই, যেমন ঋষিপাড়ার লোকগুলো, তাদের একটু বকাঝকা করেন আলাউদ্দিন,
‘আমি কি এখানে দাতব্য চিকিৎসাকেন্দ্র খুলে বসেছি? আরে আমার ভিজিট না হয় না-ই দিলি, নিদেনপক্ষে ওষুধের দামটা তো দিবি...’
তো ঋষিপাড়ার লোকগুলো তাদের কালো মুখের মধ্যে জোর করে সাদা দাঁতগুলো মেলে ধরে, হে হে, হে হে করে হাসার চেষ্টা করে আর বলে, ‘ডাক্তার বাবু তু আমাদের নারায়ণ আছিস, দেবতা আছিস, তু না দেখলে আমাদের কে দেখবে?’
আলাউদ্দিন তখন আর কিছু বলে না, গজগজ করতে করতে বিনা পয়সাতেই ওষুধ দিয়ে দেয়। আজকে ওই ঋষি-চামারদেরও দেখা নেই। দেশে কি রোগব্যাধি কমে গেল নাকি? আলাউদ্দিন হাই তোলে, তারপর হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর থেকে বহু জীর্ণ হোমিওপ্যাথি মেটেরিয়া মেডিকা বইটা তুলে নিয়ে পাতা উল্টায়। আর তখনই ঝুম করে বৃষ্টি নামে।
আষাঢ় মাস তো বৃষ্টিরই মাস। বৃষ্টি তার যাবতীয় লীলাখেলা আর রঙ্গরসিকতা দেখাতে শুরু করে এই মাসে, আলাউদ্দিন মেটেরিয়া মেডিকার পাতা থেকে চোখ সরিয়ে ভেজা রাস্তার দিকে তাকায় আর তখনই কয়েকজন লোক আকস্মিক বৃষ্টির ঝাপটা থেকে বাঁচতে দৌড়ে এসে তার দোকানে ঢোকে। লোকগুলোর পরনে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি, মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি, পায়ে কালো স্যান্ডেল, বৃষ্টি তাদের প্রায় অনেকখানিই ভিজিয়ে ফেলেছে।
‘ভাই একটু বইলাম, আপনের দোকানো...’
আলাউদ্দিনের টেবিলের সামনে রোগীদের জন্য পেতে রাখা বেঞ্চের ওপর বসে পড়ে লোকগুলো। আলাউদ্দিন এবার ভালো করে ওদের চেহারা দেখতে পায়। ওরা মোট চারজন, বয়স কারও বাইশ, কারও আবার ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে। তারা বৃষ্টির দিকে পেছন ফিরে বসে নিজেদের মধ্যে উত্তেজিত ভঙ্গিতে আলাপ করে, আলাউদ্দিন ওদের কথাবার্তা শুনে বুঝতে পারে, কিছুদিন আগে কাশিমপুরী পীর আর চরমোনাইয়ের পীরের সাগরেদদের মধ্যে যে বিরাট মারধর হয়ে গেল, তাই নিয়ে ওদের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। ওরা নিশ্চয়ই কোনো এক পীরের সাগরেদ হবে, আলাউদ্দিন আন্দাজ করে।
‘টেঁটাডা এক্কেরে খোকা মিয়ার গলাত্ গিয়া বিনছিল..’
‘আর ফারকের পেটে যে বল্লমটা ঢুকছে, এক দিক দিয়া ঢুইক্যা আরেক দিক দিয়া বাইর হইছে।’
একজন হুংকার দিয়ে ওঠে,
‘আরেকবার যদি সুযোগ পাই, একটারেও ছাড়তাম না। কত্ত বড় সাহস, আমরার পীরের মাছালার উপর দিয়া কথা কয় ..’
‘জিহ্বা টাইন্যা ছিঁড়া ফালামু...’ আরেকজন তাকে তাল দিয়ে বলে।
তাদের কথা হয়তো আরও চলত কিন্তু ঠিক এই সময় আলাউদ্দিনের দোকানে বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আরেকজন লোক এসে ঢোকে। এর চেহারা-সুরুত বেশ-ভূষা অন্যরকম। মাথায় লম্বা চুল, মুখে দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল, পরনে চটের ছালা, শীর্ণ দীর্ঘ শরীর, সে ভেতরে ঢুকেই জ্বলন্ত চোখে বেঞ্চি দখল করে বসে থাকা লোকগুলোকে গালাগাল শুরু করে,
‘বজ্জাতের দল, মূর্খের জাত, বেয়াকুফ, নালায়েক, নাফরমান, বেঈমান, কুচক্রীর গুষ্টি...’
আলাউদ্দিন ভাবল, খাইছে আমারে, এখনই না আবার আরেকটা টেঁটাযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়!
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার। উত্তেজিত লোকগুলো গালি খেয়েও কোনো উত্তর না দিয়ে বরং চুপ মেরে মাথা নিচু করে বসে রইল।
চটের ছালা পরিধানকারী আরও কিছুক্ষণ উচ্চস্বরে বিশ্রী সব গালাগাল করে যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ হন হন করে বেরিয়ে গেল।
আলাউদ্দিন এই দৃশ্য দেখে খানিকটা অবাক।
‘ভাইজান, আপনেরা কিছু কইলাইন না, পাগলে আপনেরারে এমুন গালিগালাজ করল!’
লোকগুলো এবার একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। তারপর বলে,
‘না, আসলে উনি একজন বিখ্যাত আলেম ছিলেন তো, তার মুখের উপর কথা বলা আমাদের শোভা পায় না।’
‘আলেম?’ আলাউদ্দিন অবাক হয়।
‘জি হ্যাঁ, বর্তমানে উনি মজনু দশায় আছেন, উনাকে বিরক্ত করা ঠিক হইত না।’
বৃষ্টি কমে আসায় লোকগুলো চলে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়।
‘মজনু দশা? ব্যাপারটা বুঝলাম না’, আলাউদ্দিন বলে।
‘আশেকের জন্য মাশুক যেমন পাগল, লাইলির জন্য মজনু যেমন পাগল, সৃষ্টিকর্তার প্রেমে ওই আলেম তেমন পাগল। এমন মজনু পাগলের কথার উত্তর দেওন ঠিক না।’
আলাউদ্দিন চমৎকৃত হয়। ছালা পরিধানকারীর সম্পর্কে তার মনে প্রবল কৌতূহল ও আগ্রহ জন্ম নেয়। কিন্তু সেদিনের পর থেকে আর কোথাও ওই লোকের দেখা পায় না আলাউদ্দিন। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে লোকটা। আষাঢ় যায়, শ্রাবণ যায়, ভাদ্র-আশ্বিন পেরিয়ে কার্তিকের এক সন্ধ্যায় মাইজপাড়ায় এক অসুস্থ মা ও তার নবজাতককে দেখে ফেরার সময় হঠাৎ আলাউদ্দিনের চোখে পড়ে, সড়ক থেকে একটু ভেতরে, গ্রামের এক পরিত্যক্ত ভাঙা বাড়ির বাঁধানো চত্বরে জঙ্গল আর হালকা কুয়াশার মধ্যে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে একাকী বসে আছে সেই ছালা পরিধানকারী, রহস্যময় মজনু, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে তার সামনে মোমের জ্বলন্ত শিখার দিকে, আশপাশ থেকে পতঙ্গরা উড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেই তীব্র অগ্নিশিখায়, পুড়ে যাচ্ছে নিমেষে। আলাউদ্দিন চুপি চুপি এসে মজনুর সামনে বসলেও তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ঘটে না।
আলাউদ্দিন একবার খুক করে কেশে তার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে।
‘কী চাস?’ ছালা পরিধানকারী আগুনের দিকে তাকিয়েই বলে।
‘আপনের এই হাল কেন হইল, কীভাবে হইল জানতে চাই। আপনে এই বেশ কেন ধরছেন?’ আলাউদ্দিন এক নিঃশ্বাসে তিনটা প্রশ্ন করে।
এইবার ছালা পরিধানকারী মজনু মাথা দুলিয়ে নিঃশব্দে খানিকক্ষণ হাসে। তারপর বলে, ‘আরে বোকা, এইসব তো ভেক। আমি ভেক ধরছি, চারদিকে আবর্জনা তো, ভেক না ধরলে চলে না।’ লোকটা নিঃশব্দে হাসতেই থাকে।
আলাউদ্দিন খানিকটা হতাশ বোধ করে থমকে যায়। লোকটা এবার বলে, ‘মন খারাপ করলি কেন? ভেক ধরা খারাপ না, এতে মনের মুক্তি আসে, নিজের ভেতরে চন্দ্র-সূর্য উদিত হয়, হূদয় জাগ্রত হয়।’
আলাউদ্দিনের কেন যেন হঠাৎ মনে হয় এই লোকটার সঙ্গ তাকে এক নতুন ও অজানা যাত্রায় প্রবেশের সুযোগ করে দেবে, সে আলোকপ্রাপ্ত হবে। আলাউদ্দিন আকুল হয়ে বলে, ‘আমি আপনের সাথে যাইতে চাই।’
মোমবাতিটা ততক্ষণে জ্বলে জ্বলে প্রায় নিঃশেষ হয়ে এসেছিল, উত্তুরে বাতাসের এক ঝাপটায় তা এবার পুরোপুরি নিভে যায়। মৃদু আলোকময় জায়গাটি এক্ষণে অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
‘যাবি? তবে চল।’
অন্ধকারে ছালা পরিধানকারীর ভরাট গলা শোনা যায়। বোঝা যায় সে উঠে দাঁড়িয়েছে। হঠাৎ কী হয়, যেন ঘুম ভেঙে সজাগ হয়ে ওঠে আলাউদ্দিন, তার গলা কেঁপে ওঠে,
‘এ-এক্ষুনি যাওন লাগব?’
অন্ধকারে কারও হাসির শব্দ ভেসে আসে।
‘এই পথ তোর না, তুই গৃহী, গৃহেই থাক। নিজের মধ্যে নিজের আশ্রয় নির্মাণ করে নে।’
অন্ধকারে আলাউদ্দিন দীর্ঘ পা ফেলে লোকটার চলে যাওয়ার শব্দ শুনতে পায়।

No comments

Powered by Blogger.