‘ইফতারের সময় হয়েছে সবাই আসেন’

রিয়াজউদ্দিন বাজারের ঝুমুর শাড়িঘর। দোকানে তাকে তাকে সাজানো শাড়ি দেখছেন ক্রেতারা। বিক্রয়কর্মীরাও শাড়ি মেলে ধরছেন ক্রেতাদের কাছে। বিক্রয়কর্মীদের কেউ কেউ কাগজ বিছিয়ে ইফতারি সাজাতে ব্যস্ত। হঠাৎ সাইরেন বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিক্রয়কর্মীদের ডাক, ‘ইফতারর সময় অইয়্যে, আপা, অ ভাই, অনেরা বেগগওন আইয়্যন।’


(ইফতারের সময় হয়েছে, আপা, ভাই, আপনারা সবাই আসেন) একটু ইতস্তত করলেও ক্রেতারা হাতের মুঠোয় তুলে নিলেন ছোলা-মুড়ি-পেঁয়াজু মেশানো ইফতারি। চারদিকে চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দ কমে আসছে। কোলাহলময় রিয়াজউদ্দিন বাজার থেকে এখন ইফতারি খাওয়ার হালকা শব্দ ও মৃদুমন্দ কথার আওয়াজ ভেসে আসছে।
ঝুমুর শাড়িঘরের মতো এই বাজারের অনেক দোকানেই এমন চিত্র দেখা গেল। কিছুক্ষণ আগেও বিক্রয়কর্মীরা যেখানে শাড়ি বিক্রির জন্য নানা রকম বিশেষণে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করেছিলেন, এখন সেই ক্রেতাদের ইফতারি খাওয়াতে নানাভাবে চেষ্টা করছেন তাঁরা। ঝুমুর শাড়িবিতানের মালিক শাহ আলম বললেন, ‘খুচরা ক্রেতারা ইফতারের আগেই কেনাকাটা শেষ করতে চান। আবার তারাবির নামাজের পর আসেন কেনাকাটা করতে। ফলে ইফতারের আগ মুহূর্তে অনেক ক্রেতা থাকলেও খুব কমই দোকানে ইফতার করেন। তবে পাইকারি ক্রেতারা আমাদের সঙ্গে ইফতার করেন নিয়মিত। কারণ, তাঁরা বলতে গেলে আমাদের পরিবারেরই অংশ। তাঁরা শহর ও বিভিন্ন জেলা থেকে আসেন।’
গতকাল ইফতারের সময় দেখা গেছে, রিয়াজউদ্দিন বাজারে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক আবহ তৈরি হয়েছে। নিজের দোকানে খাওয়ানোর জন্য পাশের দোকানের ক্রেতা-বিক্রেতাদের ডাকাডাকিও হয় এখানে। যেন চট্টগ্রাম এলাকার মানুষের অতিথিপরায়ণতার বৈশিষ্ট্য আঁকড়ে ধরছেন তাঁরা। আর দশটি দোকানের মতো লাইন ধরে বসে ইফতারের প্রস্তুতি নেওয়া, অতিপরিচিত পদ দিয়ে ইফতার করা এখানে নিয়মিতই হয়। তবে নগরের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ দোকান থেকে বিশেষ বিশেষ পদ এনে ইফতারিতে প্রতিদিন চমক দেখানোর চলও আছে। রিয়াজউদ্দিন বাজারের তামাকুমন্ডি লেন এলাকার আমিন স্টোরের স্বত্বাধিকারী মুহাম্মদ নুরুল আমিন বলেন, ‘যখনই দোকানে ইফতার করি, তখনই আমার অন্তত রয়েল বেকারির হালিম ও চিকন জিলাপি চাই। বিহারির দোকান রয়েলের হালিম ও জিলাপি বিখ্যাত, খেতেও আলাদা স্বাদ। কেউ কেউ আবার মালঞ্চ থেকে মোটা জিলাপিও নিয়ে আসেন। এ ছাড়া চট্টগ্রামে ইদানীং ভারতীয় খাদ্যের কিছু পদও পাওয়া যাচ্ছে। এর বাইরে বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে আসে হরেক রকমের পিঠাপুলি ও নিত্যনতুন পদের খাবার। দেখা যায়, দোকানে লোক যত, তার চেয়ে বেশি আয়োজন। ক্রেতারা যাতে ইফতারে অংশ নেন, সেই প্রস্তুতি রাখা হয় বেশির ভাগ দোকানে।
প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার ছোট-বড় দোকান নিয়ে রিয়াজউদ্দিন বাজার। দোকানদারদের মতে, এ বছর রোজা শুরু হতে না-হতেই লোকজন বাজারে আসা শুরু করেছেন। ফলে রোজার শুরু থেকেই ব্যস্ত দিন কাটছে বিক্রেতাদের। দোকানদারেরা জানান, রিয়াজউদ্দিন বাজারে দুই ধরনের ক্রেতা আসেন রমজান মাসে। তাঁরা হলেন খুচরা ও পাইকারি ক্রেতা। একাধিক দোকানের বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সাধারণ ক্রেতারা ইফতারের আগেই কেনাকাটা শেষ করে চলে যেতে চান। নিতান্ত উপায়ান্তর না দেখলে ক্রেতারা যে দোকানে কেনাকাটা করেন, সেই দোকানেই ইফতার করতে বসে যান। এ ক্ষেত্রে ক্রেতার চেয়ে বিক্রেতারাই বেশি আগ্রহ দেখান, যাতে ক্রেতা তাঁর দোকানে অন্তত ইফতারটা করেন।
মোবাইল ফোনের দোকানদার মোহাম্মদ সেলিম বলেন, দোকানের ইফতার এখন প্রতিদিন খেজুর আর ছোলায় সীমাবদ্ধ থাকে না। মাঝে মাঝে বাজার থেকে মেজবানের মাংসও চলে আসে। মেজবানের মাংস কোথায় পাওয়া যায়? এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেজবানের আদলে ও স্বাদে এসব মাংস বাড়িতে রান্না করে বিক্রি করা হয় নির্দিষ্ট জায়গায়। ইফতার শুরুর আগেই শেষ হয়ে যায়। ওখান থেকেই মাংস আর পাশের কোনো দোকান থেকে আসে পরোটা। খুব উপাদেয় হয়।

No comments

Powered by Blogger.