বহে কাল নিরবধি-কার মনস্তুষ্টির জন্য রাষ্ট্র : অন্নহীন না এলিট? by এম্ আবদুল হাফিজ

মুকুট শোভিত মস্তকেই বিরাজ করে রাজ্যের যত অশান্তি। বহুল প্রচলিত ইংরেজি আপ্তবাক্য 'Uneasy lies the head that wears crown'-এর ভাবার্থ কতকটা এ রকমই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তো অনেক কিছু করা সম্পর্কে এক শ ভাগ আন্তরিক। তিনি দেশের ভাবমূর্তি নির্মাণ করতে ও সমুন্নত রাখতে বহুমুখী পদক্ষেপ নিয়েছেন।


পারিবারিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সংগতি রেখেই তিনি তো আর তুচ্ছ পার্থিব কোনো কিছুর পেছনে ছুটতে পারেন না। তাই তাঁর প্রজেক্ট হতে হবে এমন কিছু, যা তাঁকে ইতিহাসে স্থান করে দেবে। প্রথমবারের মতো এ দেশে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের মতো প্রজেক্ট, এমনটা তাঁর কর্মকাণ্ডের নমুনা। আগের মেয়াদে তিনিই প্রথমবারের মতো একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশে এনেছিলেন। তবু কেমন একটা কিন্তু থেকেই যায়। দেশের যা অবস্থা তা সত্ত্বেও দেশবাসী উৎসবের মেজাজে।
তবু কেন যেন পুরো জাতি একটা অস্বস্তিতে। রাবিশ-তা কেন হবে? এত নিখুঁতভাবে প্রস্তুতি, যাতে দেশের ইমেজ শনৈঃ শনৈঃ বৃদ্ধি পাবে। ইতিমধ্যে ভিখিরিদের ঝেঁটিয়ে দৃষ্টিসীমার বাইরে পাঠানো হয়েছে, যেন ওরা এ দেশের কোনো নাগরিকই নয়। নগরকেন্দ্র থেকে বহির্মুখী রাস্তার ২০ মাইল পর্যন্ত কোনো দোকানপাট বসবে না। ভালো কথা, বসবে না। কয়েক দিন আগে এই খেলা-সম্পৃক্ত ইমেজ প্রশ্নে বিরোধী দলের সঙ্গে প্রচুর বাগ্বিতণ্ডা হয়েছে। পরিণতিতে বিরোধী দল হরতাল করেছে, কিন্তু সরকার তাদের রাস্তায় দাঁড়াতেই দেয়নি। টিট ফর ট্যাট।
দেশীয় এবং কানাডা ক্রিকেট দলের কিছু খেলোয়াড়, কোচ ও অফিশিয়াল চট্টগ্রামে গিয়েছিল। ফিরতি পথে আরেক ইমেজ (?) সমস্যা। ১৫৭ জন ক্রিকেটযাত্রী যখন বিমানে আসন গ্রহণ করেছেন, যান্ত্রিক ত্রুটির অজুহাতে তাদের বিমান থেকে নামিয়ে আনা হয়। পরবর্তী সময়ে ত্রুটি দূর করার পরও ওই যাত্রীদের কিছু অংশ আর কিছুতেই ওই বিমানে আরোহণ করতে রাজি হননি। তাঁরা অন্য বিমানে ঢাকায় আসেন। স্যরি প্রধানমন্ত্রী। নগরজুড়ে ঝাড়পোছ, ভিখিরি বিতাড়ন, সৌন্দর্যবর্ধনের সব কর্মসূচি সত্ত্বেও বিমানটি মানবিক সীমাবদ্ধতার (ঐঁসধহ ঊৎৎড়ৎ) ওই অবস্থায়ই ঢাকার পথে উড়াল দিত? ভাবতেও শিউরে উঠতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী, আপনি তো অনেক কিছু করে আমাদের মুখ উজ্জ্বল করতে চান! কিন্তু আমরা যে তার যোগ্য নই। বেশ কিছুদিন আগে 'সমকালে' একটি নাতিদীর্ঘ নিবন্ধ লিখেছিলাম-'গরুর গাড়ির হেডলাইট হয় না'। আমাদের এই জরাজীর্ণ অবকাঠামোর দেশে ততোধিক অযোগ্য ও দায়িত্বহীন ব্যক্তিরা, যাঁরা আপনার স্বপ্নপূরণের কুশীলব, তাদের নিয়ে তো এত বড় প্রকল্পে আপনি প্রকৃতপক্ষে দেশকে আরো ঝুঁকির মধ্যে ফেলছেন। সংশ্লিষ্ট বিমানের পাইলট বা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তিরা 'ওভার হিটেড ব্রেক'-এর সমস্যা নিয়ে কতগুলো যাত্রীকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। এ ত্রুটি শনাক্ত করা অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর কাজ নয়, কিন্তু তাঁর প্রশাসনের মাধ্যমে যন্ত্রটির কার্যকারিতা নিশ্চিত করা তো সর্বোচ্চ লেভেলেই হতে হয়।
আমাদের সব সরকারই ইমেজ নিয়ে অনেক হৈ-হল্লা করলেও দেশের ইমেজ তার নিজস্ব জায়গায়ই আছে। ইমেজ বাড়েওনি, কমেওনি। আফটারঅল কে না জানে বাংলাদেশ সব কিছু মিলিয়ে আসলে কী। ভিখিরি রাস্তা থেকে তাড়ালাম, তার পরও শহরের বিভিন্ন স্পটে ওএমএসের সস্তা চাল সংগ্রহের ক্রমবর্ধমান লাইনকে কোনো আবরণে ঢেকে দেওয়া যাবে না। শহরের বর্জ্য, আবর্জনা, খানাখন্দ, রাস্তার বেহাল অবস্থা কী দিয়ে ঢাকা যাবে? কিভাবে অন্তরালবর্তী করা যাবে নিম্নবিত্ত, হতদরিদ্র (ভিখিরি নয়) বা আমাদের মতো নিম্নমধ্যবিত্ত পেনশনারদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার চালচিত্র?
আমরা টেলিভিশনের পর্দায় তাহরির স্কয়ারের বিক্ষোভ দেখেছি। যেকোনো বহিরাগত তো এ দেশে টেলিভিশনের পর্দা ছাড়াও কোনো কার্যকারণে মতিঝিলমুখী হলেই একই প্রকার সহিংস বিক্ষোভ দেখতে পারবে। যেকোনো দেশ থেকেই বহিরাগত ব্যক্তিটির এ দেশে আগমন ঘটে থাকুক না কেন, তার দেশের তো একটা দূতাবাস আমাদের রাজধানীতে আছে তাকে এখানকার হাল-হকিকত সম্বন্ধে একটি প্রাথমিক ধারণা দেওয়ার জন্য। তা ছাড়া ব্যক্তিটি নিজেও তো কোনো অবুঝ নাবালক নয়। আমরা কী প্রকারে কার কাছে কী ঢাকতে চেষ্টা করছি?
দেশ দ্রুত যে দেউলিয়াত্বের দিকে অগ্রসর হচ্ছে তাতে কি আর কর্তাব্যক্তিদের ইমেজ নিয়ে ভাববার অবকাশ থাকবে? ৫৬ হাজার বর্গমাইলের পরিসরে ঠাসাঠাসি করে বাস করা ১৬ কোটি মানুষের ক্ষুধার অন্ন জোটাতে পারলেই সরকারের জন্য মহাসাফল্য। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি শুধু সেটুকু নিশ্চিত করলেই লোকে শোকর করবে। তাদের মেগাবিনোদনের প্রয়োজন নেই। ওসব একটি বিশেষ শ্রেণীর জন্য। এ দেশের গণমানুষ আপনার ওপর আস্থা স্থাপন করে শুধু দুমুঠো ভাতের নিশ্চয়তা লাভের আশায় আপনাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে।
আপনাকে ভুললে চলবে না যে আপনার শাসনের দুই বছরেও তাদের সেই সামান্য আশাটি পূর্ণ হয়নি। সদ্য গৃহীত পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে জরুরি আট সিদ্ধান্তেও অভিনব কিছু নেই। আপনি একবার বললেন, লোকের উপার্জন বেড়েছে, গ্রামগঞ্জে আর আগের মতো হাহাকার নেই। আপনার পর্যবেক্ষণের সত্যতা নাকচ করার ধৃষ্টতা আমার নেই, তবে শুধু মনে হয় আপনার পর্যবেক্ষণে কিছুটা সহজীকরণ আছে এবং সেটা থাকবেই। কেননা আপনার ভুবন আলাদা এবং সেখান থেকে পর্যবেক্ষণে পিজম্যাটিক কালারস-এর ব্যাপার আছে।
সে যা-ই হোক, আমাদের মতো সাধারণ মানুষকে মাঝেমধ্যে কিছুটা সস্তা দামে ক্রয়ের আশায় নোংরা বাজার বা পাঁকে ডোবা দোকানপাটে যেতে হয়। আমরা 'সেইনস্বারি' বা 'সেফওয়ে' কোথায় পাব? সাধারণ্যের সঙ্গে বাজার করার অভিজ্ঞতাই আলাদা। কিন্তু যে আশায় যাওয়-তা পূরণ হয় না। কিন্তু অনেক বিচিত্র মানুষের সমাগমে অভিজ্ঞতার ঝুলি পূর্ণ করার অনেক সুযোগ সেখানে। আর গ্রামবাংলার হাহাকার? আপনি সেখানে পেঁৗছাতেই পারবেন না। তার জন্য একটি বিশেষ মিথস্ক্রিয়ার প্রয়োজন, যার সীমানা আপনি অনেক আগেই অতিক্রম করে গেছেন।
প্রধানমন্ত্রী, শুধু এটুকুই বলতে পারি, আমাদের 'অহংকারের' এই দেশটি কিন্তু অনেক দুঃখী মানুষের দেশ। এ দেশে শুধু প্রথাগত শাসন দিয়ে কোনো ইতিবাচক রূপান্তর ঘটানো যাবে না। যাবে না দিনবদলের কোনো সূত্রপাত করা একটি ব্যাপক বিশাল সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ছাড়া। কিন্তু আপনার এলিটরা তা অগ্রাহ্য করব-এ জন্য যে যারা শুধু গ্রহণ করতেই অভ্যস্ত, তারা কিছু দিতে প্রস্তুত হবে না। এমনিতে যেমন গত দুই বছর বেশ কিছু ভাল কাজ করেছেন (কিছু বাহ্বাও পেয়েছেন), সেভাবে আরো কিছু সময় চালাতে পারবেন। কিন্তু তা তো আপনাকে শোভা পাবে না। সৌভাগ্য হোক বা দুর্ভাগ্য, আপনি যে বঙ্গবন্ধুর কন্যা।
আমি রাজনীতির কোনো তাত্তি্বক নই-নই কোনো রহস্যপুরুষ। জানি না বঙ্গবন্ধুর দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্য কী হয়ে থাকতে পারে। তবে এটুকু বুঝি, গতানুগতিকতায় বাংলাদেশের দুর্ভেদ্য জটিল সমস্যার কোনো সমাধান নেই। সমাধান নেই আমাদেরই তৈরি একঝাঁক এলিটের মনোরঞ্জনে সব শক্তির অপচয়। বিশ্বকাপ ক্রিকেট, গজলসন্ধ্যা, ওড়িশা নৃত্যের মুদ্রা কি আমাদের একমাত্র যন্ত্রণাদায়ক ক্ষতের রক্তক্ষরণে কোন উপশম? এই ক্ষত হলো আমাদের দারিদ-যার জন্মই দুর্নীতি এবং বৈষম্য থেকে। আমরা এ ক্ষতের দায়সারা চিকিৎসা কম করিনি, কিন্তু তাতে এ ক্ষত আরো গভীরই হয়েছে।
স্বীকার করি, বিশ্ববাজারই আক্রা, মুনাফাখোর ও মজুদদারদের উৎপাত তো আছেই। কিন্তু অভ্যাসগত অপচয় এবং বৈষম্যের কারণে অপচয় দেশের ৫০ শতাংশ মানুষ, যারা দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে (অর্থাৎ প্রায় আট কোটি মানুষ), তাদের কিভাবে প্রবঞ্চনার ফাঁদে ঠেলে দেয় আমরা তা উপলব্ধিই করি না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধজনিত অপচয়ে ব্রিটেন হঠাৎই দরিদ্র হয়ে যায়। সারা ব্রিটেনে তখন সব নিত্যপ্রয়োজনীয় উপকরণের রেশনিং প্রথা। একটি প্রকট খাদ্যাভাব শুধু ব্রিটেনে নয়, ইউরোপের অন্যান্য দেশেও ছড়িয়ে পড়ে। তা এতটাই ভয়াবহ ছিল, অনেক ব্রিটন এবং জর্মন তখন শুধু পেটপুরে খাওয়ার তাগিদে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী হয়েছিল। ১৯৮০ সালে অস্ট্রেলিয়া সফরের সময় খোদ ওই অভিবাসীদের কাছে এসব গল্প শুনেছি।
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে এই যে ভয়াবহ খাদ্যাভাব, বিশেষ করে সহনীয় মূল্যে জীবনযাপনের এই যে কাঠিন্য, তা সত্ত্বেও আমাদের কর্তাব্যক্তিরা এবং আমাদের নব্য ধনিক শ্রেণীর মধ্যে বিন্দুমাত্র কৃচ্ছ্র দেখিনি-অন্তত বঞ্চিতদের প্রতি সহানুভূতির খাতিরে। এরা বিবিসিতে দেশ-দেশান্তরের, বিশেষ করে আরব বিশ্বের ফুড রায়ট দর্শন উপভোগ করে এবং সেসব নিয়ে পণ্ডিতসুলভ মন্তব্যও করে, কিন্তু তবুও দেশেরই হতদরিদ্রের সঙ্গে তাদের প্রাচুর্য ভাগাভাগি করতে প্রস্তুত নয়। শুনেছি, আমাদের দেশে চুয়াত্তর সালের দুর্ভিক্ষ নাকি ভালো ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এড়ানো যেত। এ নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। কিন্তু আমাদের সামনে এ মুহূর্তে দেশের যে প্রধান সংকট তা নিঃসন্দেহে আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য, বিশেষ করে চাল-ডাল-চিনি ও ভোজ্য তেলের মহার্ঘতা। আমরা পাঁচজনের একটি সংসার যখন পরিচালনা করি, সেখানে হঠাৎ তিনজন অতিথির আগমন কোনো সমস্যার সৃষ্টি করে না। তদ্রূপ ১৬ কোটি মানুষের সংসারে একটি সুষম মানবিক বণ্টনের মাধ্যমে কতজনকে পোষণ করা যাবে জানি না, তবে যৌথ কষ্টের অনেক লাঘব হতে পারে।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক
বিআইআইএসএস ও কলামিস্ট

No comments

Powered by Blogger.