বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা কোন পদ্ধতিতে হওয়া উচিত by ড. নিয়াজ আহমেদ

সম্প্রতি প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস আমাদের সবার মনে সুন্দর আগামীর আশার সঞ্চার করে। কিন্তু পরক্ষণে চিন্তার খোরাক জোগায় বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাসকে আমরা ধরে রাখতে পারব কি না। এদের সবার জন্য মানসম্মত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগ আমাদের রয়েছে কি না।


উচ্চশিক্ষার দ্বার কণ্টকময়, এমনটি বলা ঠিক হবে না; কিন্তু মানসম্মত উচ্চশিক্ষার সুযোগ সীমিত- এমনটি বলা ভুল নয়। আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন শাখায় বিচরণ এবং সে মোতাবেক পরিধি বাড়ানো আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকে ঝোঁক-প্রবণতা যত বেশি হবে, জ্ঞানের পরিধি ও প্রসারে আমাদের অগ্রসরতা ততটা উজ্জ্বল হবে। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য সামনে না রেখে উচ্চশিক্ষার প্রসার ঘটানো কার্যত বেশি আশার বাণী শোনাতে পারবে কি না সন্দেহ। আমাদের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এ দিকটিকে গুরুত্ব দিচ্ছে বটে; কিন্তু প্রয়োজনীয় আর্থিক সহায়তা ও অভিজ্ঞ শিক্ষকমণ্ডলীর অপ্রতুলতার জন্য ব্যাপক সাফল্য দেখতে পারছে না।
সরকারি পক্ষ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল প্রকাশের পর বলা হয়, সব শিক্ষার্থীই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে। এমনকি আসন শূন্য পর্যন্ত থাকবে। আমি এ তথ্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করছি না। আমার দ্বিমত পোষণের জায়গা মানসম্মত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগের বিষয়ে। মানসম্মত উচ্চশিক্ষা গ্রহণের সুযোগকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার কারণ হলো, এর মাধ্যমে আমাদের উন্নতির দিকে যাওয়ার পথটি মসৃণ হয়। অন্যথায় উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে তার প্রয়োগ করতে না পারার ব্যর্থতায় নিজের মধ্যে ক্ষতের জন্ম দেয়, হতাশা কাজ করে। আমাদের দেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও সরকারি ও বেসরকারি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স চালু রয়েছে। মূলত কলা, সামাজিক বিজ্ঞান ও ভৌতবিজ্ঞানের বিষয়গুলো এখানে পাঠদান করানো হয়ে থাকে। এখানে ফলিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার সুযোগ নেই বললেই চলে। পর্যাপ্ত অবকাঠামো না থাকা সত্ত্বেও সরকারি ও বেসরকারি কলেজে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে প্রতিটি বিষয়ে প্রচুর শিক্ষার্থী ভর্তি করানো হয়। আর এভাবে আমরা বলছি, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সুযোগের কোনো অভাব নেই। কখনো লক্ষ করি না, শিক্ষাটি মানসম্মত কি না বা এর প্রয়োগ কতটুকু ইত্যাদি। একটি বেসরকারি কলেজে যেখানে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি প্রদান করা হয়, সেখানে প্রতিটি বিষয়ে কতজন শিক্ষক রয়েছেন, প্রতিদিন কয়টি ক্লাস হয়, লাইব্রেরিতে পর্যাপ্ত বইয়ের ব্যবস্থা রয়েছে কি না, শিক্ষকদের উচ্চতর ডিগ্রি রয়েছে কি না ইত্যাদি বিষয় আমরা বিবেচনা করি না। পাশাপাশি কোন প্রক্রিয়ায় কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে অন্য সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে, তা-ও বিবেচনায় আনা হয় না। আমরা এগুলো বিবেচনায় আনতে পারছি না বিধায় উচ্চশিক্ষার পথ খোলা রয়েছে কিংবা কখনো কখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ছাত্রছাত্রীও পাওয়া যায় না; কিন্তু মানসম্মত শিক্ষার জন্য নিজের পছন্দমতো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির মানসে সদ্য পাস করা ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে এক ধরনের হাহাকার কাজ করে। বিষয়টি অস্বাভাবিক নয়। বিশেষায়িত এ যুগে নিজেকে উপযুক্ত আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে এমন করাটা সঠিক। ফলে মোটা দাগে বলা যায়, কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে কিংবা কলেজে ভর্তির জন্য লম্বা লাইন, আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে আসন শূন্য। ছাত্রছাত্রী ভর্তির জন্য টেলিভিশনে আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন কিংবা পত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের ছাড়সহ বিজ্ঞাপন; আবার কখনো বা ছাত্রছাত্রী ভর্তি মেলার আয়োজন করা হয়। লক্ষ্য একটাই- আর তা হলো যেনতেনভাবে উচ্চশিক্ষা দিয়ে শিক্ষার্থীদের বের করে দেওয়া।
ভর্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ হওয়া রীতিমতো যুদ্ধে জয়লাভ করার শামিল। আর কিছুদিন পর পরই সদ্য উচ্চ মাধ্যমিক পাস করা ছাত্রছাত্রীরা এ যুদ্ধে অংশ নেবে। এরই মধ্যে দু-একটি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের নিজস্ব এখতিয়ারে ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করেছে। বর্তমানে আমাদের দেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৩৪। এ ছাড়া রয়েছে মেডিক্যাল কলেজসহ অন্যান্য উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। একটি ভালো বিষয়ে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের একটি থেকে অন্যটিতে ছুটতে হয়। কোনো একটি বাদ দিলে পছন্দের বিষয়টি পাওয়া দুরূহ হয়ে যায়। এ জন্য শিক্ষার্থীদের একদিকে যেমন হয়রানি বাড়ে, অন্যদিকে তারা প্রচুর আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বর্তমানে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ভর্তি পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন পদ্ধতি চালু থাকলেও হয়রানি বন্ধ হচ্ছে না। অধিকন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া পুরোপুরি সম্পন্ন হওয়ার পর আসন খালি থেকে যায়। আসন খালির ক্ষেত্রে ভালো ভালো বিষয়ও বাদ পড়ছে না। যেহেতু বর্তমানে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিস্টার পদ্ধতি চালু রয়েছে, সেহেতু ক্লাস শুরুর পর ভর্তি বাতিল হওয়া আসনগুলোতে শিক্ষার্থী ভর্তি করানো সম্ভব হয় না। এসব সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য সরকারি পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করার একটি দাবি কয়েক বছর ধরে উচ্চারিত হয়ে আসছে। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের অভাব এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসিত হওয়ায় কেন্দ্রীয়ভাবে ভর্তি গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য সবাই আন্তরিক হলে এ ক্ষেত্রে আমরা সামনের দিকে যেতে পারি।
বর্তমানে আমাদের দেশে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রযুক্তি ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেশি হওয়ায় একই দিনে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করতে হচ্ছে। ফলে ছাত্রছাত্রীরা কোনটিতে অংশগ্রহণ করবে বা করবে না- এ নিয়ে দ্বিধায় থাকতে হচ্ছে। এক ধরনের টেনশন কাজ করে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে। একই গুচ্ছের অধিভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একই দিন, একই প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণ করা যেতে পারে। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব হবে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই; বরং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে এক ধরনের আন্তসম্পর্ক তৈরি হবে, ছাত্রছাত্রীদের হয়রানি বন্ধ হবে এবং আসন খালি থাকার অবস্থা থেকে আমরা মুক্ত হতে পারব। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কিংবা উপাচার্যদের সংগঠন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় পরিষদ অথবা সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়ে গঠিত সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় ফেডারেশন এ ক্ষেত্রে জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রয়োজন শুধু যোগাযোগ, সদিচ্ছা, আন্তরিকতা ও সমন্বয়ের।
লেখক : অধ্যাপক, সমাজকর্ম বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, neazahmed_2002@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.