সোনার চেয়েও দামি

অলিম্পিক সোনার পদক শুধুই এক টুকরো সোনা নয়, সোনার চেয়েও বেশি মাইকেল ফেল্পেসর চেহারাটা দেখেছিলেন ১৯ নম্বর পদক জয়ের পর? পৃথিবীর সব সুখ যেন একাই তিনি উপভোগ করছেন তখন। লাতিনিনাকে ছাড়িয়ে গেলেন পদক-সংখ্যায়, পেলেন সোনা!


তাঁর চেয়ে আর কে বেশি সুখী হতে পারে? যে সে কথা তো নয়, অলিম্পিকের সোনা! এই সোনা তো শুধু সোনা নয়, সোনার চেয়ে দামি!
কেন এই কথা বলা হলো, তার ব্যাখ্যা দরকার। ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের ওপর যদি আপনার বিশ্বাস থাকে, তাহলে জেনে রাখুন, এই সোনার পদকের দাম বর্তমান বাজারমূল্যে মাত্র ৭০৬ ডলার! হায় রে, মাত্র ৭০৬ ডলারের জন্য এত আয়োজন! এত প্রশিক্ষণ! তাই অনায়াসেই বলা যায়, জয়টি পদকের মূল্য দিয়ে বিচার করলে হবে না, অলিম্পিকের পদক জয় মানেই এক এক করে অসংখ্য বন্ধ দুয়ার খুলে যাওয়া, ভেসে যাওয়া প্রশংসার বন্যায়।
যদি এই পদককে দাম দিয়ে বিচার করা হয়, তাহলে ক্রীড়াবিদেরা সোনা পাওয়ার চেয়ে রুপা পেলেই হয়তো বেশি খুশি হতেন। কারণ, বাজারমূল্যে এবারই প্রথমবারের মতো সোনার পদকের চেয়ে রুপার পদকের দাম বেশি। কিন্তু খেলোয়াড়েরা তো আর কোন পদকের দাম বেশি, সেই হিসাব করে খেলার মাঠে নামেন না; নামেন জয়ের জন্য। তাই দামি রুপা কম দামি সোনার কাছে পরাজিত।
আরেকটা পুরোনো কথা বলতে হয়—চকচক করিলেই সোনা হয় না। অলিম্পিকের সোনার পদকটির বেশির ভাগ রুপা, সঙ্গে আছে অল্প একটু তামা। আর তার ওপরে থাকে কেবল সোনার আস্তরণ। ব্যস!
কম দামি এমন এক অলিম্পিক সোনার জন্যই মানুষের এত হুজ্জত! একজন উসাইন বোল্ট এই আসরেই বিশ্ব রেকর্ড করার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকেন! হুম্! অর্থমূল্য নয়, অলিম্পিকের সম্মানটাই আসল। অন্য রকম।
তবে তাঁদের পকেটে টাকার আসা-যাওয়া নেই, তা কিন্তু নয়। বহু দেশই সোনাজয়ী ক্রীড়াবিদদের জন্য রেখেছে লোভনীয় পুরস্কার। কয়েকটি দেশের কথা বললেই স্পষ্ট হবে ব্যাপারটি। এই যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সোনা জয়ের জন্য দেশটি প্রত্যেক খেলোয়াড়কে দেবে ১৫ হাজার পাউন্ড, ডলারে যা ২৫ হাজার। অস্ট্রেলিয়ার খেলোয়াড়েরা পাবেন ২০ হাজার ডলার। আর ইতালি? ইতালি প্রতিটি সোনা জয়ের জন্য দেবে এক লাখ ৮২ হাজার পাউন্ড! চীন তো দারুণভাবে সোনা জয়ের প্রতিযোগিতায় লড়ে যাচ্ছে, তারা এক-একটি সোনা জয়ের জন্য খেলোয়াড়দের দেবে ৫১ হাজার ডলার। ভারত কথা দিয়েছে, মেডেলজয়ীরা প্রশিক্ষক হিসেবে চাকরি পাবেন। তবে খেলোয়াড়দের পকেট ভারী করার দৌড়ে এগিয়ে আছে সিঙ্গাপুর। সোনার মেডেল পেলে তারা ক্রীড়াবিদকে দেবে আট লাখ মার্কিন ডলার। সিঙ্গাপুরের কেউ এখন পর্যন্ত অলিম্পিকে সোনা জেতেনি। ব্রিটেন অবশ্য টাকাপয়সা দিয়ে খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করায় বিশ্বাস করে না, তারা পত্রপত্রিকায় খেলোয়াড়দের অর্জনকে বড় করে তুলে ধরেই কাজ সারতে চাইছে। টাকাপয়সা নয়, সম্মানটাই বড়—এটাই মনে করছে ব্রিটেনের অলিম্পিক কর্তৃপক্ষ।
এতক্ষণ তো সোনার পদকের দামদর আর খেলোয়াড়দের অনুপ্রাণিত করতে কোন দেশ কী করছে, তা নিয়ে কথা হলো। একটি বিষয় তো এখনো বলাই হয়নি। অলিম্পিক সোনার পদক বিক্রি করলে কত টাকা পাবেন অলিম্পিয়ান? এটা কি বাংলা সিনেমার নিম্নবিত্ত পরিবারের অর্থসংকট কাটাতে সবেধন নীলমণি গলার নেকলেস বিক্রি করার মতো ঘটনা? জহুরি নিক্তিতে পদক উঠিয়ে বলবেন, ‘উহু, এতে সোনার পরিমাণ একেবারেই কম! এ জন্য আপনাকে ৫০০ ডলার দিতে পারি?’
জি না। এখানেই মজা! পুরোনো চাল যেমন ভাতে বাড়ে, তেমনি অলিম্পিক পদক যত পুরোনো হয়, ততই তা দামি। বেশির ভাগ অ্যাথলেটই স্মৃতি হিসেবে রেখে দেন মেডেলটি। কেউ কেউ তা দিয়ে দেন কোনো দাতব্য প্রতিষ্ঠানে কিংবা ক্রীড়াবিষয়ক ফাউন্ডেশনে। ব্রিটিশ তারকা ডালি টমসন ১৯৮০ আর ১৯৮৪ সালে পাওয়া সোনার পদক দুটি দান করেছেন তাঁর অফিসের সহকর্মীদের। বলেছেন, ‘ওদের দেব না তো কাকে দেব? ওদের দিয়েই তৃপ্তি পেলাম।’
ইউক্রেনের বক্সার ভ্লামিদির ক্লিচকো তাঁর ১৯৯৬ সালে পাওয়া সোনা বিক্রি করেছেন ১০ লাখ ডলারে। ক্লিচকো ব্রাদার্স নামে একটি ফাউন্ডেশন করে তিনি সেই টাকা দিয়েছেন সেখানে। এই ফাউন্ডেশন শিশুদের খেলাধুলায় উৎসাহিত করতে কাজ করে।
কিউবান বক্সার ইউরিওরকিস গাম্বোয়া তোলেদানো ২০০৬ সালে দেশ ত্যাগ করে পাড়ি জমিয়েছেন জার্মানিতে। দেশ ছাড়ার আগে তিনি তাঁর পদক বিক্রি করে পুরো টাকা দিয়ে এসেছেন পরিবারের সদস্যদের।
প্রতিবার অলিম্পিক শুরু হওয়ার আগে নিলামে পদক বিক্রির মৌসুম আসে। এই তো অলিম্পিক শুরু হওয়ার কদিন আগেই বোনহ্যামস নামের নিলাম প্রতিষ্ঠানে দুটি সোনার পদক বিক্রি হলো। ১৯২৮ ও ১৯৩২ সালে সোনার পদক দুটি জিতেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বাইচ দলের সদস্য হেনরি ‘ববি’ পিয়ের্স। পদক দুটি বিক্রি হলো ৭৭ হাজার ৩৫০ ডলারে।
দামটাই কি সব? সোনার পদকের জন্য প্রতিযোগীরা লড়াই করছেন, নিষ্কলুষ আনন্দে ভাসছে গোটা বিশ্ব—সেটাই তো সবচেয়ে বড় পাওয়া। এ পাওয়া সোনার চেয়েও দামি!
রয়টার্স অবলম্বনে জাহীদ রেজা নূর

No comments

Powered by Blogger.