চাই চট্টগ্রামের ব্র্যান্ড by ওমর কায়সার

এবারের ঈদে চমক লাগানো একটা পাঞ্জাবি চাই। যেকোনো তরুণের মনের ভাবনা এ রকমই। কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া কোনো তরুণী হয়তো ভাবছেন অন্য রকম—উৎসবে চাই ঋতুর সঙ্গে মানানসই হাল ফ্যাশনের পোশাক। সঙ্গে মেলাতে হবে গয়নাও।


শুধু কি ঈদ! পয়লা বৈশাখ, বসন্তের প্রথম দিনেও চাই আলাদা কিছু। বিভিন্ন জাতীয় দিবসেও দেখা যায় নারী-পুরুষের পরনে বৈচিত্র্যময় পোশাক।
এভাবে পোশাক সচেতনতা বলতে যা বোঝায়, তা চট্টগ্রামে বিত্তবানদের সীমানা ডিঙিয়ে মধ্যবিত্তের সাধ ও সাধ্যের টানাপোড়েনের ভেতরেও প্রবেশ করেছে জোয়ারের মতো। পোশাকের ক্ষেত্রে আমাদের রুচির বদল ঘটেই চলেছে। বিষয়টা মাথায় রেখে বাড়তি চাহিদার জোগান দিতে বুটিক হাউসগুলোরও প্রসার ঘটছে। একেবারে রমরমা বলা না গেলেও এই শিল্প এখন বিকাশের পথ খুঁজে পেয়েছে।
অবশ্য এই পথে যাত্রার শুরুটায় তেমন ফুল বিছানোও ছিল না। একেবারে শূন্য থেকে যাঁরা শুরু করেছেন, তাঁদের মধ্যে একজন ফারুক ই আজম বীর প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধ শেষে সদ্য স্বাধীন দেশের মাটিতে উপলব্ধি করলেন এক যুদ্ধের শেষ, কিন্তু অন্য যুদ্ধ শুরু। কাজের ক্ষেত্র ছিল অনেক। তিনি এই কাজটিই বেছে নিলেন। বললেন, ‘পোশাকে এ দেশের হাজার বছরের ঐতিহ্য রয়েছে। আমাদের মসলিন, টাঙ্গাইল, জামদানির খ্যাতি জগৎজোড়া। অথচ আমাদের সীমান্তে বিডিআররা শাড়ির চোরাচালান আটক করে। পোশাকশিল্পটা তখন পুরোপুরি বিদেশনির্ভর হয়ে পড়ছিল।’ দেশের নতুন বাতাবরণে নতুন সংগ্রাম। ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রামে স্ত্রী শামিম আরা বেগমকে নিয়ে বুটিক হাউস রমণীয়া চালু করলেন। সেই বুটিক হাউসকে নিয়েই তাঁর এগিয়ে যাওয়া। ১৯৮৯ সালে ঢাকার বিচিত্রা পত্রিকা আয়োজিত ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় পুরস্কারও পেলেন। এরপর টানা ছয়বার পেলেন প্রথম আলোর আলোকিত ঈদ ফ্যাশন পুরস্কার। দৃষ্টি কাড়লেন সবার। বুটিক আন্দোলনে প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাই রমণীয়া এভাবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করল।
চট্টগ্রামে বুটিক হাউসের কথায় চলে আসে আরেকটি নাম। শিমুল খালেদের চারু চট্টগ্রাম। হুমায়ূন আহমেদসহ অনেক সেলিব্রেটির কস্টিউম ডিজাইন করেছেন এই চট্টগ্রামে বসেই। ফেরদৌস, ইলিয়াস কাঞ্চন, শাকিব খান, মীর সাব্বির, মৌসুমী, পূর্ণিমা, শাবনূরসহ অনেকেরই প্রিয় ডিজাইনার শিমুল খালেদ।
পোশাক ডিজাইন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন রওশন আরা চৌধুরী। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম রওশনস বুটিকস এবং কিডস কর্নার। ফ্যাশন ডিজাইনে তিনি পূর্ব-পশ্চিমের মিলন ঘটিয়েছেন। বিশেষ করে শিশুদের পোশাকে এনে দিয়েছেন নতুন মাত্রা। এখন তিনি বুটিক শিল্পের উদ্যোক্তাদের সংগঠিত করার কাজ করছেন। গঠন করেছেন ডিজাইনারস ফোরাম।
১৯৯৬ সালের জানুয়ারিতে আলিয়ঁস ফ্রঁসেজে গ্রামীণ চেকের পোশাক প্রদর্শনী করে সবাইকে চমক লাগিয়ে দিয়েছিলেন আইভি হাসান। পরের বছর নিউইয়র্কে অনুষ্ঠিত মাইক্রো ক্রেডিট সামিট এ প্রদর্শিত হলো তাঁর গ্রামীণ চেকের ভুবনজয়ী পোশাক। শিল্পী আইভি হাসান ছোটবেলা থেকেই নিজের কাপড় নিজে সেলাই করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আদিবাসী বন্ধুদের পোশাক তাঁকে আকর্ষণ করত। আদিবাসীদের পোশাক নিয়ে কাজ করার ভাবনার বীজটা তখনই রোপিত হয়। এই ভাবনার পথ ধরেই ডলস হাউস খুঁজে নিয়েছে ডিজাইনের ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র পরিচিতি। আইভির ডলস হাউস তাই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে পরিচিতি পেয়েছে বাইরেও।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার ছাত্র এস এম ইলিয়াস সব সময় নতুন কিছু একটা করার কথা ভাবতেন। অন্য সবার মতো একটা নির্দিষ্ট জীবিকা বেছে নিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করতে চাননি। বাবা তিনবার তাঁকে মধ্যপ্রাচ্যে পাঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ইলিয়াস নিজের সৃজনশীল চিন্তাভাবনা কাজে লাগিয়ে দেশেই কিছু একটা করার কথা ভাবতেন।
২০০২ সালে একবার রমজান মাসে বন্ধুদের নিয়ে পোশাক প্রদর্শনী করেছিলেন। সেই থেকে যাত্রা শুরু। আর ফিরে দেখতে হয়নি পেছনে। নিজের অদম্য ইচ্ছায় গড়ে তুলেছেন অনন্য এক প্রতিষ্ঠান শৈল্পিক। প্রথম আলোর ফ্যাশন প্রতিযোগিতায় পর পর কয়েক বছর হয়েছেন শ্রেষ্ঠ ডিজাইনার। এই প্রতিযোগিতায় এখন তিনি নিজেই বিচারক। চট্টগ্রাম শহরের বিপণিবিতানসহ শৈল্পিকের ১৯টি আউটলেট আছে এখন সারা দেশে।
কেবল শৈল্পিকের কথাই কেন, আরও বহু তরুণ ডিজাইনারের সাফল্যগাথা নিয়ে বহু কিছু বলা যায়। নক্ষত্র বুটিকসের আশরাফুলও তেমন একজন। চট্টগ্রামে এখন এই বুটিক হাউসের নয়টি আউটলেট আছে।
যেন শেষ নেই সাফল্যগাথার। তাই এর সঙ্গে যুক্ত নামগুলোও দিন দিন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। অনিন্দ্য, বাংলার কথা, মেহুলী বুটিকস, মুনমুনস, জত্রিতা বুটিকস, ময়ূরাক্ষী, ড্রিম ফ্যাশন হাউস— এমনই আরও কত নাম। এই তালিকা যে দীর্ঘ হচ্ছে, তার প্রমাণ এবারের প্রথম আলোর প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছে ৬৫টি বুটিক হাউস।
হয়তো সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন চট্টগ্রামের এই বুটিক হাউসগুলো প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ড হিসেবে সারা দেশে আদৃত হবে। দেশি-বিদেশি নানা পোশাকের সঙ্গে ক্রেতারা আলাদা করে চিনবে চট্টগ্রামের ব্র্যান্ডকে। আর এই অগ্রযাত্রায় প্রথম আলো তো পাশে রয়েছেই।

No comments

Powered by Blogger.