মোটা চালের দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ বৃদ্ধি পাবে- আশঙ্কা অর্থনীতিবিদদের by মিজান চৌধুরী

মূল্যস্ফীতির আশঙ্কার মধ্য দিয়ে আজ যাত্রা শুরম্ন হলো সরকারের আরেকটি নতুন বছর। বিদায়ী বছরে দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে নেয়া হয় নানামুখী পদক্ষেপ। বিশ্বমন্দার আঘাত থেকে সুরক্ষা করা হয় পণ্যের বাজারকে। দুই একটি পণ্য ছাড়া বাজার স্থিতিশীল থাকলেও বছরের শেষ সময় কিছুটা পাল্টে যায় পরিস্থিতি।
সম্প্রতি চালের মূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে আরও কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে যায়। ফলে মূল্যস্ফীতিও বাড়তে থাকে। এ অবস্থায় দরজার কড়া নাড়ে দ্বিতীয় বছর। অর্থনীতিবিদগণের আশঙ্কা, আগামীতে মূল্যস্ফীতির চাপ আরও বাড়বে। কারণ চালের মূল্যের ওপর মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি অনেকটা নির্ভর। বর্তমান মোটা চালের দাম বৃদ্ধির কারণে আগামীতে মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
গত বছর ৬ জানুয়ারি বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। বুধবার সরকারের এক বছর পূর্ণ হয়। আজ বৃহস্পতিবার এই সরকারের আরেকটি বছর শুরম্ন হলো। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও মূল্যস্ফীতি সহনশীলতায় রাখাই হবে নতুন করে নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ।
ট্রেডিং কপের্ারেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বাজার সেলসূত্র মতে, এই সরকার ক্ষমতা গ্রহণের দিন থেকে বুধবার পর্যনত্ম এই এক বছরে মোটা চালের কেজিতে কমেছে ৩.৫৭ শতাংশ, মাঝারি চালে হ্রাস পেয়েছে ৪.৫৫ শতাংশ। তবে সরম্ন চালের মূল্য বেড়েছে ১.৩ শতাংশ। এক বছরের ব্যবধানে কমেছে আটা, ময়দা ও সয়াবিন তেলের দাম। গত বছর এই দিনে এক কেজির প্যাকেট আটা ২৫ থেকে ২৮ টাকা ও প্যাকেট ময়দা ৩৬ থেকে ৩৮ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বুধবার ওই আটার মূল্য উঠেছে ২৪ থেকে ২৫ টাকা এবং ময়দার দাম ৩২ থেকে ৩৪ টাকা। এক বছরের ব্যবধানে আটার কেজিতে ৭.৫৫ শতাংশ ও ময়দার কেজিতে ১০.৮১ শতাংশ হ্রাস পায়। সয়াবিন তেল এক বছর আগে এই দিনে বিক্রি হয়েছে ৮৮ থেকে ৯৪ টাকা। বুধবার এক কেজি সয়াবিন তেল বিক্রি হয় ৮০ থেকে ৮৪ টাকা। বছরের ব্যবধানে কমেছে ৯.৮৯ শতাংশ। তবে এক বছরের ব্যবধানে বেড়েছে পামতেল, মসুর ডাল, পেঁয়াজ, আদা, রসুন, হলুদ, আলু ও চিনির দাম।
বিগত বছরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নেয়া হয়। বিশেষ করে ভোজ্যতেলের মূল্য হ্রাস করার জন্য সরকার তেলের ওপর থেকে শুল্ক প্রত্যাহার, বন্ধ তেল মিল চালুর উদ্যোগ, মসুর ডালের মূল্য নিয়ন্ত্রণে শুল্ক প্রত্যাহার, সরবরাহ বৃদ্ধির জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় আমদানির ব্যাংক ঋণের সুদের হার হ্রাস, চিনি ও ভোজ্যতেলের বাজার স্বাভাবিক রাখতে ডিও লেটারের সময়সীমা বেঁধে দেয়া, ভোক্তা অধিকার আইন পাস, বাজার মনিটরিং কমিটি গঠন, সরকারী ক্রয় আইন সংশোধন, এলসির বিপরীতে টাকার অঙ্কের পরিমাণ বৃদ্ধিসহ নানামুখী পদক্ষেপ নেয়া হয়।
কিন্তু স্বার্থান্বেষী ব্যবসায়ী মহল অতি মুনাফার নেশায় এসব উদ্যোগ অনেকটা অকার্যকর করে তুলে। সুবিধা গ্রহণ করে ব্যবসায়ীরা নিত্যপণ্যের দাম হ্রাস করেনি। সম্প্রতি চালের মূল্য কোন কারণ ছাড়াই বাড়ছে। গত এক মাসের ব্যবধানে মোটা চালের দাম ১৪.৮৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, মাঝারি ধরনের চাল ১৬.৬৭ শতাংশ ও সরম্ন চাল ৮.৫৭ শতাংশ বেড়ে যায়। চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতির চাপ বৃদ্ধির আশঙ্কা করেছে অর্থনীতিবিদরা।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা(বিআইডিএস) মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. এম. কে মুজেরী জনকণ্ঠকে জানান, বর্তমান চালের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এ ভাবে মূল্য বাড়তে থাকলে এর প্রভাব চিনি, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারের ওপর পড়বে। আগামীতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে চালের মূল্যবৃদ্ধি রোধ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। চালের বাজার পরিস্থিতি রাখার ক্ষেত্রে সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখা, চাহিদার চেয়ে বেশি তারল্য না বাড়ে সেদিকে খেয়াল রাখা, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্রেতা ঋণ নিরম্নৎসাহিত করে উৎপাদন খাতে ঋণ বৃদ্ধি করারও পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেন, চালের মূল্য বৃদ্ধির কারণে আগামী আরও মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর সর্বশেষ হিসেবে গত অক্টোবর মাসে পয়েন্ট টু পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার ওঠে ৬.৭১ শতাংশ। ওই মাসে গ্রামের মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়ায় ৬.৬২ শতাংশ ও শহরের মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ৬.৯৬ শতাংশ। খাদ্যের মূল্যস্ফীতির দিক থেকে শহরে অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ৯ শতাংশ ও গ্রামের মূল্যস্ফীতি হচ্ছে ৭.২৬ শতাংশ।
আগামী বছরের প্রত্যাশার ব্যাপারে বাণিজ্যমন্ত্রী মুহাম্মদ ফারম্নক খান জনকণ্ঠকে জানান, দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হয়। বছরজুড়ে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল ছিল। পণ্যের সরবরাহ বৃদ্ধি করতে আমদানিকারকদের উৎসাহ দেয়া হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় পণ্যের সরবরাহ বেড়েছে। বর্তমান চালের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধির কারণে অন্যান্য পণ্যের দাম দু' থেকে এক টাকা বেড়েছে। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রেখে আগামী বছর মূল্যস্ফীতি সহনশীলতার মধ্যে রাখা হবে।

No comments

Powered by Blogger.