আদিবাসী দিবস- আদিবাসী দিবস পালন নিষিদ্ধ! by ইলিরা দেওয়ান

বিশ্বের অধিকারবঞ্চিত আদিবাসী জনগোষ্ঠীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো ১৯৯৩ সালকে ‘আদিবাসী বর্ষ’ ঘোষণা করে। পরের বছর (১৯৯৪) জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রতিবছর ‘৯ আগস্ট’কে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।


এ ছাড়া জাতিসংঘ ১৯৯৫-২০০৪ এবং ২০০৫-২০১৪ সালকে যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় আদিবাসী দশক ঘোষণা করে। ১৯৯৪ সাল থেকে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ উদ্যাপন শুরু হলেও মূলত ২০০১ সালে ‘বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম’ গঠনের পর থেকে বাংলাদেশে বেসরকারিভাবে বৃহৎ পরিসরে দিবসটি উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
জাতিসংঘ-ঘোষিত বিশ্ব আদিবাসী দিবস সামনে রেখে বিভিন্ন সময়ে সরকারপ্রধানেরা বাণী দিয়ে আদিবাসীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেছিলেন। যেমন, ২০০৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বর্তমান বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, ২০০৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের প্রকাশনা সংহতি ২০০৯-এ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী তাঁর বাণীতে বলেছেন, ‘নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় বজায় রেখে আদিবাসী জনগণ যাতে সকলের মতো সমান মর্যাদা ভোগ করতে পারেন, সেটি নিশ্চিত করা আমাদের কর্তব্য।...জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত আদিবাসী অধিকার ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নেও আমরা একযোগে কাজ করতে চাই।’ (সূত্র: ‘সংহতি ২০০৯’ বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম)। এ ছাড়া ২০০৮ সালে বিশ্ব আদিবাসী দিবসের শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি আদিবাসীদের অধিকারের প্রতি সংহতি জানিয়েছিলেন। ২০১০ সালে বর্তমান সংসদ উপনেতা ও জাতীয় পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক সাজেদা চৌধুরী ‘ট্রাইবেল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’-এর প্রকাশনা অংশীদার, আন্তর্জাতিক বিশ্ব আদিবাসী দিবস-২০১০-এ তাঁর বাণীতে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার ও উন্নয়ন প্রতিষ্ঠার আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন (সূত্র: জেম্স জর্নেশ চিরান ও দুলেন আরেং সম্পাদিত ‘অংশীদার’, ২০১০)। এখানে যে বিষয়টি সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক, তা হলো ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ ৯ আগস্ট ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ উপলক্ষে বাণী দেওয়ার পরপরই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জাতিসংঘ শাখা থেকে একটি চিঠি (নং: ইউএন-জিএ-৪২২০/০৮, তারিখ: ১৯ আগস্ট ২০০৮) ইস্যু করা হয়, যেখানে বলা হয়েছিল, ‘Indigenous Issues’-তে জাতিসংঘে বাংলাদেশের অবস্থান হচ্ছে ‘the country has some tribal populations and there are no indigenous peoples!’
মূলত ২০০৮ সাল থেকেই এ দেশের আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে অস্বীকার করার প্রবণতা দেখা দেয়। এর পেছনে যুক্তি হিসেবে একটি বিশেষ সংস্থার বিশেষ প্রতিবেদনকে ইঙ্গিত করা হয়। ২০১০ সালে আদিবাসীদের মতামতের তোয়াক্কা না করে ১২ এপ্রিল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, ২০১০ আইনটি প্রণয়ন করা হয়। এই আইনের ধারা ২(২) এ বলা হয়েছে, ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’ অর্থ তফসিলে উল্লিখিত বিভিন্ন আদিবাসী তথা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও শ্রেণীর জনগণ’। একদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দেশে কোনো আদিবাসী নেই (!) আবার একই আইনে বলা হচ্ছে, আদিবাসীরাই ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী’!
অন্যদিকে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে উপসচিব (সমন্বয়-২) স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে (স্মারক নং-পাচবিম (সম-২) ২৯/২০১০/২৫, তারিখ: ২৮/০১/২০১০) বাংলাদেশে বসবাসকারী বিভিন্ন ভাষাভাষী ৪৫টি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীকে ‘আদিবাসী’ না বলে ‘উপজাতি’ হিসেবে অভিহিত করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, পার্বত্য মন্ত্রণালয় এ দেশের ৪৫টি জাতিগোষ্ঠীর অস্তিত্ব স্বীকার করলেও ‘ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন’-এ মাত্র ২৭টি জাতিগোষ্ঠীর নাম উল্লেখ আছে। আবার ২৭টি গোষ্ঠীর মধ্যে ২১ নম্বরে যে ‘মং’ সম্প্রদায়ের কথা বলা হয়েছে, বাংলাদেশে এ নামে কোনো গোষ্ঠীর অস্তিত্বই নেই। এত সব অসামঞ্জস্য ও পারস্পরিক স্ববিরোধী কার্যক্রম থেকে এটি পরিষ্কার যে ‘বাংলাদেশে কোনো আদিবাসী নেই’—এ কথা জাতিসংঘে প্রমাণ করতে গিয়ে অসংগতিগুলো আরও বারবার ফুটে উঠেছে।
পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, এটি একটি চিরন্তন ঘটনা, তেমনি প্রতিবছর ঘুরে ঘুরে ৯ আগস্ট আসবে, এটিও একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ পালন না করার জন্য গত বছর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় থেকে এক চিঠিতে (সূত্র: স্মারক নং-৪৬.০৪৫.০২২.১০.০৪.০০৪.২০১১-৫৪৬, তারিখ: ১১ মার্চ ২০১২) পার্বত্য জেলা প্রশাসক, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ পালনে যাতে কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতা করা না হয়! আদিবাসীদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে অভিহিত না করা, ‘আদিবাসী দিবস’ পালনে সহায়তা না করার জন্য পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন মন্ত্রণালয়, পার্বত্য মন্ত্রণালয়গুলো রীতিমতো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এত সব হুলিয়া, শাসানির পর মনে বারবার প্রশ্ন জাগছে, আগামীর ‘আদিবাসী দিবস’গুলো নিরুপদ্রবভাবে পালন করা যাবে তো? নাকি অচিরেই বাংলাদেশে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ নিষিদ্ধ হতে চলেছে।
১৯৯৯ সালে ইউনেসকো কর্তৃক ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ ঘোষণার পর থেকে আমরা গর্বের সঙ্গে প্রতিবছর ‘মাতৃভাষা দিবস’ পালন করে আসছি। কিন্তু ১৯৯৪ সালে জাতিসংঘ ৯ আগস্টকে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ ঘোষণা দিলেও তৎকালীন সময় থেকে এযাবৎ বাংলাদেশের কোনো সরকারই সরকারিভাবে দিবসটি পালন করেনি, উপরন্তু বর্তমানে এ দিবস পালনের ওপর সরকারিভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনীতে আদিবাসীরা নিজেদের ‘আদিবাসী’ হিসেবে স্বীকৃতির দাবি জানালেও সরকার তাদের দাবি উপেক্ষা করে ‘উপজাতি’ হিসেবে বিবেচনা করেছে। একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীগুলোর মতামতের ওপর এ ধরনের আচরণ নিঃসন্দেহে এ দেশের আদিবাসীদের অস্তিত্বকেও বিপন্ন করে তুলবে। অথচ এই উপমহাদেশের ইতিহাস আজও আদিবাসীদের গৌরবময় ভূমিকার সাক্ষ্য বহন করছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সূত্রপাত মূলত আদিবাসীদের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা বিদ্রোহ বা কার্পাস বিদ্রোহ (১৭৭৬-১৭৮৭), ময়মনসিংহের গারো জাগরণ (১৮২৫-২৭, ১৮৩২-৩৩, ১৮৩৭-৮২), সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৫৫-৫৭), তেভাগা আন্দোলন (১৯৪৬-৪৭), হাজং বিদ্রোহসহ অনেক বিদ্রোহই ইতিহাসের সাক্ষী।
সবশেষে ‘বিশ্ব আদিবাসী দিবস’ সামনে রেখে বলতে চাই, সন্দেহ ও আস্থাহীনতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নয়, আদিবাসীদের অতীত ইতিহাসের যথাযথ মূল্যায়ন করে ‘আদিবাসী’ হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করা হোক। বিশ্ব আদিবাসী দিবস পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি নয়, সরকারিভাবে দিবসটি পালনের উদ্যোগ গ্রহণ করে আদিবাসীদের সঙ্গে আনন্দ ও সুখ-দুঃখের অংশীদার হোন।
ইলিরা দেওয়ান: মানবাধিকারকর্মী।
ilira.dewan@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.