মানবপুরাণের কতেক বয়ান- জীবন কথন by রণজিৎ বিশ্বাস

আপনি তো জীবনে অনেক ধরনের মানুষ দেখেছেন। : ইয়েস, আমি আমার বিরানব্বই বছরের জীবনে অনেক ধরনের মানুষ দেখেছি। ইন ফ্যাক্ট, আই হ্যাভ সীন দ্য মিনেস্ট, মডেস্ট এ্যান্ড ব্রাইচেস্ট অব হিউম্যান বীঈঙস। : অনেকদিন ধরেই আপনি কিন্তু বয়সের অঙ্ক পাল্টাচ্ছেন না। ‘বিরানব্বই’ এত ভাল লাগে কেন আপনার! এই ব্র্রাকেটে আর কদিন আটকে থাকবেন?


: ভদ্রলোকের এককথার মতো গত পাঁচ বছর ধরে বয়সের একই অঙ্ক প্রকাশ করে গেলেও এখন বয়স আমার সাতানব্বুই। কেন সাতানব্বুইÑ এই ব্যাখ্যা চেয়ে সময় নষ্ট করবেন না। সংক্ষেপে শুধু বলে রাখি, জন্মের সময় বয়স আমার অনেক বেশি ছিল। এত বেশি যে আপনি ভাবনায়ও আঁটাতে পারবেন না। মানুষ নিয়ে প্রশ্ন শুরু করেছিলেন, সে প্রশ্নেই লগ্ন থাকুন।
: কত রকমের মানুষ দেখেছেন, উদাহরণসহ বলুন।
: এটি পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ। সংসারে মানুষের সংখ্যা যত রকমও তত। এ মুূহূর্তে সংসারে যদি সাতশ’ কোটি মানুষ থাকে, মনে করতে হবে সাতশ’ কোটি মানুষ একই সঙ্গে শ্বাস নিচ্ছে।
সংসারে মানুষের রকম হচ্ছে, নভোলোকে তারকার মতো, সমুদ্রতটে বালুকার মতো, বৃক্ষ শীর্ষে পত্রের মতো।
: তাহলে আপনি একটা কাজ করতে পারেন। আপনি শুধু তাদের রকমটাই চিনিয়ে দিন, যাদের আপনি ভুলতে পারবেন না। সংখ্যায় কেমন হবে, তাদের রকম?
: দেখা যাক, বলতে শুরু করি। এক ধরনের মানুষ দেখেছি, যাদের দেহের বিশেষ প্রত্যঙ্গে প্রার্থনা চিহ্ন স্থায়ীভাবে বসে আছে, কিন্তু মানুষ তারা শুদ্ধ নয়। তাদের মধ্যে হিংসা আছে, বিদ্বেষ আছে, ধর্মান্ধতা আছে, ম-ূকতা আছে।
কিছু মানুষ দেখেছি, জীবনের ঘোর আমারাতে সঙ্গী হয়েছে, এগিয়ে যাওয়ার কর্দমভরা পথে একটি করে ইট বিছিয়ে বলেছে- বাছা তুই এগিয়ে যা। আমি তোর সঙ্গে আছি।
কাউকে কাউকে দেখেছি, বিশ্বাসভিত্তিক আচরণে ঘোর অনৈষ্ঠিক; বছরের বিশেষ বিশেষ দিনে সংঘবদ্ধ প্রার্থনায়ও শামিল হয় না, কিন্তু মানুষ হিসাবে অম্বরহৃদয়, হৃদয়ের সৌন্দর্য তার কাঞ্চনশোভন, সে সবকিছুই বোঝে কিন্তু মানুষে মানুষে ভেদরেখা টানার যুক্তি ও প্রয়োজন বোঝে না। এ ধরনের মানুষকে আপনি কী নামে ডাকবেন, কী কথা বলবেন আপনি তাদের উদ্দেশ্যে!
কিছু মানুষ দেখেছি, সবসময় তাদের একটি ছুরি গুটানো রাখে, সুযোগ পেলেই পিঠে বসিয়ে দেয় কারণ বুকে বসাবার সাহস তাদের থাকে না।
কাউকে কাউকে দেখেছি, সংশায় প্রশংসায় খুবই সংযত কিন্তু সমালোচনায় খুবই কঠিন। রামগড়ুরের ছানার মতো তারা হাসতে জানে না।
কাউকে কাউকে দেখেছি, পিঠের পরে লেবেল লাগিয়ে দিতে। শত্রুপক্ষের লেবেল। মনে করা যাকÑএকজন মানুষের নাম সমরজিৎ, অথবা যুদ্ধজয়ী অথবা রণচিৎ; সে যাদের শ্রম দিয়ে নিষ্ঠা দিয়ে আন্তরিকতা দিয়ে ইমপ্রেস করেছে, তারা তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ জংশনে নিজের গুরুত্বপূর্ণ মত দেয়ার সময় বলেছেÑসে লোক খারাপ নয়, কিন্তু সে আমাদের লোক নয়, সে ওদের লোক, সে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষের লোক, সে দেশের স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবপ্রেমের পক্ষের লোক। সে আমাদের মানসিকতার নয়; সে জাতির পতাকা, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত ও রবীন্দ্রনাথের প্রতি শ্রদ্ধাশীল।
: মানুষের ভালবাসাও তো আপনি প্রচুর পেয়েছেন।
: প্রচুর নয় শুধু, প্রচুরাতিপ্রচুর। সেটিই মনে রেখেছি, বিপরীত অভিজ্ঞতার কথা ভুলে গেছি। স্মরণ করার চেষ্টাও কখনও করবো না।
: যাদের ভালবাসা খুব বেশি পেয়েছেন, তাদের কয়েকজনের কথা অন্তত বলুন।
: এক জননীর ছ’জন সন্তান। অর্থবিচারে খুব সম্পন্নও তিনি ছিলেন না। তিনি শর্তহীনভাবে ঘোষণা করতেন আমার ছ’জন আছে, কিন্তু রাঙ্গাচুলো ও রাঙ্গামুলোর মতো ওই ছেলেটি আমার প্রথম সন্তান। যখন কলেজে ঢোকার আগেই পড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল, ঐ জননী বলেছিলেনÑকোথায় পড়তে চাস? বলেছিলামÑঠিক আছে, পড়বি। তুই সেই কলেজেই পড়বি। দায়িত্ব আমার।
সেই কলেজেই আমার পড়া হয়েছিল।
এক মানবীর সব কিছুই ভাল লাগতো। তার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিদিন একটি করে পত্রের বিনিময় হতো। একদিন তার মনে হলো অর্থনৈতিক নিরাপত্তাই তার কাছে বড়, জন্মের পরিচয়ই তার কাছে বড়। সংসারের সবচেয়ে পাপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে অন্য ঠিকানায় চলে গেল। মানব হত্যার চেয়েও বড় অপরাধ যে হৃদয়হনন, সংসারে সবাই বুঝতে পারে না।
প্রজন্মান্তরের এক মানবী দু’দিন দুটি কথা বলেছিলÑআপনার যত দুর্বোধ্যতা, আপনার যত অস্পষ্টতা ও আপনার যত ইঙ্গিতময়তা তার সব নিয়েই আপনি আমার প্রিয়। দ্বিতীয় দিন বলেছিল, জন্ম আমাদের ভুল প্রজন্মে। আপনি বড় আগে চলে এসেছেন। আমি অনেক পরে। নইলে, আমাকে খাতার পাতায় পাতায় লিখতে হতো নাÑ ‘আমার যেমন অশ্রু ঝরে তোমার কেন ঝরে না!’
: তারপর?
: তারপর, আরও দু’টি বলবো। সে দু’টিও ভালোবাসার। তবে ভিন্ন ধরনের ভালোবাসা। শ্রমজীবনের প্রয়োজনে আমি একসময় দেশের কোণে কোণে যেতাম, আখচাষীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের উঠোনে উঠোনে মোড়ায় মোড়ায় পিঁড়িতে পিঁড়িতে পাটিতে পাটিতে মাদুরে মাদুরে কিংবা শতরঞ্চিতে শতরঞ্চিতে বসতাম। তারা তাদের গাইয়ের দুধটা, বইয়মের আচারটা, গাছের কাঁঠালটা, ঝোপের আনারসটা আমাকে খেতে দিত। তাদের স্ত্রীদের দিয়ে পিঠেপুলি বানিয়ে রাখতো। আমাকে খইয়ের সঙ্গে কাঁঠাল দিত, চিড়ের সঙ্গে দইকলা দিত, নারকোলের নাড়ু দিত, উঠোনকোণের আম-পেয়ারা-আমড়া দিত।
এদের দু’জন আমার জন্য নিজেদের গাছের শেষ কাঁঠালের সঙ্গে আদরে সোহাগে ও শাসনে ঝগড়ায় কথা বলেছিল। একজন কাঁঠালের বোঁটায় লবণমাখা গেজ ঢুকিয়ে ও তাকে ছালায় প্যাঁচিয়ে শাসন সুরে বলেছিলÑকাঁঠাল তুই কালই পাকবি, স্যারকে খাওয়াবো, স্যার বড় পছন্দ করে। ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ চিনিকল এলাকার সেই চাষীয় বিপরীত করেছিল, ফরিদপুরে এক চাষী। সে তার গাছের শেষ কাঁঠালটির সঙ্গে প্রতিদিন কয়েকবার করে কথা বলতোÑকাঁঠাল তুই পাকিস না, আমার স্যার মধুখালী আসার আগেও তুই মোটেও পাকিস না; মুখকালা তুই দম ধইরা থাক, এক্ষুনি তই পাকিস না।
: তারপর?
: তারপর কথা শেষ করবো। এবং, শেষ করার আগে একটি বাক্যই শুধু বলবোÑ সংসারে মানুষ অনেককিছুর মূল্য দিতে পারে, কিন্তু এমন ভালোবাসার ও এমন সম্প্রদানের মূল্য শোধার স্বপ্নও দেখতে পারে না।
লেখক : শ্রমজীবী কথাসাহিত্যিক

No comments

Powered by Blogger.