সারি সারি সবুজ ছোট গাছ... শিশির ভেজা, ব্যসত্ম কিষাণ কিষানী- মুন্সীগঞ্জে এবার আলুর রেকর্ড আবাদ by মীর নাসির উদ্দিন উজ্জ্বল

মুন্সীগঞ্জ সারি সারি সবুজ ছোট গাছ...শিশির গড়াচ্ছে। এই গাছের যত্ন নিতে কৃষক-কৃষাণীর ব্যসত্মতা। গ্রামের মেঠোপথ, কাঁচপাকা রাসত্মা যেদিক থেকেই পথ চলুন না কেন যেদিকে চোখ যাবে সেদিকেই এমন দৃশ্য চোখে পড়বে। এখন মুন্সীগঞ্জের সর্বত্র এমন চিত্র।


এই গাছগুলো হচ্ছে আলুগাছ। বিসত্মীর্ণ জমিতে আলুগাছের যত্ন নিতে এখানকার কৃষক এখন মহাব্যসত্ম। বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে এখানে। আলু উৎপাদনের প্রসিদ্ধ এলাকায় এবার রেকর্ড পরিমাণ আলু আবাদ হয়েছে। সারের দাম কমানো এবং সহজলভ্যতার কারণেই কৃষক এবার সব রেকর্ড ছাপিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩৬ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করেছে বলে জেলা কৃষি সমপ্রসারণ বিভাগ জানিয়েছে। মুন্সীগঞ্জে এ বছর আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২৯ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমি। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২২ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি জমিতে আলু আবাদ হয়েছে। জেলার কেওয়ার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কৃষক আমিন উদ্দিন আরও ১০/১২ জন নিয়ে আলুর জমিতে আগাছা সরাচ্ছেন। এখানে কাজ করতে আসা কৃষাণী আলেয়া বলেন, এই আলুই আমাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন। ফলন ভাল হলে আমরাও ভাল থাকব। বজ্রযোগিনী এলাকার ভাঙ্গামোরের কাছে আলুর জমিতে পানি ছিটাচ্ছেন আলম মিয়া। তাঁর জমির আলুগাছের কিছু পাতা হলদে রং হয়েছে। কৃষি বিভাগের লোকজন এসে পানি ছিটানোর জন্য বলেছেন। এমন আশপাশের আরও কয়টি জমিতে বিচ্ছিন্নভাবে গাছের সমস্যা দেখা দিয়েছে। রামপালের কৃষক রমিজ মিয়া কিটনাশক ছিটাচ্ছেন। তিনি বলেন, প্রচ- শীতের সঙ্গে কুয়াশা পড়ছে। এতে রোগবালাই হতে পারে বলেই আগাম ওষুধ দেয়া হচ্ছে।
সুয়াপাড়ার মনির ব্যাপারি জমিতে কাজের ব্যসত্মতা দেখে প্রশ্ন করতেই বলেন, ভাই গেল বার চাষ করছি ২ কানি (২৮০ শতাংশ) এবার করছি ৩ কানি (৪২০ শতাংশ)। কথা বলার সময় নেই। কেন এবার বেশি জমিতে চাষ করলেন? উত্তরে বলেন, এবার আলুর দর বেশি আর ৮৫ টাকা কেজির টিএসপি ২২ টাকা, ৭৫ টাকা কেজির এমওপি ২৫ টাকা কেজি দরে এবার সার পেয়েছি যথাসময়ে তাই এবার চাষ বেশি করছি। কিন্তু দাম ঠিকমতো পেলেই হয়। কারণ হিসেবে তিনি জানান, মধ্যস্বত্বভোগীরা এখানে বেশ সক্রিয়। জেলার টঙ্গীবাড়ি, সিরাজদিখান, শ্রীনগর, লৌহজংসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এমন দৃশ্যই লক্ষ্য করা গেছে। সবুজের এমন সমারোহ দেখে শুধু কৃষকের মন ভরবে না, যে যাবেন তাঁরও ভাল না লাগার কোন কারণ নেই। সকালে শিশিরে ভরে থাকা আলুর মাঠ দেখলে মনে হবে সবুজের ওপর কেউ সাদা আবরণ দিয়ে রেখেছে। আসত্মে আসত্মে ফোঁটা ফোঁটা শিশির ঝরার দৃশ্যও চমৎকার।
জেলা কৃষি সমপ্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক একেএম আমিনুর রহমান জানান, জমিতে রস কম থাকায় গাছে ইউরিয়া সারের অভাব দেখা দেয়। সে কারণে বিচ্ছিন্নভাবে ৫০৬ একর জমিতে কিছু সমস্যা হয়েছে। তবে জমিতে পানি দেয়ায় সমস্যা কেটে যাচ্ছে। আলু গবেষণা উপকেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আজিজুল হক জানান, আবহাওয়া ও মাটি অনুকূলে থাকায় গড়ে প্রতি হেক্টরে ৩০ টন আলু উৎপাদন হচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এবার আলুর গড় উৎপাদন ধরা হয়েছে সাড়ে ১৬ টন। তাতেই বোঝা যায় কত বেশি আলুর জন্য উপযোগী এই এলাকা। আলুর এই গড় উৎপাদন জানা মতে বিশ্বের কোথাও এত বেশি নেই। এর আগে ২০০৮ মৌসুমে এই জেলায় রেকর্ড পরিমাণ ৩৬ হাজার ৩৫ হেক্টর জমিতে ১০ লাখ ৮১ হাজার ৩৫০ টন আলু উৎপাদন হয়। গত মৌসুমে ৩৫ হাজার ৫৮৭ হেক্টর জমিতে ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৬৭৪ টন আলু উৎপন্ন হয়।
কৃষি অফিস জানায়, এবারও প্রায় ১১ লাখ টন আলু আবাদ হবে। কিন্তু এই জেলার ৬৯টি হিমাগারের মধ্যে ৬৩টি চালু রয়েছে। এগুলোর ধারণক্ষমতা চার লাখ টন। বাকি আলু সংরক্ষণ নিয়েও কৃষকের চিনত্মা নিবারণে এবং সঠিক দাম যাতে প্রকৃত কৃষক পেতে পারে সে লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানান জেলা প্রশাসক মোঃ মোশারফ হোসেন।
নবেম্বরের মাঝামাঝি থেকে মুন্সীগঞ্জে আলু রোপণ শুরম্ন হয়ে ডিসেম্বর পর্যনত্ম চলে। আর আলু উঠানো শুরম্ন হবে মার্চের মাঝামাঝি থেকে। সার পেলেও মানসম্মত বীজের অভাব ছিল এবারও। বিএডিসি ৭৪ হাজার টন আলু বীজের বিপরীতে মাত্র ১৪৫০ টন বীজ সরবরাহ করে। তাই হল্যান্ড থেকে আমদানিকৃত বাঙ্ আলু বীজ রোপণ করা হয়। কিন্তু স্থানীয়ভাবে কৃষকের সংরক্ষিত বীজ মানসম্মত হয় না হিমাগারের কারণে। এখানকার হিমাগারগুলোর কোনটিই বীজ রাখার জন্য উপযুক্ত নয় বলে বিএডিসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। এছাড়া অনেক কৃষকই ব্যাংকের ঋণ না পেয়ে মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে আলু আবাদ করেছে। আবাদ ভাল না হলে কৃষকের কষ্টের শেষ নেই। এসব কারণে আলু চাষীদের সহজ শর্তে ঋণ দেয়া এবং মুন্সীগঞ্জে আলু বীজ সংরক্ষণের জন্য হিমাগার নির্মাণের দাবি জানিয়েছেন কাটাখালীর কৃষক সিরাজ মিয়া।

No comments

Powered by Blogger.