একুশ শতক- হুমায়ূনের অমরত্ব by মোস্তাফা জব্বার

॥ দুই ॥ (গত সপ্তাহে আমরা হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে যেসব ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে; যেমন তাঁকে ‘পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে’ এবং ‘নুহাশ পল্লীতে কেবল শাওনের ইচ্ছায় দাফন করা হয়েছে’ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করেছি।


সেই আলোচনার পর হুমায়ূনকে নিয়ে চট্টগ্রামে একটি ও চট্টগ্রামের মামলার বিরুদ্ধে ঢাকায় একটি মামলা হয়েছে। একই প্রসঙ্গে ১৭ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি বিবৃতি দিয়েছেন। এই সপ্তাহে গুলতেকিন, কপিরাইট ও হুমায়ূনের কর্মজীবন নিয়ে আলোচনা করা হলো। আগামীতে হুমায়ূনের সৃষ্টিশীলতা যেমন সাহিত্যকর্ম, নাটক ও চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রয়েছে। এ জন্য কিছুটা সময় লাগতে পারে। আফটার অল হুমায়ূনের বইগুলো তো পড়তে হবে। ‘নন্দিত নরক’ আর ‘শঙ্খনীল কারাগার’-এর পর সব বই তো আমার মেয়েরা পড়েছেÑআমি তো পড়িনি)

গুলতেকিনকে শ্রদ্ধার্ঘ্য : কিছুটা অবাক হয়েও আমি বিস্মিত হইনি এটি দেখে যে, হুমায়ূনের প্রথম স্ত্রী গুলতেকিন আহমেদ তার প্রাক্তন স্বামীর স্মরণে আয়োজিত স্মরণসভায় যোগ দিয়েছেন এবং নীরবে চোখের পানি ফেলেছেন। গুলতেকিনের জীবন যে বেদনার্ত। অল্প বয়সে পরিবারের মতের বিপক্ষে চালচুলাহীন একজন সাধারণ শিক্ষককে বিয়ে করার পর তিন দশক সংসার করে স্বামীকে প্রবলভাবে প্রতিষ্ঠিত করার পাশাপাশি তার চারটি সুসন্তানের জননী হয়ে এক সময়ে যখন তাকে বিবাহবিচ্ছেদের শিকার হতে হয়েছে তখন তার দুঃখ অনুভব করার জন্য গবেষণা করার প্রয়োজন নেই। তার জীবনযুদ্ধ বাংলার যে কোন নারীর বেদনার প্রতীক ও অনুপ্রেরণার উৎসÑ দুটোই হতে পারে। তিনি যে লেখককে গভীরভাবে ভালোবাসতেন তার দুটি প্রমাণ হলো যে, বিবাহ বিচ্ছেদের পর তিনি অন্য কাউকে বিয়ে করেননি এবং হুমায়ূনের মৃত্যুর পর তিনি তার আবেগ প্রকাশ না করে পারেননি। একই সাথে একজন সংগ্রামী নারী হিসেবে জীবনযুদ্ধকে নিজের আয়ত্তে আনা ও হুমায়ূনের চার সন্তানকেই সঠিকভাবে শিক্ষিত করার দুঃসাহসী কাজটি তিনি করেছেন। অসীম সাহসী এই নারীর প্রতি তাই অসংখ্য শ্রদ্ধার্ঘ্য জমা হচ্ছে। আমি নিজেও তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
কপিরাইট : হুমায়ূনের বইগুলো, ছবিগুলো, নাটকগুলোর মেধাস্বত্ব বা কপিরাইট কার হবে সেটি নিয়েও এরই মাঝে প্রশ্ন উঠেছে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এতদিন হুমায়ূনের বই যাঁরা প্রকাশ করেছেন তাঁরা কোন লিখিত চুক্তি ছাড়াই সেটি করেছেন। কপিরাইট আইন (২০০০) ২০০৫ অনুসারে কোন ভিন্ন চুক্তি না থাকলে খুব স্বাভাবিকভাবে বই-এর কপিরাইট লেখকের। এমনকি বই-এর গায়ে কারও নামে স্বত্ব লেখা থাকলেই সেটি তার স্বত্ব হবে কিনা সেটিও সঠিকভাবে বলা যাবে না। কারণ আইনে আছে যে, লেখককে স্বত্ব¡ নিয়োগ করার জন্য বিধিবদ্ধ পদ্ধতি অনুসরণ করতে হবে। ফলে হুমায়ূনের বইগুলোর স্বত্ব এখন হুমায়ূনের স্থলে তার উত্তরাধিকারীদের। হুমায়ূনের নামে যত সম্পত্তি রয়েছে তার সব যেভাবে উত্তরাধিকারীদের মাঝে বণ্টন হবে বই-এর স্বত্বও একইভাবে বণ্টন হবে। এর রয়্যালটি বা অন্য আয়ও মালিকানার ভিত্তিতে বণ্টন হতে হবে।
টিভি নাটক বা চলচ্চিত্রের কপিরাইট প্রযোজকের বা অর্থ বিনিয়োগকারীর। কিন্তু এতে হুমায়ূনের কাহিনীকার, গীতিকার, পরিচালকের কপিরাইট অংশ বহাল থাকবে যদি তিনি নিজে প্রযোজক না হয়ে থাকেন এবং প্রযোজকের কাছে তিনি তার এইসব স্বত্ব লিখিত কোন চুক্তির ভিত্তিতে ত্যাগ না করে থাকেন। তিনি যেসব সৃজনশীল কাজ করেছেন তার প্রযোজক তিনি নিজে হলে তো কোন কথাই নেই। যেসব টিভি চ্যানেল তার এসব কাজ প্রচার করেছে তাদেরও কোন স্বত্ব থাকবে না যদি তারা হুমায়ূনের সাথে স্বত্ববিষয়ক কোন চুক্তি না করে থাকেন। টিভিতে বা সিনেমা হলে সম্প্রচার বা প্রদর্শন করার অধিকার মেধাস্বত্বের মালিকানা নয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে, হুমায়ূনের সাহিত্যকর্মের কপিরাইট তাঁর মৃত্যুর পর ৬০ বছর বলবত থাকবে; অর্থাৎ ১৮ জুলাই ২০৭২ পর্যন্ত এগুলো হুমায়ূনের উত্তরাধিকারদের মালিকানায় থাকবে। এরপর এগুলো জনগণের সম্পদে পরিণত হবে। হুমায়ূনের বইবিষয়ক ইস্যুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে বছরে হুমায়ূনের বই-এর আড়াই লাখ কপি বিক্রি হয়। দেশের মোট বই বিক্রির পরিমাণ প্রায় ৩ লাখের বেশি হিসাবে হুমায়ূন একাই নিয়ন্ত্রণ করেন এর শতকরা ৭৫ ভাগ। আমার নিজের ধারণা সামনের সময়ে হুমায়ূনের বই-এর বিক্রি আরও বাড়বে এবং এটি শতকরা ৮৫ ভাগের কাছাকাছি চলে গেলে অবাক হবার কিছু থাকবে না।
একই সাথে এই কথাটিও বলা দরকার যে, প্রকাশকগণ যেন কোনভাবেই কপিরাইটের আইনগত বিষয়টি উপেক্ষা করে প্রকাশনায় হাত না দেন। কেউ যদি ভেবে থাকেন যে শাওনের সাথে কথা বলেই বই প্রকাশ করে ফেলব, তবে ভুল করবেন। আমি আশা করব শাওন যেমন এটি বুঝবেন যে, তাঁর নিজের হিস্যাটা কতটা, তেমনি হুমায়ূনের সন্তানদেরকেও বুঝতে হবে যে, তারা পিতার সকল কিছুরই উত্তরাধিকারী। গুলতেকিন তার নিজের সাহসের ওপর ভর করে হুমায়ূনের সন্তানদের যেভাবে গড়ে তুলেছেন সেটি মহৎ কিন্তু হুমায়ূনের সম্পদের উত্তরাধিকারী ত্যাগ করাতে কোন কৃতিত্ব নেই। পিতার সম্পদে সন্তানের অধিকার থাকবে সেটি অবশ্যই মানতে হবে।
হুমায়ূনের অমরত্ব : প্রকৃতপক্ষে হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আলোচনা করতে হলে সেই আলোচনার উপজীব্য বিষয় হতে হবে তাঁর সাহিত্য ও অন্যান্য সৃষ্টি। তাঁর ব্যক্তিগত জীবন কেমন ছিল বা তিনি পিতা হিসেবে, স্বামী হিসেবে কেমন ছিলেন সেইসব আমাদের আলোচ্য বিষয় হওয়া উচিত নয়। মানুষকে মূল্যায়ন করতে হলে তাঁর সৃষ্টি দিয়েই তা করতে হবে। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে তাঁর ব্যক্তিগত, পারিবারিক প্রসঙ্গগুলো আলোচ্য বিষয় নয়। হুমায়ূন ভারতীয় লেখক শঙ্করের ভাষায় হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক, সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখক। হুমায়ূনকে তাঁর সৃষ্টির বিচারে যাচাই করাটাই সম্ভবত সবচেয়ে সঠিক কাজ। আমি মনে করি, হুমায়ূন আহমেদ দেহত্যাগ করলেও বাঙালী ও বাংলা ভাষা যতদিন থাকবে ততদিন তিনি মরবেন না। বিশেষ করে বাংলাদেশে সাহিত্য ও অন্যান্য ক্ষেত্রে তিনি যে জায়গাটি করে নিয়েছেন সেটির কোন তুলনা আমি এখনও পাইনি। যে মানুষটি একা দেশের সকল বিক্রীত সাহিত্যকর্মের শতকরা ৭৫ ভাগ দখল করেন তাঁর সাথে কারও কি তুলনা হতে পারে? স্বাধীনতার পরে রাজনীতিবিদ থেকে কবি-সাহিত্যিক পর্যন্ত বহু কিংবদন্তির মানুষকে আমরা হারিয়েছি। তাদের প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার কমতি ছিল না। কিন্তু হুমায়ূনের মৃত্যুর পর বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা, টিভি ও অন্যান্য মিডিয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোতে যত প্রগাঢ়ভাবে আলোচনা হয়েছে তাতে আমি বলতে পারি যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কোন বাংলাদেশের নাগরিককে নিয়ে এত বেশি আলোচনা এর আগে আর কখনও হয়নি। শহীদ মিনারে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানোর যে অসাধারণ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে সেটি বাংলাদেশের কোন মানুষের কপালে কবে আবার জুটবে সেটি কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না। সকল রাজনীতির উর্ধে উঠে অতি সাধারণ মানুষ যে পরম শ্রদ্ধায় তাকে আপ্লুত করেছে সেটি আমাদের জীবদ্দশায় আর কখনও দেখে যেতে পারব বলে মনে হয় না।
এত শ্রদ্ধা, এত ভালোবাসা, এত সম্মান এ দেশে আমি আর কাউকে দেখাতে দেখিনি। ফলে আমি নির্দ্বিধায় বলব, হুমায়ূন আহমেদ বাংলাদেশের চার দশকের সবচেয়ে বড় মাইলফলক। আমি ঠিক জানি না, কবে কেউ একজন হুমায়ূনের এই মাইল ফলকটি অতিক্রম করবেন।
হুমায়ূনের ভক্তদের অনুভবের কথা যদি বাদও দেয়া হয় তবুও এই কথাটি আজ বলতেই হবে যে, বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র ছাড়া আর কেউ হুমায়ূনের জনপ্রিয়তার কাছাকাছি আসতে পারেনি। তার জনপ্রিয়তার সঙ্গে এখন সম্ভবত বাংলা সাহিত্যের কোন লেখকের তুলনা করা যায় না। শুধু সাহিত্যিক কেন, রাজনীতিবিদ থেকে অন্য কোন পেশার কোন মানুষ হুমায়ূন আহমেদের ধারে কাছের মতো জনপ্রিয় নন।
আমি ফেসবুকে হুমায়ূনকে নিয়ে সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া দেখেছি। আমি ইচ্ছে করলে হাজার হাজার স্ট্যাটাস এখানে তুলে ধরতে পারব। সেটি যেহেতু সম্ভব নয় সেহেতু আমি কেবলমাত্র একটি স্ট্যাটাস এখানে তুলে ধরছি। হুমায়রা আহমেদ নামের একটি মেয়ে লিখেছে, “বুয়েটে ভর্তি হতে গেছি, ওজন উচ্চতা মাপা হচ্ছে; আমার নাম দেখে দায়িত্বশীল শিক্ষকের প্রথম প্রশ্ন; লেখক হুমায়ূন আহমেদ কি হয় তোমার? উনি যে আমাদের প্রত্যেকের কিছু হন সেটা বোঝান তো সহজ নয়! ১৯৯৪, বইমেলা-যথারীতি বই কিনতে গেছি, আর তিনি অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। একটা বইয়ের খুব দাম বলে কেনা গেল নাÑমন খারাপ। আমার অতি স্পষ্টভাষী মা সরাসরি গিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলেন, “বইয়ের এত দাম রাখেন কেন? কিনতে না পারলে বাচ্চারা মন খারাপ করে? হুমায়ূন আহমেদ লজ্জিত মুখে বললেন, দাম তো আমরা রাখি না, প্রকাশক ঠিক করেÑআসলেই দামটা একটু বেশি।” আমাদের বয়োসন্ধিতে অনেক বাবা মা-ই মনে করতেন হুমায়ূন আহমেদ পড়া শুরু করেছে মানে ছেলেমেয়ে ইচড়ে পাকা হয়ে গেছে। তবু তারা বই কিনে দিতেন। কারণ নিজের অজান্তে মনন তৈরির দায়িত্বটা তার হাতে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত ছিলেন। সেই অতি আতেল আমি হুমায়ূন আহমেদ পড়ি যুক্তরাজ্যে উচ্চশিক্ষার জন্য যাবার পর, কারণ খুব সহজ-পাইরেটেড বইয়ের সাইটে তার বইগুলোই পাওয়া যায়। এখনও মনে পড়ে, ডিফারেন্সিসিয়েশন ইন্টারভিউর দশ মিনিটি আগেও মিসির আলী পড়ছি- রিসার্চ প্রপোজাল নয়। আমাদের বোতল ভূতএখনও বন্ধ আলমারিতে কান লাগিয়ে বলছিÑযেখানেই থাকুন, ভাল থাকুন বই মেলায় অন্যপ্রকাশের স্টলের সামনে যে ভিড়ের জন্য বিরক্ত হতাম, সেটা আর কতদিন থাকবে জানি নাÑতবে আপনি চিরদিন থাকবেন আমাদের পাশে।”
হুমায়রাদের প্রজন্মের কাছে বাংলা সাহিত্যের একজনই লেখক আছে যার নাম হুমায়ূন আহমেদ। তদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা বলবে, আরও হয়ত লেখক আছে তবে হুমায়ূনের পরে আর কারও নাম উচ্চারণ করার কথা মনে থাকে না। আমি ঠিক এই কথাটি ভাবি যে, হুমায়ূন না থাকলে আমরা একদিকে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাংলা বইয়ের একতরফা বাজারে পরিণত হতাম অথবা আমাদের নতুন প্রজন্মকে বাংলা বই পড়তেই দেখতাম না। তাই তিনি বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্যকে একটি নতুন জীবন দিয়েছেন।
হুমায়রা বাংলাদেশের সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি যারা আমাদের সন্তান এবং হুমায়ূন আহমেদের বড় মেয়ের বয়সী। হুমায়রার কথা থেকেই বোঝা যায়, ওরা তাঁর কত ভক্ত পাঠক। হুমায়ূন যে কতটা অমর সেটিও এই প্রজন্মের বাংলা পাঠক পাঠিকাদের প্রতিক্রিয়ায় জানা যায়। এদের কারও কাছে হুমায়ূন আহমেদ কোনদিন মরবেন না। ৩২২টি বই, অনেক টিভি নাটক ও কয়েকটি সিনেমা এবং কিছু সঙ্গীত রচনা করে হুমায়ূন আহমেদ সবচেয়ে বড় যে কাজটি করেছেন সেটি হলো একটি পাঠবিমুখ প্রজন্মকে বাংলা গল্প উপন্যাস পড়তে অভ্যস্ত করা। ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলোর সোপ অপেরার পাশাপাশি বাংলাদেশের দৈনন্দিন জীবনের হাসি কান্নার দৃশ্যগুলো দেখার জন্য এদেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে হুমায়ূন আহমেদের পাশে আর একটি নামও নেই।
আমরা হুমায়ূন আহমেদের প্রজন্মেরই লোক। হুমায়ূন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন ৬৭ সালেÑআমি ৬৮ সালে। বয়সের ফারাক ১ বছরের। সেই আমরাই প্রথম চমকে উঠি তার নন্দিত নরক পেয়ে। শরৎচন্দ্র, নিহাররঞ্জন, রোমেনা আফাজ পড়তে পড়তে যখন সৈয়দ শামসুল হকের খেলারাম খেলে যা আমাদের বয়সকে আলোড়িত করে তখনও নন্দিত নরকে বা শঙ্খনীল কারাগার উচ্চকিত হয়ে হুমায়ূনের আগমন ঘোষণা করে। আমরা তার টিভি নাটক এইসব দিনরাত্রি বা চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। তবে এটি অকপটে স্বীকার করতেই হবে যে, হুমায়ূন বাংলা বই পড়ায় আগ্রহী করেন হুমায়রাদেরকেই। ফেসবুকেই একটি মেয়ে লিখেছেÑআমি আমার বইয়ের আলমারিটা খালি রাখব। ৩২২টির পরে আর কোন বই আমি রাখব না সেখানে। হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে এমন অসংখ্য মন্তব্য পাঠ করে এটি বলা যায় যে, বাংলা ভাষাকে জীবিত করা বা বাংলা প্রকাশনাকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হুমায়ূন আহমেদ যেমনটি অবদান রেখেছেন তা আর কেউ করেনি। তবে হুমায়ূনের কৃতিত্ব আরও বড়। তিনি শুধু লেখক হলেই যথেষ্ট হতো। তাঁর গল্প উপন্যাসই তাঁকে অমরত্ব দিতে পারে। কিন্তু তিনি সেখানে থামেননি। বরং বাংলাদেশের টেলিভিশনের নাটক বা বাংলা চলচ্চিত্র কোনদিন তাকে ভুলতে পারবে না।
আমাদের জন্য হুমায়ূন এসব কিছুর উর্ধে। আমরা যারা ময়মনসিংহের মানুষ বা আমরা যারা নেত্রকোনার মানুষ বা একেবারে ভাটি বাংলা কিংবা হাওড় অঞ্চলের মানুষ তাদের জন্য তিনি গৌরবের, এজন্য যে তিনি একদিকে মহুয়া মলুয়ার দেশকে সারা দুনিয়ার কোলে তুলে ধরেছেন, অন্যদিকে আমাদের ভাটি বাংলার হাছন রাজা, উকিল মুন্সি, রশিদ উদ্দিন আর জ্যোৎস্না ভরা সৌন্দর্যকে অমরত্ব দিয়েছেন। আমি ভাটি বাংলার মানুষের পক্ষ থেকে তাঁর কাছে শ্রদ্ধাবনত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। গর্ব করছি সেই মাটির একজন মহত সন্তানের জন্য। একজন মুক্তিযুদ্ধের অংশগ্রহণকারী ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের সাথে যুক্ত একজন হিসেবে আমি তাঁকে এই শ্রদ্ধাটুকু দিতে চাই যে, তিনি রাজাকারকে ‘তুই রাজকার’ এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে বাঙালীর শ্রেষ্ঠতম লড়াই হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সাহিত্য সমালোচক বিশ্বজিৎ ঘোষ যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, তার জোছনা ও জননীর গল্প কেবল আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে মহিমান্বিতই করে না বরং বাংলা সাহিত্যের এক অমর সৃষ্টি। আমি এটি বিশ্বাস করি যে, বাংলার হুমায়ূন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যসহ সৃজনশীলতাকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন তাতে তিনি অমর বাঙালীদের শীর্ষে থাকবেন।

ঢাকা, ০৩ আগস্ট ২০১২ ॥ লেখক তথ্যপ্রযুক্তিবিদ, কলামিস্ট, দেশের প্রথম ডিজিটাল নিউজ সার্ভিস আবাস-এর চেয়ারম্যান- সাংবাদিক, বিজয় কীবোর্ড ও সফটওয়্যার এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রণেতা ॥ ই-মেইল : mustafajabbar@gmail.com, ওয়েবপেজ:www.bijoyekushe.net

No comments

Powered by Blogger.